ইচ্ছে পূরণ /কলমে – ছবি ব্যানার্জি

#ধারাবাহিক
ইচ্ছে পূরণ /কলমে – ছবি ব্যানার্জি
পর্ব–৪
পরের রবিবার অবনী ভেবেছিল বীথিদের বাড়ি যাবে না।দু একজন বন্ধুকে রাতে টিউশনের কথা বলে রেখেছিল। শনিবার রাতে একটা বন্ধু ফোন করে বলল–তোর জন্য আপাতত একটা সায়েন্সের স্টুডেন্ট ঠিক করে রেখেছি। সপ্তাহে দুদিনের জন্য আড়াই হাজার টাকা দেবে।আমি ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি রবিবার গিয়ে দেখা কর।আরও দু এক জায়গায় কথা বলেছি। ফোনটা রাখতেই দি ভাইয়ের ফোন।বলল–কিরে একবারে ডুমুরের ফুল হয়ে গেলি যে।কাল সকালে চটপট চলে আয়।কাল মা নিজে রান্না করবে। কাল আমাদের বাড়িতে ইলিশ উৎসব।ইলিশ ভাপা,ইলিশের মাথা দিয়ে ছ্যাঁচড়া ইলিশের টক আর ইলিশ ভাজা।তোর বিতান দা কাল জোড়া ইলিশ আনবে।

অবনী ফোনটা ধরে কিছুক্ষণ ভাবল।একদিকে দু সপ্তাহ পরে বিথীর সংগে সারাদিন কাটানোর হাতছানি অন্য দিকে আড়াই হাজারের টিউশনি। শ্রাবণী বলল–কি রে কথা বলছিস না কেন?অবনী বলল–দিভাই কাল দুপুরে যেতে পারব না রে।একটা এমারজেন্সি কাজ আছে।– তোর আবার এমারজেন্সি কি কাজ পড়ল শুনি?–সে আছে একটা।–ঠিক আছে তাহলে সন্ধ্যের সময় আয়।তোর জন্যে সব থাকবে।ইলিশ ভাজাটা আমরা না হয় রাতে খাব।

ঠিকানা মতো বেলা এগারোটার সময় ছাত্রের বাড়ি গিয়ে কলিং বেল বাজালো।ছাত্রের সংগে তার বাবা মার সংগে পরিচয় হল।ছাত্রের বাবা বললেন–আমার ছেলে সোহম ক্লাস নাইনে পড়ে।স্যালারি নিশ্চয়ই জেনেছেন। শুধু ম্যাথামেটিক্সটা দেখানোর কথা আপনার।কিন্তু আপনি যদি একটু টাইম বেশি নিয়ে ফিজিক্স কেমিস্ট্রিটা ও পড়ান তাহলে আপনাকে সারে তিন হাজার দিতে পারি।ওর রেজাল্ট ভালো হলে আপনিই বরাবর পড়াবেন।অবনী মনে মনে ভাবল ওই দুটো সাবজেক্টের জন্য আলাদা টিউটর দিলে ওনাকে আরও আড়াই হাজার টাকা খরচ করতে হত। ছাত্রের রেজাল্টের ওপর তার টিউশন টিকে থাকারও একটা ব্যাপার আছে। যাকগে এক জায়গায় পড়িয়ে সারে তিন হাজারের অঙ্কটাও কম নয়।অবনী বলল–ঠিক আছে আমি দু ঘন্টা পড়াব।আমি কাল সন্ধ্যে সাতটার সময় আসব।

বাড়ি ফিরতে একটা বেজে গেল।তার ফ্ল্যাটটা ফার্নিসড ফ্ল্যাট।সে দিনে অফিস ক্যান্টিনে খায়।রাতে অনলাইনে খাবার আনিয়ে খাই।রবিবার দিনটা নিজেই ডিমের ঝোল বা সব রকম সবজি দিয়ে ডাল আলুভাজা খায়।একবারে দু বেলার রান্না করে রাখে।কয়েক মাস ধরে দি ভাইয়ের দৌলতে ভালোমন্দ খেতে পাচ্ছে।আজ দিব্যি দুপুরে খেতে যাওয়াই যেত।কেন যে যাবে না বলল। খিদেতে নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়ে যাচ্ছে।চারটে বিস্কুট খেয়ে কুকারে আলু সেদ্ধ ভাত বসিয়ে দিল। একটা ডিমের ওমলেট করে নিলেই হবে।মা আসার আগে গাওয়া ঘি আর আচার দিয়েছিল। খিদের মুখে আগুন গরম ভাত ঘি আলু সেদ্ধ ডিমের ওমলেট আর শেষ পাতে মায়ের বানানো আচার খেয়ে মনে হল আহা অমৃত অমৃত। কোথায় লাগে ইলিশ মাছ ভালোমন্দ রান্না।

ভাত ঘুম দিয়ে উঠতেই সন্ধ্যে সারে সাতটা বেজে গেল।ইস্ পাক্কা তিন ঘন্টা সে ঘুমিয়েছে।ফোনটা খুলে দেখল দি ভাইয়ের পাঁচটা মিস কল।চট করে ফোন ব্যাক করে অবনী বলল–দিভাই সরি।জোর ঘুম ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম রে।আমি এক্ষুনি আসছি।গিয়ে আগে কফি খাব।সেই যাওয়াটাই যে তার কাল হবে কে জানত।মুহুর্তের ভুলের মাশুল তাকে সারাজীবন বইতে হবে সেটাই বা কে জানত।

অবনী যখন ও বাড়িতে ঢুকল তখন সন্ধ্যে সারে আটটা বেজে গেছে।বীথি একবার আগুন চোখে তার দিকে তাকালো।শ্রাবণী বলল–যা হোক ঘুম বটে তোর।আমি তো চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম।যাকগে কফি না চা খাবি?–আচ্ছা চা ই কর।ওরা তো দুই ভাই তোর জন্যে অপেক্ষা করে এইমাত্র বেরিয়ে গেল।তুই বরং বীথির সংগে গল্প কর।

বীথি চা খেতে খেতে বলল–কি এমন রাজ কাজ ছিল তোমার?একে তো দুসপ্তাহ পর দেখা। আমি তোমাকে খুব মিস করছিলাম।ফোন করতে গিয়েও করিনি।অবনী বলল–করলেই পারতে। –করলে তো তুমি একগাদা জ্ঞান উপদেশ দিতে।– আর দেব না। বাড়ি গিয়ে আমিও তোমাকে ফোন করার কথা ভেবেছিলাম।আমার মনও ভালো ছিল না।একটু সমস্যায় ছিলাম।বীথি বলল–আমার জন্য মনখারাপ না আমাকে নিয়ে সমস্যা?

শ্রাবণী ঘরে এসে বলল–তুই ভাত খাবি তো?বিরাট মেঘ করেছে। মনে হচ্ছে ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি নামবে।বলতে না বলতেই দু চার ফোঁটা বৃষ্টির পর দাপিয়ে ঝড় উঠল।শ্রাবণী বলল– ওপরে সব দরজা জানালা হাট করে খোলা।টুবাই তুই আর বীথি চটপট ওপরের সব দরজা জানালা বন্ধ করে দিয়ে আয়।বাব্বা ঝড়ের কি আওয়াজ।দরজা জানালা যেন ভেঙে পড়ছে।এতক্ষণে ধুলোয় সব ভর্তি হয়ে গেল।আমি নীচের গুলো বন্ধ করছি।জাহাজের মতো বাড়িতে কি কম দরজা জানালা?

ততক্ষণে অবনী আর বীথি দুরদার করে চলে গিয়ে দরজা জানালা বন্ধ করতে শুরু করেছে।বীথির ঘরের দরজা জানলা বন্ধ করে সবে নীচে নেমে আসবে এমন সময় কান ফাটানো মেঘের আওয়াজ। কোথাও মনে হয় বাজ পড়ল। তার সংগে লোডশেডিং।বীথি চমকে উঠে অবনীকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল। দুজনেই কিছুক্ষণের জন্য স্থান কাল নীতি সব ভুলে গেল। মুহূর্তের উত্তেজনায় দুটো শরীর মিলিত হল।শেষ মুহুর্তে অবনী কিছু বলতে যাচ্ছিল।বীথি ঠোঁট দিয়ে অবনীর ঠোঁট চেপে ধরল।

কিছুক্ষণ পর দুজনের সম্বিত ফিরল।অবনী বলল–বীথি যা হল ভালো হল না। আমাদের সংযত হওয়া উচিত ছিল।তুমি পোশাক পরে নাও আমি আসছি।নীচে থেকে শ্রাবণী চিৎকার করে বলল–তোরা মোবাইল জ্বেলে সাবধানে নীচে আয়।এত দেরি হচ্ছে কেন?

নীচে নামতেই শ্রাবণী বলল–তোদের সংগে তো মোবাইল ছিল।এত দেরি হল কেন?বীথি পিছন পিছন এসে বলল—বৌদি ছোড়দার ঘরের ছিটকিনি লাগছিল না।বীথি মনে মনে বলল–বৌদি কি সন্দেহ করছে? হে ভগবান কারেন্টটা আর কিছুক্ষণ বন্ধ থাক।

শ্রাবণী বলল–আমি বরং খিচুড়ি বসিয়ে দিই।বীথি তুই একবার বাবা মাকে জিজ্ঞেস করে আয় তো বাবা মা খিচুড়ি খাবে কিনা।অনুরাধা বলল–বৌমা আগে কারেন্ট আসতে দাও।আমরা খিচুড়িই খাব।বৃষ্টি ধরার তো নাম নেই। ছেলে দুটো কি ছাতা নিয়ে গেছে?–না মা।ভাববেন না।ওরা ঠিক ছাতা জোগাড় করে নেবে।আমি ফোন করেছিলাম।–মনে হচ্ছে সারারাত বৃষ্টি হবে।অবনী তুমি বরং আজ রাতটা থেকেই যাও।

অবনী বলল–বৃষ্টি ধরে যাবে কাকিমা।আমাকে ফিরতেই হবে।খেতে বসে অবনীর সব কিছু বিস্বাদ লাগছিল।ভীষণ অপরাধ বোধে ভেতরটা ছিঁড়েখুঁড়ে যাচ্ছিল। বীথির আগ্রাসী আহ্বানের কাছে নিজেকে সে সংযত রাখতে পারেনি।দমকা ঝড়ের মতো তার এতদিনের সংযম লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল।বাড়ির কারোর দিকে সে চোখ তুলে তাকাতে পারছিল না।

শ্রাবণী বলল–কি রে টুবাই কিছু খাচ্ছিস না কেন?খেতে বসে তো অন্য সময় রাজ্যের গল্পের ঝাঁপি খুলে বসিস।খিচুড়ি ভালো হয়নি?আর একটা মাছ ভাজা নিবি?অবনী চমকে উঠে জোর করে মুখে হাসি এনে বলল– না না আর কিছু নেব না দিভাই।এই তো খাচ্ছি। কাকিমার ইলিশ ভাপাটা দারুণ হয়েছে।

–আসলে আজ আমার মনটা খারাপ। বাবার ফোনে শুনলাম শরিকি বাড়ি নিয়ে একটু ঝামেলা চলছে।শ্রাবণী বলল–ও তাই বল।কিন্ত বহুদিন আগেই তো সবার হেঁশেল আলাদা হয়ে গেছে।–এখন সবাই নিজের নিজের অংশ দলিল করে পার্টিশন করতে চাইছে।–তা তুই এত ভেবে কি করবি?বড়রা আছেন তো?

অবনী মনে মনে বলল-এই মুহূর্তে কথাটা না বললে পরিবেশ স্বাভাবিক হত না।আর কথাটা পনেরো আনা সত্যি।বেশ কবছর ধরে এটা নিয়ে টুকটাক গন্ডগোল লেগেই আছে।

বিতান বলল–আজকের রাতটা থেকেই যাও শালাবাবু।খাওয়ার পর একহাত ক্যারাম কিংবা তাস খেলা হবে কাল এখান থেকে খেয়েই অফিস যেও।অবনী বলল–আর একদিন হবে বিতান দা।বৃষ্টি ধরে এসেছে।

ক্রমশ—

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *