#ধারাবাহিক #রায় বাড়ির অন্দরমহল পর্ব–৩ ছবি ব্যানার্জী

#ধারাবাহিক
#রায় বাড়ির অন্দরমহল
পর্ব–৩
ছবি ব্যানার্জী
সেদিন রাতে পুটু সুন্দরী শাশুড়িমার পায়ে কোমরে কবিরাজি দুর্গন্ধযুক্ত তেল মালিশ করতে করতে দু তিনবার মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ওয়াক তুলল।শাশুড়িমা মালিশ পেয়ে আরামে চোখ বুঁজেছিল।ওয়াক শব্দ শুনে তীক্ষ্ণ গলায় বলল–বলি কাঁচা পোয়াতির মতো অক তুলছো যে বড়?কালই আমি রাধুকে বলব আমার তেল মালিশ করার দরকার নেই।এত হতচ্ছেদ্দা আমার সহ্য হবে না বাছা।বলি তোমার মায়ের ভগবান না করুন এমন হলে কি এমন করে অক তুলতে?নিজের ছেলে মেয়ের তো গু মুত ঘুচিয়েছো।এই তেলটা গুয়ের গন্ধর থেকেও খারাপ?
পুটু বলল–মা আজ প্রথম দিচ্ছি বলে একটু গা বমি দিচ্ছে।আপনাকে হতচ্ছেদ্দা করব এমন ক্ষমতা আমার নেই সেটা তো আপনি জানেন মা।আপনার ছেলের মা অন্ত প্রাণ।সে এসব কথা শুনলে দুঃখ পাবে।কিন্তু আমাকে তার জন্য অপমান করবে না।বরং অনুরোধ করবে। ব্রহ্মময়ী বলল–সে কি আর জানি না?এই বংশের ছেলেরা মাগবশো হলেও মা সবার আগে। সেটাও তো জানো বাছা।শোনো বৌমা তুমি আমার সেবা যত্ন করলে ভবিষ্যতে তোমার ব্যাটার বৌ ঠিক একই ভাবে তোমারও সেবাযত্ন করবে।তুমি আজ যা দেখাবে কাল সেটা নিজেও দেখবে।
পুটু বির বির করে বলল–ততদিন আমি বাঁচলে হয়।শাশুড়িমা বলল–কিছু বলছ?–বলছি সেবা যত্ন পাওয়ার কপাল সবার হয়না মা।ব্রহ্মময়ী বলল–তোমার ছেলের তার মায়ের ওপর ভক্তি থাকলে বৌ বাধ্য হবে সেবা যত্ন করতে।শোনো বৌমা খুব গরীবের ঘর থেকে তোমাকে আমি নিজে পছন্দ করে গয়না দিয়ে আপাদমস্তক সাজিয়ে এই বাড়ির বৌ করে নিয়ে এসেছিলাম।আমিও ছা পোষা ঘরের মেয়ে ছিলাম।আমার শাশুড়িমা বলতেন জমি কিনবে বাকুড়ি বৌ আনবে খেঁকুড়ি।খেঁকুড়ি বলতে গরীব ঘরের সুন্দরী মেয়ে।এই বংশে শাশুড়ির পছন্দে বৌ নির্বাচিত হয়।তুমিও দেখে শুনে পছন্দ করে বৌ এনো।
ব্রহ্মময়ীকে কবিরাজের নির্দেশ মতো সকালে রোদ ওঠার পর রাধাকান্ত আর শশী মিলে দালানে একটা মাদুর বিছিয়ে বসিয়ে দিত।পুটু বেশ কিছুক্ষণ রসুন তেল মালিশ করে স্নানে যেত। দেড় ঘন্টা পর আবার বাপ ছেলে ঘরে পৌঁছে দিত।ধনঞ্জয়ের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হত।
ধনঞ্জয় কবিরাজ সাক্ষাত ধন্বন্তরীই বটে।এক মাসের মধ্যে ব্রহ্মময়ী বেশ চাঙ্গা হয়ে গেল।প্রথম যেদিন সে নিজে উঠে দাঁড়াতে পারল সেদিন মুক্ত কন্ঠে স্বীকার করল সত্যি ধনঞ্জয়ের চিকিচ্ছের হাতখানা খাসা বটে।এরপর রাইমণির হাত ধরে আস্তে আস্তে হাঁটা চলা করতে শুরু করল।ধনঞ্জয় একদিন দেখতে এসে বলল–খুড়িমা এবার আপনি একাই হাঁটবেন সঙ্গে একটা লাঠি নেবেন।ব্রহ্মময়ী একগাল হেসে বলল–বেঁচে থাক বাবা।আমি তো মনে করেছিলাম আর হাঁটা চলা করতেই পারব না।
টানা সারে তিন বছরের বেশি ব্রহ্মময়ী বহাল তবিয়তে ছিলেন।মাস চারেক হল আবারও শয্যাশায়ী হয়ে পড়ল। দিন পনেরো আগেও নিজে উঠে বসতে পারত। লাঠি ধরে দু এক পা হাঁটতেও পারত।ইদানীং নিজে উঠে বসতেও পারে না।তবে বিছানায় শুয়ে থেকেও হুকুম চালানোর বিরাম নেই।প্রতিদিনই ধনঞ্জয় কবিরাজ একবার করে তাকে দেখে যান।আর কবিরাজ দেখতে এলে শাশুড়িমার গালমন্দ খেয়েও হাসিমুখে বলেন–খুড়ি মা আপনার বয়সটাও তো কম হল না?এই বয়সে আর কত শরীরের মেরামতি করব?যন্ত্রপাতির ও তো একটা ক্ষয় আছে। আপনার তো শরীরে ব্যথা যন্ত্রণা নেই। রাতে ভালো ঘুম খিদেও হয়।এখন তো আপনার শুধু বিশ্রাম সেবাযত্ন নেওয়ার বয়স।শুধু সকাল বিকাল দেওয়ালে ঠেস দিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকবেন।
শাশুড়িমা সুস্থ্য হয়ে যাওয়ার পর রাইমণিকে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।আবারও তাকে কাজে বহাল করা হল।
রাতে অনেকদিন পর রাধাকান্তকে জেগে থাকতে দেখে পটেশ্বরী বলল–বাবা আজ কি সূর্য পশ্চিম দিকে উঠেছিল?প্রতিদিনই তো আমার কেষ্ট ঠাকুর ঘুমে কাদা হয়ে থাকে।আজ হঠাৎ জেগে আছো যে?রাধাকান্ত বলল–আজ আমার পুটু সুন্দরীকে বড্ড আদর করতে ইচ্ছে করছিল।তোমার ফুলশয্যার কথা মনে পড়ে পুটু?
পুটু বলল–তা আবার মনে থাকবে না?পুটু সুন্দরী নামটা তো তোমার দেওয়া।আমাকে বাবা মা বুলু বলে ডাকত।সেদিন তুমি আমার পা দুটো কোলে নিয়ে নূপুর পরাচ্ছিলে আর আমি লজ্জায় লাল হয়ে বলেছিলাম–একি!ছিঃ ছিঃ তুমি আমার গুরুজন হয়ে পায়ে হাত দিচ্ছ কেন?রাধাকান্ত বলল–আমি কি বলেছিলাম?সেই ছড়াটা তোমার মনে আছে? আর একবার বলি শোনো–“আমার পুটু সুন্দরী সোনার অঙ্গুরি
আমার নয়নমণি
তোমার জন্য এনে দেব
আস্ত সোনার খনি।”
কথাটা শুনে এই মধ্যবয়সেও পুটু লজ্জায় রাঙা হয়ে বলল–ওইটুকুই যে তোমার ক্ষমতা ছিল সেটা এখন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি।–আহা সত্যিই এনে দিইনি বলো?বছরে দুবার তিনবার তোমার পছন্দ মতো গয়না গড়িয়ে দিয়েছি,লুকিয়ে মিষ্টি তেলেভাজা এনে খাইয়েছি। মন উজাড় করে ভালোবাসা দিয়েছি।জীবনে একমাত্র শুধু তোমার ওপর রাগ দমন করে রাখতাম।পুটু বলল–খুব মনে আছে। শাশুড়িমা বলতেন –বৌমা রাধু আমার এমনিতে মাটির মানুষ।কিন্তু রাগ উঠলে চন্ডাল।তা সেই রাগের নমুনা তো আমিও দেখেছি।তোমার রান্না মনের মতো না হলে ভাতের থালাশুদ্ধ আছড়ে ফেলে দিতে। ছেলে মেয়েদের কথায় কথায় গায়ে হাত তুলতে। রাধাকান্ত বলল–সে সব রাগ তো তুমিই ঠান্ডা করে দিতে।তোমার মনে আছে একদিন ডাল পাতলা হয়েছিল বলে ভাতের থালা তুলতে গেলে তুমি ফিসফিস করে মায়ের কান বাঁচিয়ে বলেছিলে–আজ ভাত না খেয়ে উঠলে আমি তিনদিন নির্জলা উপোস করব।আমি অমনি সুরসুর ভাত খেতে শুরু করে দিলাম।আমার এই আচরণ দেখে মা থেকে বাড়ির সবাই অবাক হয়ে গিয়েছিল।আর ছেলে মেয়েদের শাসন আর করতে দিলে কোথায়?শশী প্রথমবার যখন ম্যাট্রিকে ফেল করে বাড়ি এল তখন রাগে অন্ধ হয়ে ওকে লাঠিপেটা শুরু করতেই তুমি ছুটে এসে বললে–শশীর গায়ে আর একটা লাঠির ঘা পড়লে আমি আত্মহত্যা করব।তখন যদি মারটা ঠিকমতো পড়ত তাহলে পরেরবার ম্যাট্রিকে ভালো রেজাল্ট করত। এরপরেও তুমি আমার ওপর অভিমান করবে?
পুটু বলল– তুমি সবই দিয়েছো শুধু স্বাধীনতা দাওনি।তুমি বুঝিয়ে দিয়েছো এই সংসারে শুধু মুখ বুঁজে শাশুড়িমার সেবা করা আর হুকুম তামিল করাই আমার ভূমিকা।তার শরীরের খোঁজ নেওয়াটাও অপরাধ।মায়ের কথা আমি ধর্তব্যেই মধ্যেই ধরি না।কিন্তু তুমি সেদিন কি করলে?
রাধাকান্ত স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে বলল– ওটা তো মায়ের মন খুশি করার জন্য বলেছিলাম। আমি জানি তুমি মায়ের কথায় কষ্ট পাও।কিন্তু মা তোমাকে ভালোও তো বাসে।তোমার একবার খুব জ্বর হয়েছিল। তুমি ঘোরের মধ্যে বিছানার পড়েছিলে তখন মাকে দেখেছি মা তোমার পায়ে বুকে রসুন তেল গরম করে তোমার সেবা করছে।তারপর তোমার ভূমিষ্ঠ হওয়া সন্তান কিংবা পেটে আসা সন্তান যখন নষ্ট হয়ে যেত তখন মাই তো তোমাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিয়ে বলত–গাছের সব কুড়ি ফুল হয়ে ফোটে না বৌমা।এই আমাকেই দ্যাখো না আমার সাত সাতটা সন্তানের মধ্যে মাত্র দুটো ছেলে বেঁচে ছিল।ছোট ছেলেটা মাত্র সাত বছর বয়সে ম্যালেরিয়া ভুগে মারা গিয়েছিল শিবরাত্রির সলতের মতো একা রাধুই বেঁচে আছে।
পুটু বলল–মানুষটাকে আমি কি কখনও অবহেলা করেছি?সেই বিয়ের কনে থেকে তার সেবা যত্ন করেই তো এত কাল কাটিয়ে দিলাম।যাকগে আমি একটা কথা বলছিলাম শুনবে?–তুমি শুধু হুকুম করো।–এবার তো শশীর বিয়ের কথা ভাবতে হয়।
রাধাকান্ত বলল– মায়ের এই অবস্থায় বাড়িতে আনন্দ উৎসব করাটা কি ভালো দেখাবে?পুটু বলল–তোমার মা যদি একশো বছর বেঁচে থাকে তাহলেও কি আনন্দ উৎসব বন্ধ থাকবে?মানুষের বাঁচারও তো একটা সীমা আছে।আর কতকাল আমি তোমার মায়ের সেবা যত্ন করব?রাধাকান্ত বিষণ্ণ মুখে বলল–তুমি এটা কি বললে?মৃত্যু কি মানুষের হাতে থাকে?তোমাকে তো মায়ের হাগা মুত পরিস্কার করতে হয় না।সেটা করার জন্য টাকা দিয়ে লোক রেখেছি। আমি এতকাল ভেবেছিলাম তুমি মায়ের প্রতি দায়িত্বটা হাসিমুখে গ্রহণ করেছো।ঠিক আছে আমি বিশাখাকে বলব।সে আমার মায়ের রক্ত।এই সেবাটুকু করা তার ও কর্তব্য।
পুটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল–আমি ওটা কথার কথা বলেছি বলে তুমি আমাকে এতটা ভুল বুঝলে? এতকাল এই সংসারের জন্য এতকিছু যে করলাম সেটা কি শুধুই কর্তব্য থেকেই করেছি?ভালোবাসা ছিল না?আমার ও তো কিছু সাধ আহ্লাদ আছে।আমার কথাটা তুমি মেনে নিতেই পারতে।মা বরং বেঁচে থাকতে নাত বৌ দেখে যেতে পারত।
তাহলে আমার রাগ হত না।আমার রাগের মাথায় বলা কথার এত গুরুত্ব দিলে? এতকাল তোমার সঙ্গে সংসার করে এই চিনলে তুমি আমাকে?বেশ আমি ক্ষমা চাইছি তোমার কাছে।কি গো এখনও রাগ করে থাকবে?
রাধাকান্ত বলল–তুমি তো জানো পুটু তোমার ওপর আমি রাগ করে থাকতে পারি না।তোমার দোষও ঠিক নেই।শয্যাশায়ী রোগীর টানা সেবা যত্ন করলে একটা বিরক্তি সবার আসে।ভেবোনা শশীর বিয়ের বয়স পালিয়ে যায়নি।
ক্রমশ–