ধারা ভৌমিক ভাদুড়ী প্রবন্ধ – বুদ্ধচরিত , অশ্বঘোষ ও রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর l

ধারা ভৌমিক ভাদুড়ী

প্রবন্ধ – বুদ্ধচরিত , অশ্বঘোষ ও রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর l

অশ্বঘোষ ছিলেন খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের একজন মহাকবি , মহান যুক্তিবাদী শাস্ত্রবিদ , একজন বিদগ্ধ বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারক l তিনি কুষাণরাজ কণিষ্কের সভাকবি ছিলেন l ঐতিহাসিক লামা তারানাথ তাঁর History of Buddhism in India তে লিখেছেন , অশ্বঘোষ সঙ্ঘগুহ্য নামে এক ব্রাহ্মণের পুত্র ছিলেন l মাতা ছিলেন সুবর্ণাক্ষী l পার্শ্ব বা পুন্যযশা ছিলেন তাঁর গুরু l বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী অশ্বঘোষ ছিলেন প্রচারক , দার্শনিক ধর্মতত্ববিদ , মহাযানী গবেষক কবি ও নাট্যকার l সাহিত্যের উজ্জ্বল জ্যোতিস্ক অশ্বঘোষ জন্মেছিলেন প্রাচীন ভারতের সরযূ নদীর তীরে অবস্থিত প্রাচীন সাকেত বা বর্তমান অযোধ্যা নগরীতে l তাঁর জন্ম ও মৃত্যু আনুমানিক 80 A.D – 150 A.D . অশ্বঘোষ বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন l সাকাতের বলাকারাম বিহারের প্রধান পুরোহিত শ্রীমৎ ধর্মসেন মহাস্থবির এর কাছে তিনি উপসম্পদা ( নবীন বৌদ্ধ ভিক্ষু থেকে এক পূর্ণাঙ্গ ভিক্ষুতে পরিণত হওয়ার অনুষ্ঠান )গ্রহণ করেন l এরপর উচ্চতম বৌদ্ধধর্মে জ্ঞান অর্জনের জন্য তিনি পাটলিপুত্র যান l শিক্ষাশেষে কুষাণ সাম্রাজ্যে আসেন l তাঁর পরিপূর্ণ ব্যক্তিত্ব , অসীম জ্ঞান ও কবিত্ব শক্তিতে মুগ্ধ হয়ে কুষাণরাজ কনিষ্ক তাঁকে সভাকবি পদে অভিষিক্ত করেন l অশ্বঘোষের লেখা ” বুদ্ধ চরিত ” একটি মহাকাব্য l মূল গ্রন্থটি সংস্কৃতে লেখা l নিজের নীতিবোধে অটল থাকলেও তাঁর কাব্যের ভাষা
অতি মধুর , সুললিত ও মর্মস্পর্শী l

. . . অশ্বঘোষ যে
” বুদ্ধচরিত ” লিখেছেন তা প্রথমে ইংরাজি , জার্মান , রাশিয়ান , জাপানি প্রভৃতি এবং পরবর্তীতে নানা ভারতীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে l

সিদ্ধার্থ মানুষের জরা ব্যাধি ও মৃত্যুর ভয়ঙ্কর রূপ দেখে মানব জাতির মুক্তির পথের সন্ধানে স্ত্রী পুত্র পরিবার ও রাজসুখ বর্জন করে গৃহত্যাগ করেন l বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্রে এই ঘটনা ” মহাভিনিষ্ক্রমণ ” নামে
পরিচিত l

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পুত্র রথীন্দ্রনাথ কে আদেশ দিয়েছিলেন — প্রাচীন যুগের বৌদ্ধ পন্ডিত অশ্বঘোষের
” বুদ্ধ চরিত ” বইটি যেন তিনি সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনুবাদ করে রাখেন l রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক জায়গায় লিখেছেন –
“এই কাজ করতে গিয়ে তাঁকে আবার নতুন করে সংস্কৃত সাহিত্য ঝালিয়ে নিতে হয়েছিল l ”

শ্রদ্ধেয় রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর – ” বুদ্ধচরিত ” বইটি বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন যা বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ l পন্ডিত অশ্বঘোষের লেখা ‘বুদ্ধচরিত ‘ এর প্রথম অংশ – প্রধানত গৌতম বুদ্ধের গৃহত্যাগের ঘটনা l

রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনূদিত ” বুদ্ধচরিত ” এর সামান্য অংশ —

. .” শুচি ও সৌম্য বেশ পরিহিত বিনীত পৌরজনে আকীর্ণ রাজপথ , সেই প্রথম দেখিয়া কুমার হৃষ্ট হইলেন l. এবং নিজের যেন পুনর্জন্ম হইলো — তাঁহার মনে কতকটা এইরূপ ভাবের উদয় হইলো l.
পরন্তু শুদ্ধাদিবাস দেবগন সেই নগরকে স্বর্গের ন্যায় প্রহৃষ্ট দেখিয়া , রাজপুত্রের গৃহত্যাগের ( প্রবজ্যা ) অনুপ্রেরণা জন্য এক জরাজীর্ণ মায়ামানব সৃষ্টি করিলেন l সাধারণ জনসমূহ হইতে পৃথগাকৃতি , জরাভিভূত সেই বৃদ্ধ কে দেখিয়া রাজকুমার অনিমেষ নয়নে তাঁহার দিকে চাহিয়া রহিলেন , এবং সারথি কে উদ্বিগ্ন হইয়া প্রশ্ন করিলেন —–
হে সূত , শ্বেত কেশ যুক্ত , ভ্রূদ্বারা আবৃত নেত্র, শিথিল ও অন্ত অঙ্গ দণ্ডধারী এই ব্যক্তি কে l ইহার কি কোনোরূপ বিকৃতি হইয়াছে l না ইহার প্রকৃতিই এইরূপ l না দৈববশত ইহার এইরূপ আকৃতি হইয়াছে l ”
কুমার এই প্রশ্ন করিলে , সারথি সেই অপ্রকাশ্য জরার বিষয় নৃপাত্মজ কে নিবেদন করিলেন l.দেবগনের দ্বারা বুদ্ধিভ্ৰংশ হইয়া তিনি তাহাতে কোনো দোষ দর্শন করিলেন না l ( তিনি উত্তর করিলেন )—-
” ইহা রূপ বিনাশক , বলহানিকর , শোকের আকর , সকল সন্তোষের অপহারক , স্মৃতিনাশক , ইন্দ্রগণের রিপু —- ইহার নাম জরা l ”

. . . অনন্তর দেবগনও ব্যাধিপরিপূর্ণ দেহ এক পুরুষ সৃষ্টি করিলেন l শুদ্ধোধন সুত তাহা দেখিয়া , তাহার প্রতি দৃষ্টি নিবেশ পূর্বক সারথিকে প্রশ্ন করিলেন –

. . ” স্থূলোদর , শ্লথস্কন্ধ , শিথিলবাহু , পাণ্ডুগাত্র এ ব্যক্তি কে ! প্রতি শ্বাস প্রশ্বাসে দেহের প্রতিটি বাহু কম্পিত হইতেছে l অন্য এক ব্যক্তিকে আশ্রয় করিয়া , এ করুণ স্বরে ‘মা মা ‘ এই ধ্বনি উচ্চারণ করিতেছে l
তখন সারথি কহিলেন , —
” হে সৌম্য ধাতু প্রকোপ হইতে উৎপন্ন , রোগ নামক সুমহান অনর্থ , ইহাতে পরিপূর্ণ রূপে বৃদ্ধি পাইয়াছে l. এই ব্যক্তি পূর্বে শক্তিমান ছিল l আজ রোগ ইহাকে পরাধীন করিয়াছে l ”

. . . . ( এরপর ) রাজপুত্র পথে বাহির হইলে দেবগন এক মৃতদেহ সৃষ্টি করিলেন l পথে বাহিত সেই মৃতদেহ কুমার ছাড়া কেহ দেখিতে পাইল না l তখন রাজকুমার সারথি কে জিজ্ঞাসা করিলেন —
” চারিজন বাহকের দ্বারা বাহিত এই ব্যক্তি কে l ইহাকে শোকার্ত জনগণ অনুসরণ করিতেছে l এই পুরুষ সুভূষিত তথাপি সকলে ইহার জন্য ক্রন্দন করিতেছে l ”

সারথি বলিলেন — ” বুদ্ধি , ইন্দ্রিয় , প্রাণ ও গুন বিযুক্ত , সুপ্ত , সংজ্ঞাহীন , তৃনকাষ্ঠবৎ এই ব্যক্তিকে তাহার প্রিয় ব্যক্তিগণ এতদিন যত্নের সহিত বর্ধন ও রক্ষা করিয়া এখন পরিত্যাগ করিতেছে l
. . . সকল সৃষ্ট জীবেরই পরিনাম এইরূপ l ইহলোকে হীন , মধ্য , মহাত্মা
সকলেরই নিয়ত বিনাশ হয় l

অমিতানন্দ বৌদ্ধ ভিক্ষু লিখছেন —–

এই শুনে গৌতম সন্ন্যাসী হওয়ার মানসে নৈরঞ্জনা নদীর তীরে এসে তার সমস্ত চুল কর্তন করলেন l এবং সেখানে অধিষ্ঠান করেছিলেন ( বলেছিলেন ) — আমি এই জন্মে যদি বুদ্ধাঙ্কুর হয়ে বুদ্ধ হতে পারি , তবে আমার চুলের অধঃগতি ( নিচে পরবেনা ) হবেনা উর্দ্ধগতি হবে l ”

. এই অধিষ্ঠান শুনে – দেবরাজ ইন্দ্র ( হিন্দু দেবতা ) আকাশ মার্গে এসে একটি স্বর্ণপাত্রে সেই চুল সংগ্রহ করলেন l সেই চুল দিয়ে – চুলামনি চৈত্য নির্মাণ করে আজ পর্যন্ত দেবতারা পুজো করে চলেছেন l সেই থেকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা আকাশ প্রদীপ জ্বালিয়ে বুদ্ধদেব কে উৎসর্গ করেন – সাথে থাকে – বুদ্ধদেবের প্রতি অন্তরে গভীর শ্রদ্ধা , বৌদ্ধ সংকীর্তন গাথা আবৃত্তি ও সাধু সাধু ধ্বনি ও আকাশে শত শত আকাশ প্রদীপ l

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *