উপন্যাসিক। সূর্যশিশির। পর্ব-৭। ছন্দা চট্টোপাধ্যায়।

উপন্যাসিক
সূর্যশিশির।
পর্ব-৭।
ছন্দা চট্টোপাধ্যায়।
-‘হ্যালো?’-
-‘আরে আমি শ্রী রে বৃন্দা,তোদের ছিরি’-
-‘ ওম্মা, তুই এ সময়?’- -‘এসেছি তো! শোন্ বৃন্দা, কুহেলী আর মধুরার সঙ্গে যোগাযোগ কর। কাল শনিবার, আমরা দেখা করি?’- -‘কোথায় দেখা করবি বল্?’- -‘কেন! আমাদের পুরোনো কোলকাতায়? বাগবাজার গঙ্গার ঘাটে!’- -‘তোর নস্টালজিয়া আর গেলো না শ্রী! আমরা তো সবাই কোলকাতার আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছি। মফস্বলে।’- -‘তবে কল্যাণীতে ব্যবস্থা কর। শতম তো কল্যাণীতে…’- -‘নারে শ্রী,শতম বর্দ্ধমানে ট্রান্সফার নিয়েছে। ও এখন ওদের দেশের বাড়িতেই থাকে। বর্দ্ধমানে যাতায়াত করতে কাছে হয়। ‘- -‘সেকি!মধুরা রাজি হলো?’- -‘কতোটুকু চিনিস রে মধুরাকে? মধুরাই জোর করেছে।অতো বড়ো বাড়ি; একটা অংশ তো শতমের ভাগে। জমি জায়গা, স্বচ্ছল অবস্থা।’- -‘সে তো ভালোই রে বৃন্দা।তবে মধু কেন স্যারের দিকে ঝুঁকেছে সেটাই বুঝতে পারছি না।এক সময়ের দুর্বলতা তো কেটে যাওয়ার কথা!’- -‘শ্রী, আমরা তো জানি, গাছের খাওয়া,তলার কুড়ানো মধুর স্বভাব।ওর সব চাই।’- শ্রীময়ী বলে -‘আমার সেখানেই খটকা লাগছে।মধু কোনো রাজনৈতিক চরিত্র নয় যে, অনবরত খেলা করে যাবে। আমার মনে হয় ওর মানসিক চিকিৎসা, মানে কাউন্সেলিং দরকার। আমার বিশ্বাস ওর শৈশবে কোনো আহত স্মৃতি আছে।’- বৃন্দা বলে -‘ঠিক আছে। তবে কুহেলী আর মধুরাকে বলি বর্দ্ধমানেই কোথাও দেখা করতে। আচ্ছা শ্রী,শতমকেও ডাকবো?’–‘এখন না। শতমন্যুর কোনো মানসিক সমস্যা নেই। সমস্যা আছে মধুরার। দুটো ব্যাপার খেয়াল কর তোরা। প্রথমতঃ মধুরা ছোট থেকেই ওর মায়ের প্রসঙ্গে কিছু বলতে চাইত না। বেশ বিরক্ত থাকতো। আমরা যখন মাকে নিয়ে গর্বিত হতাম, বলতাম আমার মায়ের মতো কেউ রাঁধতে পারে না, অথবা মা আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, ও তখন বলতো, তোদের ভাগ্য কতো ভালো – কতো ভালো মা তোদের! ইত্যাদি। মনে আছে? ওর মায়ের ওপর একটা চাপা ক্ষোভ প্রকাশ পেতো। ‘- -‘হ্যাঁ রে, এটা তুই তো ঠিক বলেছিস!’- বৃন্দা বলে। নির্দিষ্ট দিনে চার বন্ধু দেখা করে বর্দ্ধমান গোলাপবাগে। মধুরা বেশ হাসিখুশি আজ। কুহেলী বলে -‘আয় মধু। কতদিন পর দেখা।’- চার বন্ধু পরস্পরের কুশল বিনিময় করে। এ কথা সে কথার পর শ্রীময়ী বলে -‘একদিন চল, কোলকাতায় যাই। আমাদের কলেজটা দেখে আসি। মধুরা তোর বাপের বাড়ি তো গোয়াবাগানে, চল্ না রে,কাকু কাকিমার সঙ্গে দেখা করে আসি।’- মধুরা বলে -‘বাবা তো নেই। আর মা তার ছেলের কাছে ভালোই আছে। আমি আর ঐ বাড়িতে যাই না।’- বন্ধুরা চোখ চাওয়াচাওয়ি করে। বৃন্দা বলে -‘থাক তবে, ব্যক্তিগত কথা জিজ্ঞেস করবো না। পাইকপাড়া যাবি? আমার বাপের বাড়ি। আমার বাবাও অবশ্য এখন আর নেই। মা আছে। খুব খুশী হবে আমাদের দেখলে।’- হঠাৎ মধুরা বিরক্ত হয়ে ওঠে। -‘কোনো ফ্যামিলির মধ্যে যেতে হবে কেন? আমরা বন্ধুরা মিলে নিজেদের কথা শেয়ার করতে পারি না?’- কুহেলী বলে -‘ঠিকই তো! আমিও এখন বাপের বাড়ি বেশী যাই না। বাবা ক্যান্সারে চলে যাওয়ার পর মা আমার কাছেই থাকে। ও বাড়িতে দাদা-বৌদি, ভাইপো ভাইঝির রাজত্ব। ভাল্লাগেনা।’- শ্রীময়ী এবার সাবধানে এগোয়। -‘কাকুর কি হয়েছিল রে মধু?’- মধুরার দু চোখ জলে ভরে ওঠে। -‘জানিস, আমার বিয়ের পর বাবা বেশ ভেঙে পড়ে। আমি ছিলাম বাবার নয়নের মনি। বাবার লাডলি, রাজকন্যা। আমি কিছু আব্দার করলে বাবা কখনো কখনো না করেনি। মা খালি বাবাকে বলতো,-‘ অতো আদর দিও না। তোমার মতো করে আদর যদি ওর বর না দিতে পারে, সংসারে ওর মন বসবে কি করে? সব সময় আমার বাবা আমাকে এতো ভালোবাসতো, ততো ভালোবাসতো বলে কষ্ট পাবে, আর কষ্ট দেবে। আসলে মা আমাকে হিংসে করতো!’- কথাটা বলে ফেলেই মধুরা চুপ করে যায়। আর শ্রীময়ী যা বোঝার বুঝে যায়। কথা ঘুরিয়ে বলে-‘ তোর শ্বশুরবাড়ি তো কৃষ্ণনগর। আমাদের একদিন যেতে বলবি না?’- -‘ঠিক আছে, শতমকে বলি। নিয়ে যাবো।’-