আত্মজা ——- ধারাবাহিক উপন্যাস অধ্যায় – ১৮ সুদেষ্ণা সিনহা

আত্মজা
————–
ধারাবাহিক উপন্যাস
অধ্যায় – ১৮
সুদেষ্ণা সিনহা

বেশ কিছুদিন ধরে একটা ছবির কথা মনে পড়ছে স্বাধীনতার। ছবি বললে ভুল হবে। ছবি ঠিক নয় ,একটা বাণী।ঘোমটা পরা বিষন্ন এক নারীমুখ,কাজল কালো চোখে সর্বস্ব হারানোর  বেদনা নিয়ে যেন স্বীকার করে নিচ্ছে — সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে। কাঠের ফ্রেমে কাঁচ দিয়ে বাঁধানো এই বাণী কিনে এনেছিলেন তার ঠাকুর্দা,কৃষ্ণকান্ত ভট্টাচার্য কলকাতা থেকে। বেশ শৌখিন মানুষ ছিলেন তিনি।সাহেবদের শেয়ার হোল্ডার হবার সুবাদে কলকাতার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সংযোগ ছিল।

স্বাধীনতাদের বাড়ির ঘেরা বারান্দায় এখনো টাঙানো আছে এরকম কিছু বাণী।
ঠাকুমা বলতেন,মেয়েরাই সংসারটাকে ধরে রাখে।পুরুষমানুষের রাতদিন বাইরে কাজ।তাদের মন তো উড়ু উড়ু হবেই।মেয়েদের গুণ দিয়ে তাদের বেঁধে রাখতে হয়। তবে সংসারে শান্তি বজায় থাকে।

স্বাধীনতা তখন লক্ষ্মীবাঈ এর সাহসিকতার গল্প পড়ছে।মাতঙ্গিনী হাজরার বীরত্ব কাহিনী পড়ছে। হেসে সে বলত,এখন তো ছেলেমেয়ে সবাইকেই বাইরের কাজ করতে হয় ঠাকুমা।তবে একা মেয়েরাই কেন তাদের গুণ দিয়ে সংসার সুখের করবে?

ফোর পাশ ঠাকুমা,বিধুরাণী নাতনির সাথে তর্কে পেরে ওঠেন না ।
বলেন,আমাদের যুগে মেয়েরা পুরুষদের মুখের উপর রা কাটার সাহস করতো না বোন।বড়রা বলতেন , ব্যাটাছেলে সোনার আংটি।শত দোষে তাদের দোষ হয় না।

বেশ কিছুদিন ধরে অলোককে লক্ষ্য করছে স্বাধীনতা।জবার জন্মের পর থেকে কেমন যেন ছাড়া ছাড়া ভাব। সে বাড়িতে থাকে ঠিকই,তবে অন্যমনস্ক,ভাবলেশহীন। এক ছাদের নীচে দুটো আলাদা পৃথিবী।

জবার জন্মের পর পরই একটা কথা কানে এসেছিল স্বাধীনতার।সে কথাটা সে কাউকেই বলতে পারেনি। একদিন সন্ধ্যেবেলায় অলোকদের ত্রিমোহিনী হাই স্কুলের  মানসবাবু আর তার স্ত্রী, তপতীদি এসেছিলেন তাদের মেয়েকে দেখতে ।স্বাধীনতাদের বিয়েতে মানসবাবু আসতে পারেননি।তাই স্বাধীনতা অলোকের মুখে তার নাম শুনলেও কোন দিন দেখেনি ।
আলাপ পরিচয়ে জমে উঠল।একথা সেকথার পর দেখা গেল তপতীদি স্বাধীনতার দুই বছরের বড় এবং তাদের কাদম্বিনী গার্লস হাই স্কুলেরই ছাত্রী।
অলোক সেদিন বহরমপুরেই ছিল। মা চা,মিস্টি পাঠিয়ে দিয়েছেন ঘরে।
অলোক বলল,চল মানস আমরা ছাদে যাই।সিগারেট টেনে আসি।
তপতীদি বলল,যান যান।আমরাও একটু প্রাণ খুলে গল্প করি।
শুরু হল গল্প। দুই ছাত্রীর অতীতের স্বর্ণযুগ উঠে এল।
—-দি তোমার মনে আছে,ছন্দাদির কথা?
—- মনে থাকবে না রে?কি ব্যক্তিত্বময়ী! পড়া না করে আসলে দাঁড় করিয়ে রাখতেন।ছুটির পর পড়া দিয়ে তারপর বাড়ি ফেরার অনুমতি মিলত।
—–আর শকুন্তলাদি?
—–হ্যাঁ, উঁনি তো শেষে কলেজে জয়েন করেছিলেন।
—–তারপরের খবর জান?
—– জানি উঁনি কলেজে গিয়ে বয়েসে ছোট এক ছাত্রকে বিয়ে করেছিলেন।ভেরি স্যাড।সে বিয়ে টেকেনি।ডিভোর্স হয়ে যায় শেষ পর্যন্ত…অথচ দিদি কতো ভালো ছিলেন।
এরপর থেমে গিয়েছিল তপতী।তারপর চারিদিক দেখে নিয়ে খুব নীচু গলায় বলেছিল,একটা কথা বলব স্বাধীন?
-‐—হ্যাঁ,বলো।
-‐— কাউকে বলবি না?
—-না ।তুমি বলো। আমি কাউকে বলব না।অলোককেও না।
—–ওদের স্কুলে একটা মেয়েঘটিত কেস হয়েছে।জানিস?
—–না তো।
—–অলোক কিছু বলেনি?
—-না তো।
—-কেসটা অলোককে নিয়েই…একটা ইলেভেনের মেয়েকে ফাঁকা ঘরে জড়িয়ে ধরেছিল…তারপর অনেক কান্ড। হেডমাসাটারের সামনে অভিভাবকের কাছে ক্ষমা চায়তে হয়েছিল।
—আমি জানি না দিদি।
স্বাধীনতার মাথার ভিতরটায় যেন আগুন জ্বলে ওঠে।
—-এত ইতর!
—-তারপরেও আছে …
—মানে?
—-হ্যাঁরে ওদের স্কুলের কাছে ঘর ভাড়া নিয়েছিল না?রেবতীবাবুর বাড়ি?
—-জানি তো
—-রেবতীবাবুর মেয়েটা বাচ্চা….ক্লাস নাইনে পড়ে…তোর মানসদার মুখে শুনলাম তারও গায়ে নাকি হাত দিয়েছে।স্কুলে এ নিয়ে কত কথা চালাচালি।বল,কে কার মুখে হাত দেবে ?
পরিবেশটা ক্রমশঃ বিষাদময় হয়ে ওঠে। লজ্জায়-ঘৃণায় স্বাধীনতার মাথা হেঁট হয়ে আসে।
চলে যাবার আগে স্বাধীনতার দুই হাত ধরে তপতী বলে,বোন একথা বলেছি ঘুণাক্ষরে যেন জানতে না পারে।মানস জানলে আমাকে কেটে ফেলবে।শুধু তোকে ছোট থেকে চিনি।তুই আমার ছোট বোনের মত।প্লিজ কথা রাখিস….

স্বাধীনতা তার বাবার মতো স্বচ্ছ মনের মানুষ।মনের ভিতরের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে বাইরে নিশ্চিন্ত মানুষের অভিনয় সে করতে পারে না কোনদিন।
তপতীদি অলোকের সম্বন্ধে যা বলে গেল,সে সব কথা নিয়ে সে নিজের মনে অনেক ভাবলো। একটা মানুষকে দোষী সাব্যস্ত করতে হয় অনেক ভেবেচিন্তে।আর এই যে মানুষটাকে সে কালিমার প্রলেপ দিচ্ছে,সে আর কেউ নয় তার জীবনসাথী।
রাত্রে খাওয়াদাওয়ার পর অলোকের সঙ্গে তার একটাও কথা হলো না।দরজায় খিল তুলে সে যখন বিছানায় শুতে এল,তখন অলোকের নাক ডাকছে।

সেদিন  অনেক রাত অবধি ঘুম এল না স্বাধীনতার।কয়েকবার এদিক ওদিক ছটফট করল।উঠে গ্লাসের ঢাকা সরিয়ে খানিক জল খেল।একবার বাথরুমে গিয়ে মুখেচোখে জল দিয়ে এল।তাও ঘুম আসছে না দেখে সে চিত হয়ে শুয়ে কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে থাকল। হঠাৎ তার
মনে পড়ল জন গলস্ওয়ার্দির নাটক জাস্টিসের নায়ক ফল্ডারের কথা। ফার্স্ট ইয়ারে ইংরাজি নাটকের ক্লাস নিতেন পি.বি স্যার।ভদ্রলোক আধপাগলা।নাটক পড়াতে পড়াতে তিনি নাটকের চরিত্রের ভিতরে ঢুকে যেতেন। নায়ক ফল্ডার খুব ভাল ছেলে তবুও পরিস্থিতির চাপে সে একটা ব্যাঙ্কের চেক জালিয়াতি করেছিল,এই নিয়ে সেদিনের ক্লাসে আলোচনা করতে করতে স্যার একটা বাইবেলের লাইন বলেছিলেন —-পাপকে ঘৃণা কর,পাপীকে নয়।

ঠিক ঠিক ঠিক।সে আর অলোককে ঘৃণা করবে না। একদম ঘৃণা করবে না। যদি এটা তার মনের কোন অসুখ হয়? হয়তো অলোক চায় না এসব করতে,তবুও নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যা চায় না তাইই করে ফেলে!

অলোক,আমি তোমাকে ভালবাসি। আমি তোমাকে সত্যিই ভালবাসি। তোমাকে কিছুতেই হারতে দেব না আমি।তুমি কেন আমার কাছে সহজ হতে পার না!তুমি কি বুঝতে পার না আমি তোমাকে কতখানি ভালবাসি!

আলতো করে ধরে ঘুমন্ত জবাকে একপাশে সরিয়ে দেয় স্বাধীনতা।তারপর অলোকের পাশে সরে গিয়ে ঘনিষ্ঠ হয়।অলোকের ঘুম ভেঙে যায়।অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে কিছুক্ষণ।স্বাধীনতার চোখে প্রশ্রয়।স্বাধীনতার শরীরে উচ্ছ্বাস। অলোক সাড়া দেয়। স্বাধীনতার শরীর জুড়ে সমুদ্রের ঢেউ। আদিমতার আবেশ ওরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে। দুজনের উন্মুক্ত শরীর জেগে ওঠে ক্রমে ক্রমে।গরম লাভা ভিজিয়ে দেয় স্বাধীনতার নাভি তলদেশের কুঞ্চিত কেশদাম। গভীর রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে ওদের নিঃশ্বাসের শব্দ তীব্র হয়ে ওঠে । হাপরের মতো বুক ওঠা নামা করছে ওদের। অনেক দিন পর আজ অনাবিল আনন্দে মেতে উঠেছে ওরা দুজনে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *