ধারাবাহিক উপন্যাসিকা ****** কলমে ছন্দা চট্টোপাধ্যায় ****** কিছু কথা।

ধারাবাহিক উপন্যাসিকা
কলমে ছন্দা চট্টোপাধ্যায়
কিছু কথা।
পর্ব-৩।

খুকুর কথা।
আমি খুকু। ভালো নাম কেকা। একটু আগে দিদি ফোন করেছিলো। এ কী শুনলাম আমি? দীপ শেষ হয়ে যাচ্ছে? আমার মায়ের কোলপোঁছা সেই দীপ!দীপু, দীপাঞ্জন! আমি আর দিদি ছিলাম যার জননীর প্রতিনিধি, অতি ছোট ছোট দিদি।কী ভীষণ ভালোবাসতাম আমরা ছোট্ট পুতুলের মতো ভাইটাকে। দিদি ছিলো রাঙাদি, আমি মিষ্টিদি।আধো আধো স্বরে ডাকতো -‘নানাদি, মিত্তিদি’-।সারাদিন দিদির ট্যাঁকে ঘুরতো। আমি কিনা বড্ডো রোগা, কমজোরি, কোলে নিতাম বসে বসে। ভাইটা বেশ মোটাসোটা তো। একবার পড়ে গিয়ে মাথা ফাটালো।কী রক্ত!কী রক্ত!! আমি নিজের মাথা ঠুকে দেখছিলাম কতটা ব্যাথা পেয়েছে দীপ।সেই দীপ আজ মৃত্যুপথযাত্রী!আমাকে একটা খবরও দিলোনা কেউ! অবশ্য দেবেই বা কেন? আমি তো গলার কাঁটা ছিলাম বাবা মায়ের। না ছিলো রূপ, না ছিলাম লেখাপড়ায় ভালো। দিদি সুন্দরী,দিদি পড়াশোনায় ভালো। দিদি সভ্য। আমার মতো উড়নচণ্ডী,পাড়াবেড়ানি নয়। দিদিকে এক দেখায় অভিজাত পাত্রপক্ষ পছন্দ করে নিয়ে গেলো।জামাইবাবু কেন্দ্রিয় সরকারী চাকুরে, গেজেটেড অফিসার। দিদির বিয়েতে কতো নতুন শাড়ি গয়না। আমাকে মা দিলোনা। গাছে চড়তে গিয়ে ছিঁড়ে ফেলব কিনা, তাই। কোনমতে হায়ার সেকেণ্ডারী পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়েছি। বনগাঁ থেকে আসতো সুভাষ। চাষি পরিবারের চাষাড়ে সুভাষ আমার চোখে আলোর ঝলকানি দেখতে পেলো। ওর চোখে দেখলাম রামধনু। আমার অবহেলিত বর্ণহীন জীবন সাত রঙে রঙিন হয়ে গেলো।পারিবারিক সংস্কৃতিতে মেলেনি,জাতে মেলেনি। তবে আমি বুঝেছিলাম-প্রেম এসেছিলো নিঃশব্দ চরণে।আমাদের মোটা চালের ভাতডালের সংসারে তাই সচ্ছলতা না থাকলেও স্বাচ্ছন্দ্য ছিলো।এখনো আছে।দাদা তখন প্রফেসারি করে।কলেজের প্রিন্সিপালের মেয়েকে বিয়ে করে তারও হাই স্ট্যাটাস।মা বাবাও সেই উচ্চতার কাছে দীনহীন।শুধু দিদি জামাইবাবুই তার মর্যাদার যোগ্য।দাদার বিয়েতে আমি শুধু বৌভাতের নিমণ্ত্রণ পত্র পেয়েছিলাম।যাওয়া হয়নি। আমার চাষা শ্বশুর, চাষির ছেলে বর আমাকে একটা ভালো শাড়ি, একটা কানের দুল কেন,একটা নাকছাবিও দিতে পারেনি। অভিজাত বাড়ির মেয়ে বলে পরিচয় দেবার যোগ্যতা হারিয়েছি আমি। শুধু দীপু বৌবাজারের গোল্ডপ্লেটেড কিছু গয়না,একটা সত্যি সোনার ঝুমকো আর মুর্শিদাবাদ সিল্কের একটা শাড়ি নিয়ে যেদিন এসেছিলো, -‘মিষ্টিদি, আমার বিয়েতে যাবি তুই।এই গুলো পরে যাবি। আর এই সোনার কানপাশাটা রাখ।আমার বৌকে আশীর্বাদ করবি।’-
আমার সোনা ভাই। না করতে পারিনি। তবু না গেলেই ভালো করতাম।মা ছোট বৌমার মুখ দেখে দিলো খাঁটি সোনার আটগাছা চুড়ি, নিজের বিয়েয় দিদিমার থেকে পাওয়া।বৌদিকে দিয়েছিলো রতনচূড়,দিদির বিয়ে দিয়েছিলো ষোলো ভরি গয়নায় গা সাজিয়ে। বড়লোক বেয়াইবাড়ির মান রাখতে হবে তো!শুধু আমিই বরের বাড়ি গিয়েছিলাম ঝুটো মুক্তোর মালা,ইমিটেশন দুল, কাঁচের চুড়ি আর ছাপা পাটের চকচকে শাড়ি পড়ে। আমার বারোমেসে সোনার কানের রিংটা, আঙটিটাও খুলে মাকে ফেরত দিয়েছিলাম। যে অলঙ্কারে মায়ের আশীর্বাদ নেই তা আমার কাছে মূল্যহীন। বৌদি দীপুর বৌকে দিলো মান্তাসা,দিদি দিলো প্রায় তিন ভরির লকেটহার।আমি শ্রীলাকে কানপাশাটা দিতেই মা জিজ্ঞেস করলো-‘কোথায় পেলি?-‘ দীপু বলে উঠলো -‘মিষ্টিদির শাশুড়ি দিয়েছেন’-। এই হচ্ছে আমার ভাই। আমার দিদিটাও খুব ভালো। আর শ্রীলা?হেলাগোলা মেয়েটা আমাকে কী করে এতো ভালোবাসলো কে জানে!সে কী দীপুর শিক্ষায়!অথচ আমার নিজের মা আর বৌদি আমাকে নিয়ে কতো লজ্জিত। আমি পালিয়ে বিয়ে করেছি, আমার শ্বশুরবাড়ি অশিক্ষিত চাষা,আমার বর গাঁইয়া বলে কতো দুঃখ করে চোখের জল ফেলেছে শ্রীলার দাদা দিদিদের কাছে। তারা আমাকে কেন শ্রদ্ধা করবে? কেন করুণা ও ঘৃণার চোখে দেখবেনা? কেন নমস্কারিতে সস্তা রঙচঙে সিন্থেটিক শাড়ি দেবেনা?কেন আমার সঙ্গে আমার ভাইয়ের দূরত্ব তৈরী করবে না? তবু তো দীপু শ্রীলা মাঝেমধ্যে আমার মাটির দাওয়ায় বসে মোটা লাল চালের ভাত কলমি শাক, আর পুকুরের মাছের ঝোল খেতে যেতো। সেই ভাই আমার দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত, আমি খবর পাচ্ছি শেষ সময়! হায় ঈশ্বর!

ক্রমশ:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *