অভ্যাসে রবীন্দ্রনাথ #মৌসুমী

অভ্যাসে রবীন্দ্রনাথ

#মৌসুমী

আমি তখন ক্লাস সেভেনের ছাত্রী, বাড়িতে গানের দিদিমনি এসেছেন আমাকে গান শেখাতে,
রান্নাঘর থেকে ভেসে এলো আমার মায়ের গলায় গাওয়া “এসো শ্যামল সুন্দর,আনো তব তাপোহারা, তৃষাহারা সঙ্গসুধা”।
দিদিমনি বললেন”বাহ! তোমার মায়ের গানের গলা তো চমৎকার, উনি কি গান শিখেছেন?”
ছোট্ট আমি তাকিয়ে ছিলাম ওনার দিকে,কারণ আমি আমার মাকে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইতে কখনো দেখিনি,
পরে মাকে জিজ্ঞেস করলাম,”মা তুমি এত সুন্দর রবীন্দ্রসঙ্গীত কখন শিখলে ?
মা অমনি একগাল হাসি হেসে বলেছিল ” রবীন্দ্রসঙ্গীত কি শিখতে হয়! রবীন্দ্রনাথ তো বাঙালির অভ্যাসে থাকেন”।।

সত্যি তাই আমি কখনো আলাদা করে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখিনি,
তবে বাথরুম থেকে ছাদ সর্বত্র, বছরের প্রতিটা দিন রবীন্দ্রনাথ থাকেন আমার সাথে।
এমনি এক বৈশাখের কাঠফাটা রোদে,মাটি যখন তপ্ত হয়ে উঠেছে,
চারিদিক রোদের তাপে শুকিয়ে গেছে,চাতকেরা জলের খোঁজে উড়ে বেড়াচ্ছে আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত,
ঠিক তখনি আমার বাবা চিরকালের মতো ছেড়ে চলে গেলেন আমাদের,
খালি পায়ে তপ্ত মাটিতে দাঁড়িয়ে আমার মায়ের ফ্যাকাশে মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না,
বাবার নিথর দেহের পাশে আমার মা বসে,কানে কানে বললাম “মরণ রে তুঁহু মম শ্যাম সমান”।।
এ যেন গুরু মন্ত্র, আমার মা চোখের জল মুছে শান্ত বারো বছরের মেয়েটার মতো তাকিয়ে রইল বাবার দিকে,
আমার মায়ের অভ্যাসে রবীন্দ্রনাথ,মাকে সেদিন ওই কয়েকটা কথায় সেই শোকের সাথে লড়াই করার সাহস দিয়েছিল।।

এখন আমি দুই কন্যা সন্তানের মা, আমারও অভ্যাসে রবীন্দ্রনাথ,
রান্নাঘরের জানলা দিয়ে নীল আকাশের দিকে তাকালেই আপনা থেকেই গলায় সুর আসে “এই আকাশে আমার মুক্তি”,
মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে, কিভাবে যেন চলে আসে “খড়বায়ু বয় বেগে , চারিদিক ছায় মেঘে”,
ওগো নেয়ে নাও খানি বাইয়ো।।
আরও এমন বিভিন্ন মুহূর্তে বিভিন্ন সময় রবীন্দ্রনাথের গান, কবিতা চলেই আসে আমাদের কন্ঠে,
আমার মেয়েরা এখন আমাকে জিজ্ঞেস করে,”মা! তুমি বুঝি শিখেছো রবীন্দ্রসঙ্গীত?
আমিও এখন আমার মায়ের মতোই ওদের বলি,
ধুর! শিখতে হবে কেন, আমরা যারা বাঙালি, আমাদের রোজের অভ্যাসেই রবীন্দ্রনাথ।।
এই অভ্যাসই আমাদের রবীন্দ্রনাথ যিনি মনে প্রাণে ঈশ্বরের মতো রয়ে যায় প্রত্যেকের ঘরে,
শুধুমাত্র পঁচিশ বৈশাখে নয় বছরের প্রত্যেকটি দিনে।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *