গান্ধীর অ-হিংসবাদ এবং বিপরীতে সুভাষচন্দ্র বসু ******* দুলাল কাটারী

গান্ধীর অ-হিংসবাদ এবং বিপরীতে সুভাষচন্দ্র বসু

দুলাল কাটারী

ভারতীয় উপমহাদেশের দুই মহানায়কের একজন জাতিরজনক মহাত্মা গান্ধি আর অন্য জন রিয়েল হিরো নেতাজি সুভাসচন্দ্র বসু। এই দুইজনের রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনা পর্যালোচনার এই পর্বের প্রথমেই বলে রাখি এই দুই মহান নেতার গন্তব্য ছিলো একই ;তা হলো ভারতমাতার স্বাধীনতা কিন্তু পথটা ছিলো অনেকটাই আলাদা।দুজনের মধ্যেই ছিলো অগাধ দেশপ্রেম। দুজনেই ছিলেন ভারতবাসীর রক্ষা কর্তা তাই দুজনেই ভারতীয়দের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন চিরস্থায়ী ভাবে। তবুও আজকের দিনে যদি আমরা রাজনৈতিক বিচার বিশ্লেষণের আসরে গান্ধিজি ও নেতাজির রাজনৈতিক বিচক্ষণতার কথা একসঙ্গে উপস্থিত করি তাহলে তর্কবিতর্কের মাত্রা অতিক্রম করে হাতাহাতি একটা খন্ড যুদ্ধও হয়তো হয়ে যাবে বিশ্লেষকদের মধ্যে,কারণ ভারতমাতার স্বাধীনতার এই বৃহৎ পর্বটিতে গান্ধিজি এবং নেতাজি দুজনেই সর্ববৃহৎ সময় উপস্থিত ছিলেন এবং সেই সময়কালে দুজনের মধ্যে নানা মতপার্থক্য চরমতম পর্যায়ে পৌঁছাতে দেখা যায়, যার ফল ছিলো সুদূরপ্রসারী।
* ১.নেতাজির কংগ্রেসে ইস্তফা দেওয়া। ২. ভগৎ সিং,শুকদেব, রাজগুরুর ফাঁসি। ৩.গান্ধিজির এক-একটা আন্দোলনের অমীমাংসিত পর্যায়েই তার প্রত্যাহার ধ্বনি তোলা
৩. গান্ধিজির একের পর এক অনশন ৪.এবং শেষ জীবনে মৌনতার জীবন যাপন ৫.প্রতিটি আন্দোলনে সরকারের পক্ষ থেকে রক্তমাখা হিংস্রতা উপহার হিসেবে পাওয়া।
৬.যে সরকার কথার চেয়ে গুলি চালায় বেশি তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা প্রতিরোধে অহিংস সত্যাগ্রহ কতটা দরকারী বা হিংসার পথ অবলম্বনেই বা কতটা লাভ হবে জাতির। ৭. আর কেনইবা বলা হচ্ছে যে গান্ধিবাদ হলো পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে ভয়ানক হাতিয়ার।
– এই সব দিক বিচার করতে গেলে আগে যে দিক গুলিতে আমাদের আলোকপাত করতে হবে তা হলো **সমকালীন উপমহাদেশীয় সমাজচেতনা,রাজনৈতিক চেতনা এবং গান্ধিজি ও নেতাজির রাজনৈতিক চিন্তা চেতনা এবং ওনাদের দুজনের চিন্তা চেতনার রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্ম নৈতিক,জাতি গত এবং অর্থনৈতিক প্রয়োগের প্রাসঙ্গিকতা।
ব্রিটিশোত্তর ভারতের ছবিটা আমরা যদি একটু অনুসরণ করি তাহলে দেখতে পাবো যে সাড়া ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে বেশ কিছু স্বতন্ত্র রাজ্যের অস্তিত্ব ছিলো এবং সেই রাজ্য গুলির রাজা, সামন্ত, বা রাজকর্মচারীরা জনগণকে এক গভীর অন্ধকারে ডুবিয়ে রেখে নির্মম শাসনতন্ত্র কায়েম করে রেখে ছিলো। তাই একথা সকলেই জানে যে জনগণ দেশীয় শাসনেও খুব একটা ভালো ছিলো না বরং বেশ কিছু ক্ষেত্রে মধ্যযুগিয়ো বর্বরতা প্রকট রূপ ধারণ করে। মানুষ না পেতো বিচার, না পেতো বাকস্বাধীনতা, রাজার ইচ্ছাই শেষ ইচ্ছা ছিলো।বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভূমি পর্যায়ের সমস্যা গুলোতে স্থানীয় শাসনকর্তারাই নিজের মতো বিচার পরিচালনা করতো সুতরাং এটা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে প্রভাবশালীদের অত্যাচারের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত ছিলো। তথাকথিত স্বাধীনতা বলতে যেটা বুঝি তার নূন্যতমও ছিলো না।
***তাই যাদের জীবন মাত্র কয়েকজন রাজা বা সামন্ত চালিয়ে এসেছে এতো দিন তারা আজ একটা দেশ চালানোর দায়িত্ব কিভাবে নেবে? আবার যদি ভারতীয় উপমহাদেশে রাজতন্ত্র ফিরে আসে তার ভবিষ্যৎ কিইবা হবে?এতো বড়ো একটা দেশ কে চালাবে? কে কার তত্বাবধানে থাকবে? কবি গুরুর সেই মহান আদর্শ ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে ‘ সেটা প্রতিষ্ঠা পাবে তো? নতুন শাসকের ‘That government is the best which governs the least’ এই কথাটা হৃদয়স্থ হবে তো?
প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতাকে এক বৃহৎ বটবৃক্ষের সঙ্গে তুলনা করলে দেশবাসী হলো তার ভূমি ভিত্তি স্বরূপ।এই ভূমি যদি মজবুত না হয় তাহলে সেখানে স্বাধীনতার ফসল ফলা সম্ভব নয়।এটা স্বামীজি, গান্ধিজি, নেতাজি সকলেই মনে প্রানে উপলব্ধি করে ছিলেন।
ভারতীয় রাজনীতিতে গান্ধিজির সম্পূর্ণ পদার্পণের আগে পর্যন্ত অধিকার প্রতিষ্ঠার দুটি উপায় ছিলো জনগণের হাতে তা হলো—
১. সাংবিধানিক প্রদ্ধতি অর্থাৎ শাসনতন্ত্রে অংশ গ্রহন করে কোনো বিলে সম্মতি বা অসম্মতি দেওয়ার মাধ্যমে নিজ অধিকার সুদৃঢ় করা। কিন্তু এক্ষেত্রে অসুবিধা হলো ব্রিটিশ শক্তি সাংবিধানিক পদ গুলো অধিকার করে আগে থেকেই বসে আছে তাই সংখ্যা গরিষ্ঠের বিচারে তাদের মতামতই প্রাধান্য পাচ্ছে।
২.দ্বিতীয়টি হলো আন্দোলন বা বিদ্রোহ অর্থাৎ মিছিল, মিটিং, ঢিল ছোড়া, পাথর ছোড়া,তীর ধনুক বা কিছু ক্ষেত্রে গোলাগুলিও চলত ইত্যাদি ইত্যাদি।
**#গান্ধিবাদ পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে ভয়ানক হাতিয়ার।
গান্ধিজির সত্যাগ্রহ হলো এক চরম মানসিক এক্সারসাইজের প্রতিফলন। যায় প্রভাবে গান্ধি পেয়েছিলেন ফুলের মতো কোমল এবং পাথরের মতো কঠিন এক হৃদয়। এই সত্যাগ্রহের মাধ্যমে গান্ধিজি মানুষকে সত্যের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারা যায় এটা বোঝাতে চেয়েছিলেন। তিনি মানুষকে বোঝাতে চেষ্টা করেন যে চরম সত্য কি, সেটা কেউই (সে সরকারই হোক আর জনগণই হোক) জানে না বা জানা সম্ভব নয়।কোনো সরকার;সে দেশীয় সরকার বা বিদেশি সরকার যে-ই হোক না কেন, সেই সরকার যখন তার দেশের মানুষের উপর কোনো আইন প্রনয়ন করে তখন সেই আইনের চরম তাৎপর্য, চরম প্রয়োজনীয়তা,চরম সত্যতা সেটা সরকারের পক্ষেও জানা সম্ভব নয় আর জনসাধারণেরও সেই চরম সত্যতা জানা সম্ভব নয় অর্থাৎ যে উদ্দেশ্য আইনটি প্রনয়ন করা হচ্ছে একমাত্র সেই উদ্দেশ্যটিই যে সঠিক বা সত্য উদ্দেশ্য সেটা বলা যায় না। আবার অন্যদিকে যদি এই আইনের কিছু বিরূপভাবকে সামনে রেখে জনসাধারণ আন্দোলনের পথে চলে তাহলে তাদের ( জনসাধারণের) উদ্দেশ্যটিও যে একমাত্র সঠিক বা সত্য সেটাও বলা যায় না। সুতরাং সহজ সরল ভাষায় বলতে গেলে বলা যায় সবকিছুই আপেক্ষিক। এবং এই আপেক্ষিকতার ভিত্তিতেই সরকার কোনো একটা আইন প্রনয়ন করে থাকে সাধারণত নিজের সুবিধার কথা ভেবেই অথবা জনসাধারণের একাংশের সুবিধার কথা ভেবে। ‘জনসাধারণের একাংশের সুবিধার কথা ভেবে’ এই কথাটা বললাম তার কারণ, এখানে একটা কথা স্পষ্ট করতে চাই যে, কোনো একটা আইনের প্রয়োজনীয়তা তখনই দেখা দেয় যখন কিছু জনসাধারণকে একটি নির্দিষ্ট দিকে তথাকথিত শৃঙ্খলা পরায়ণ করার প্রয়োজন মনে করে সরকার। ‘তথাকথিত শৃঙ্খলা পরায়ণ’ কথাটি বললাম তার কারণ সরকার যেটাকে ভাবছে আইনের আওতায় এনে সমাজে আইনের শাসন চালু করতে বা জনগণকে শৃঙ্খলা পরায়ণ করতে সেই আইনটির চরম প্রাসঙ্গিকতা, চরম সত্যতা, চরম প্রয়োজনীয়তা কোনটাই সরকারের পক্ষে বা জনগণের পক্ষে জানা সম্ভব নয়।সহজ সরল কথায় বলতে গেলে যেটাকে সরকার ভাবছে আইনের শাসন সেটা হয়তো জনসাধারণের চোখে নির্মম জুলুমের প্রয়োগ।
প্রাসঙ্গিক ভাবেই একথা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, যে মানুষ গুলি কে শৃঙ্খলা পরায়ণ করতে চাওয়া হলো তাদের মধ্যে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে না এটা কেউ বলতে পারবে না। সুতরাং সহজ করে বলতে গেলে একথা বলতে হয় যে আইনের প্রয়োজনীয়তা এবং তার প্রয়োগ আলোচনা করতে গেলে দেখা যায় কারো একটা বিরুদ্ধ আচরণ করা হচ্ছে সরকারের দিক থেকে। কিন্তু আমি একটু আগেই বললাম যে চরম সত্যি বলে কিছু যদি থাকে তবে সেটা চিরকাল অধরাই থাকবে।আমাদের চিরকালই চেষ্টা থাকবে সত্যের কাছাকাছি পৌছানোর।এযেন এক আধ্যাত্ম চেতনার সঙ্গে রাজনৈতিক চেতনার সমাপতিত অবস্থা। প্রকৃতপক্ষে গান্ধিজির আধ্যাত্মিক সাধনার দিকটি বিচার করলে সেটাই স্পষ্ট হয়।
সুতরাং আইন প্রনয়নের দিকটা বিচার করলে এটা ধরে নিতেই হচ্ছে যে সরকার হয়তো বাহু বলে একটা অংশ কে দমন করলো।তখন ঐ দমন করা অংশ যে আন্দোলনের পথে চলবে সে আন্দোলনের চরম প্রয়োজনীয়তা বা চরম উদ্দেশ্য, এককথায় চরম সত্যতা কতটা, সেটা আন্দোলকারীদের পক্ষেও জানা সম্ভব নয়।
##তাই এক কথায় বলা যায় আমরা যে ইচ্ছে প্রকাশ করে আন্দোলনে নেমেছি সেটাই যে চরম সত্য এটা নাও হতে পারে। তাই আমাদেরকে নিরস্ত্র ভাবে, অহিংসার পথে আন্দোলন করতে হবে। যদি আইনটিতে কোনো অসহিষ্ণুতা আছে বলে জনসাধারণের মনে হয় তাহলে জনসাধারণ শুধু সরকারকে এই বিষয়ে অবগত করে অবিচলতার সঙ্গে জানাতে থাকবে যে সরকারের প্রনয়ণ করা আইনটি তাদের জন্য দুর্দশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই গান্ধি মর্মে মর্মে অনুভব করেছিলেন যে শাসক যে পথে চলে আর শাসিত যে পথে চলে সেই দুটো পথেরই চরম সত্যতা কিছু নেই। তাই যেখানে চরম সত্যতা কিছু নেই তাহলে তাকে প্রতিষ্ঠার জন্য শাসন বা শাসিতের উভয়পক্ষেরই চরম সহনশীলতা পালনে ব্রতী হতে হবে। আর এই ভাবনা থেকেই শাসক এবং শাসিত উভয়েই সত্যের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারে। আর এখানেই গান্ধির রাজনৈতিক আধ্যাত্মবাদের প্রাসঙ্গিকতা অনেকটা বেশি।

গান্ধি হলো জাতির জনক এবং গান্ধির জন্ম হয় ভারতীয় সমাজ চেতনার উপর ভিত্তি করে এবং গান্ধি মহাত্মাতে পরিনত হন শুধু মাত্র ভারতীয় জাতির ধ্যান ধারণার উপর ভিত্তি করে তাই নয় পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদের প্রবল প্রতিরোধের এক অপরাজেয় অস্ত্র তৈরির মধ্য দিয়ে। জাতি কিভাবে শাসকের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে আয়ত্ত করবে বা জাতির নতুন শাসক কতটা নমনীয় ও সহনশীল হবে এই নিয়ে গান্ধি বিচলিত ছিলেন।এই প্রসঙ্গে একথা উল্লেখ করতে বাধ্য হচ্ছি যে আজকের দিনেও আমার এই রাজনৈতিক দূর্বলতার স্বীকার হচ্ছি। আমার খুল্লাম খুল্লা ভাবে রাজনৈতিক আলোচনা করতে পারিনা। কোনো রাজনৈতিক নেতার দূর্নীতি বা অত্যাচারের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারি না।গনতন্ত্রের একটা বড়ো ভূমিকা পালনকারী হিসেবে আমরা যে বিরোধী দলের কথা ভাবি সেও কিন্তু শাসকের চোখে চোখ রেখে কথা বলে না বা বলবার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে না মিডিয়ার সামনে ইসু খোঁজার রাজনীতি করে বা লোক দেখানো রাজনীতি করে ভোট চাওয়ার রাজনীতি করে।অথচ আজ শাসকের অত্যাচারের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য পৃথিবীর বৃহত্তম সংবিধান আছে বিরোধীদের হাতে। এটাতে কোনো দিন স্পষ্ট হয় না জনগণের কি করনীয়। এতে লোক আরো বিভ্রান্তিতে পরে। সেখানে গান্ধি একটা আইকন।বিদেশি শাসকের চোখে চোখ রেখে কথা বলার ক্ষমতা ছিলো তাঁর।

***এখন যদি এই দিকটা একটুখানি বিচার করে দেখি যে, ভারতীয় রাজন্য বর্গ যে যুদ্ধ বা প্রতিরক্ষায় পারদর্শী ছিলো না সেটা বলাও ভুল হবে কারণ ততকালীন ভারতীয় রাজার হরহামেশাই নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতেন।এবং মুঘলরা তো খুব দক্ষতার সঙ্গেই যুদ্ধ জয়ের মধ্য দিয়েই ভারতে শাসনতন্ত্র কায়েম করেছিলো। তবুও শুধুমাত্র ভারত নয় সারাবিশ্বেই( এশিয়া, আফ্রিকা, আমেরিকার) ইউরোপ মহাদেশর কয়েকটি দেশ তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার কেন করতে পেরেছিলো সেটা কমবেশি সকলকেই জানা। সুতরাং ভারত যে পরাধীনতার স্বীকার হয়েছিলো সেটা কোনো অযৌক্তিক বিষয় নয়। বরং এটা বলা যায় যে পরাধীনতার সুদূরপ্রসারী ফল হিসেবে ভারত থেকে ততকালীন রাজতন্ত্র উৎখাত হয়।
যাইহোক আমরা যেখানে ছিলাম সেটা হলো ভারতবাসী নিজেরা কতটা স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত সেই আলোচনায়।এই রকম একটা শত বিভক্ত জাতি কে একই মানসিকতার আওতায় এনে, একই আইনের পোষাক পরানো খুব জটিল কাজ বলার থেকে অসম্ভব কাজ বলা’ই বরং শ্রেয় হবে; এবং শেষ পর্যন্ত সেটা অসম্ভবই হলো। দেশ ভাগ এবং সামপ্রদায়িক দাঙ্গা এটাই প্রমান করে যে ভারতীয়দের একসূত্রের বন্ধনে বাঁধা সম্ভব নয়। কারণ এই ভারতীয় উপমহাদেশ কুসংস্কার আচ্ছন্ন, শত জাতির শত মতের এক আধার।এখানে সকল গোষ্ঠীর মত এক হওয়া সম্ভব নয় কিছুতেই।তবুও গান্ধির মতো নেতা বা স্বামীজির মতো সাধক এটা অনুভব করেন যে ভারতীয় দের আগে মানুষ হতে হবে। আর এখানেই গান্ধির প্রাসঙ্গিকতা অনেক বেশি। তিনি অনুভব করেন যে শিক্ষিত বা অর্ধ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ভারতীয়ের মধ্যে রাজনীতিকে সীমাবদ্ধ রাখা উচিৎ হবে না। তিনি ভারতের গ্রামীণ রাজনীতিতে জোর দেন। তিনি সেই সমস্ত মানুষকে রাজনৈতিক ভাবে চলতে বা ভাবতে শেখানো শুরু করেন যারা নিজের রাজনৈতিক মেরুদণ্ড আছে কিনা সে বিষয়ে সন্দিহান ছিলো ইতিপূর্বে। তিনি সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্ম নৈতিক, চিন্তা ভাবনা গত এবং জাতি গত শত বিভক্ত এই মানুষ গুলিকে একটি জাতিতে পরিনত করতে চেয়েছিলেন তা হলো ভারতীয়।জাতি হিসেবে আমরা সকলেই ভারতীয় এই হলো আমাদের পরিচয় আর এই জাতির জনক বা পিতা হলেন গান্ধি স্বয়ং। গান্ধি যেন তার সন্তানসন্ততির জন্য এমন একটা সমাজ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন যেখানে স্বাধীনতার পর তার সন্তানসন্ততিরা নির্দ্বিধায় হেসে খেলে, নেচে, গেয়ে, সুখে, শান্তিতে বাঁচতে পারে।
এ প্রসঙ্গে বলা যায় গান্ধি যখন এক চির অন্ধকারে ডুবে থাকা জাতি কে শাসকের বিরুদ্ধে ‘না’ বলতে শেখাচ্ছেন তখনই সুভাষের মতো নবীন রক্ত সেই চির অন্ধকারে ডুবে থাকা জাতির থেকে শাসকের বিরুদ্ধে ‘না’ শোনার জন্য ব্যকুল হয়ে উঠেছিলেন।

মানুষ যেকোনো শাসনতন্ত্রের আন্ডারেই মানুষ থাকুক না কেন সে নিজেকে স্বাধীন মনে করবে।নিজে নিজের দায়িত্ব নিতে দ্বিধাবোধ করবে না। তাছাড়া ভারতীয় সংস্কৃতি অহিংসা বা সহনশীলতার কথা বলে এসেছে দীর্ঘদিন।
মানুষ শুধুমাত্র রাজনৈতিক ভাবেই যে স্বাধীন হবে তা নয় বরং ধর্ম, জাতি,অর্থনৈতিক সবকিছুতেই নিজেকে স্বাধীন হতে হবে। আর এসবের জন্য প্রথমে ভয়মুক্ত মন ও হৃদয় গড়ে তুলতে হবে এবং সেটা নীতির উপর ভিত্তি করেই করতে হবে। ধাতু যতই কঠিন হোক সেটা একটা নির্দিষ্ট উষ্ণতায় গলতে বাধ্য। তাই শাসক যতই নিষ্ঠুর হোক আন্দোলনের লক্ষ্যটা স্থির রেখে অহিংস পথেই তার সুফল অর্জন করা সম্ভব এটা উপলব্ধি করতে হবে।

অন্যান্য নেতৃত্বমন্ডলী চাইতেন দেশবাসীকে স্বাধীনতা দিতে হবে। কিন্তু গান্ধির ভাবনায় দেশবাসীকে স্বাধীনতা দেবার ক্ষেত্রে আমি বা আমরা (নেতারা)কে? আমরা যেটা করতে চাইছি সেটা হলো ক্ষমতার হস্তান্তর ছাড়া আর কিছুই নয়।
কিন্তু দেশবাসী যদি আগে নিজের চেতনার স্বাধীনতা ঘটাতে পারে। যখন সে নিজের চেতনার স্বাধীনতা ঘটাতে পারবে তখন তাকে গোলাম করবে এমন শক্তি কারো আছে নাকি?
রাজনৈতিক ভাবে স্বাধীন হওয়ার আগে নিজেকে নৈতিক বা চেতনাগত ভাবে স্বাধীন হতে হবে। ব্রিটিশ শক্তিকে একের পর এক প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে ব্রিটিশের মুখে বারবার জুতো মেরে মেরে এটাই প্রমান করেন যে ‘তুমি’ কে আমার উপরে আইন প্রনয়ন করার ‘তুমি’ থাকো কিন্তু তোমাকে আমার কোনো দরকার নেই।
তোমার অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদের দরকার মার্কেট। কিন্তু আমি যদি মার্কেটই না দিই তাহলে তো তোমার থাকা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে। উপনিবেশবাদ সাধারণত অর্থনৈতিক মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হলেও রাজনৈতিক কর্তৃত্ব কায়েম না করা পর্যন্ত অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব বেশ ভালো করে প্রতিষ্ঠিত করা যায় না।সাম্রাজ্যবাদ যে শুধুমাত্র আমাদেরকে আর্থিকভাবে শোষণ করে তাই নয়,এই সাম্রাজ্যবাদ আমাদের দৃষ্টিকোণ, চিন্তা ভাবনা, সংস্কৃতি সবকিছুকেই গ্রাস করে। ইংরেজরা ভারতীয়দেরকে নানা ছলেবলে কলেকৌশলে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলো যে ইংরেজ শাসন তাদের জন্য মঙ্গলময়, ইংরেজ প্রতিষ্ঠিত ভারতীয়দের মনে এই বিশ্বাসের মূলে কুঠারাঘাত করেন গান্ধিজি, নেতাজি, দাদাভাই নৌরজি সকলেই।আমরা যখন পশ্চিমী লিটারেচার স্টাডি করি এবং পশ্চিমী শক্তি গুলো হিংস্রতা দেখি তখন সবচেয়ে বেশি কনফিউশানে পড়ে যায়। সেখানকার সাহিত্য মানবতার কথা বলে, উদারতার কথা বলে, রুশ বিপ্লবের কথা বলে, ফরাসী বিপ্লবের কথা বলে কিন্তু সেই পশ্চিমী শক্তি গুলির হিংস্র সাম্রাজ্যবাদের কথা পড়লে চরম নির্লজ্জতা। ভারতীয় পরম্পরার খারাপ দিক গুলির শুদ্ধতাতেও গান্ধিজি মন দেন।আমজনতার মধ্যে রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব মূলক ভাবনা আনতে চেষ্টা করেন।
শ্রীমতী অ্যানী বেসান্ত এবং তিলকের হোমরুল আন্দোলনেরও উদ্দেশ্য অনেকটা এই রকমই ছিলো।
প্রতিরক্ষা এবং বৈদেশিক নীতি ইংল্যান্ডের হাতে রেখে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে হোমরুল স্বায়ত্তশাসিত অধিকার অর্জন করা এবং সেই উদ্দেশ্যে মানব এবং মানবতাকে সংগঠিত করা।
প্রকৃতপক্ষে গান্ধি হলো শান্তির উপাসনায় মগ্ন এক সূর্যের মতো শক্তির আধার।তাঁর এই শক্তির ( শান্তির) দুশো কোটি ভাগের এক ভাগও যদি ইংরেজ শাসকের হৃদয়স্থ হতো তাহলে ইংরেজ শাসনের জঘন্যতম নির্লজ্জতা ইতিহাসের পাতাকে এতোটা কলঙ্কিত করতো না।

****এ প্রসঙ্গে বলতেই হয় যে কিছু আন্দোলন হঠাৎ করে বন্ধ করে দিয়ে তিনি পর্যবেক্ষক দের একাংশের চোখে ঘৃণার পাত্রে পরিনত হয়েছেন।দেশবাসী এবং আন্দোলনকারীরা যেন দিশেহারা হয়ে গিয়ে হতাশা এবং ক্ষোভে ফেটে পড়েছে। কিন্তু এটা বলাবাহুল্য যে সেই মূহুর্তে আন্দোলন বন্ধ না করলে স্বৈরাচারী শাসক আরো হাজার হাজার নিরীহ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিতো। এক্ষেত্রে গান্ধি যেন একদিকে জাতির রক্ষা কর্তা অন্য দিকে জাতির প্রতিপালক এই দ্বৈত ভূমিকা পালনে নিজের চরিত্র কে আরো মজবুত করেছেন।
গান্ধির মতো বৃহৎ শান্তি বৃক্ষে ভগৎ এ-র মতো পক্ষীর বাসস্থানের জন্য জায়গা হয়নি বলাটা যেমন সহজ নয় তেমনই এরকম একটা শান্তি বৃক্ষ ভগতের পছন্দের ছিল কিনা সেটাও চুল চেরা বিশ্লেষণ করতে হয়।
কয়েকজন বীর বিপ্লবীকে হয়তো বাঁচাতে পারেন নি কিন্তু কত হাজার হাজার নিরীহ দেশবাসীকে যে স্বৈরাচারী ইংরেজ শাসকের হাত থেকে আন্দোলন চলাকালীন অহিংস সত্যাগ্রহের পথে থেকে বাঁচিয়েছেন সেটাও বিচার করতে হবে। সত্যাগ্রহকে দমন করার মতো কোনো অস্ত্র পশ্চিমী শক্তি গুলোর কাছে ছিলো না।
আচ্ছা বেশ, আমরা এতোক্ষণ দেখলাম গান্ধিজি অহিংসার পূজারী এবং আমরা অনেকই মনে প্রাণে তা মেনেও নিচ্ছি কারণ আমরা জানি গান্ধিজীর অহিংসার নীতি অবলম্বন করেই নেলসন মেন্ডেলা তাঁর দেশ এবং জাতিকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন এবং নোবেল শান্তি পুরষ্কারেও ভূষিত হয়েছেন।গান্ধি অহিংসার পূজারীই যদি হয়ে থাকেন তাহলে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে ভারতীয় সৈন্যদের কেন গান্ধির নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস যুদ্ধের মতো হিংসামূলক কাজে পাঠিয়ে ইংরেজ সরকারের হয়ে যুদ্ধে অংশ গ্রহন করিয়ে হিংসার ভার নিলেন সেটা অবশ্যই গান্ধি চরিত্রে একটা প্রশ্ন চিহ্ন বয়ে বেড়াবেই।
যদিও গান্ধির অহিংস সত্যাগ্রহ ছিলো Higher weapon for self protection.তবুও ইতিহাস চিরকাল প্রশ্ন করবেই তিনি কেন ভগৎ সিং,শুকদেব, রাজগুরুর ফাঁসি আটকানো জন্য বৃহত্তর আন্দোলনের পথে নামেন নি? প্রকৃতপক্ষে এ. ভি. হিউম যে সেফটি ভালব তত্ত্বের কথা বলেন তার পরিপূর্ণতা পেয়েছিলো গন্ধিজির হাত ধরেই। তাই সরকার যে গান্ধির সঙ্গে ভালো আচরণ করবে এটা বিশেষ কোনো অবাক হওয়ার কথা নয় বরং গান্ধির নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস ইংরেজ সরকারের ঢাল স্বরূপ কাজ করেছিলো একতা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তাছাড়া গান্ধিজির মতো বিচক্ষণ নেতার এটা নিশ্চয় জানা ছিলো যে মৌর্য সাম্রাজ্যে অশোকের থেকে শুরু করে পরবর্তী শাসককে বৌদ্ধ ধর্মের অহিংস নীতি গ্রাস করে ছিলো এবং তার ফলস্বরূপ মৌর্য শাসকরা রাজ ধর্ম পালনে ব্যর্থ হয়েছিলো এবং পতন অনিবার্য হয়েছিলো কি নির্মম ভাবে। শুধু আত্মপক্ষ শান্তি চাইলেই হবে না,প্রতিপক্ষ কতটা শান্তির উপাসক সেটাও বিচার্য বিষয়। তার তাৎক্ষণিক ফল হিসাব করলে দেখা যায় ১৯৬২ সালে ভারতকে চিনের সঙ্গে মোকাবিলায় অনেক ক্ষতির সম্মুখিন হতে হয়েছে। সুতরাং ভারতীয় রাজনৈতিক চিন্তা চেতনা প্রয়োগে গান্ধিকে ভালোবাসার যেমন অনেক কারণ আছে সেই রকম গান্ধি কে ঘৃণা করারও অনেক কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেই কিন্তু গান্ধি কে উপেক্ষা করার মতো একটিও কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে না।
***সুতরাং এই ভাবনা গুলি থেকেই নেতাজির প্রাসঙ্গিকতা অনেকটা বেড়ে যাচ্ছে। গান্ধিবাদের দীর্ঘকালীন অসাড়তা, ইংরেজ শাসকের দিন দিন নির্মমতা বৃদ্ধি এবং বিশ্ব ইতিহাসে একাধিক সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন এই সকল প্রেক্ষাপটই ছিলো নেতাজির মহত্ত্বের প্রধান দিক।স্বামীজি বলেছিলেন ‘যদি বদলাতেই হয় তাহলে পথটা বদলাও লক্ষ্যটা নয়।’নেতাজি যেন তাঁর হৃদয়ের অভিযোজন ঘটিয়ে নিতে পেরেছিলেন পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি সঙ্গে।তবে পুরো কংগ্রেসকে যদি পাশে পেতেন তাহলে হয়তো রাজনৈতিক সমীকরণ অনেকটা বদলে যেতেই পারতো। শত্রুর দুর্বলতার সুযোগে স্বাধীনতার সুফল পাওয়ার যেতে পারে এই ভাবনা নিয়েই নেতাজির দেশত্যাগ করা এবং বিদেশি শক্তির সাহায্য প্রার্থনা করা।
নেতাজি প্রথম দিকে রাজনৈতিক বিচক্ষণতায় এবং মতাদর্শে গান্ধিজীর এতোটাই স্নেহের পাত্রে পরিনত হন যে পরবর্তী কংগ্রেসের প্রধান কার্যভার সুভাসচন্দ্রের হাতেই দেওয়া যেতে পারে এরকম ভাবনা গান্ধিজির মনে উদিত হয়। তবুও রাজনৈতিক মতাদর্শগত পার্থক্য যখন প্রকট হয় তখন নেতাজিকে শুধুমাত্র স্বৈরাচারী ইংরেজ সরকারের সাথেই যে লড়াই করতে হয় তা নয় জাতীয় কংগ্রেস তথা গান্ধির সঙ্গেও চরম লড়াই করতে হয়। যাইহোক নেতাজিই প্রথম গান্ধিজী কে জাতির পিতা নামে ভূষিত করেন এবং বিদেশ থেকে প্রচার করতে থাকে গান্ধিজির আদর্শ এবং যে জাতির পিতা গান্ধির মতো এক বিচক্ষণ ব্যক্তি সেই জাতির এবার পরাধীন থাকার সময় শেষ হয়ে এসেছে এটাও জাতিকে বোঝাতে চেষ্টা করেন। এপ্রসঙ্গে বলে রাখি আমরা মনে হয় গান্ধির আদর্শকে সবচেয়ে বেশি অনুধাবন ও মূল্যায়ন করতে পেরেছিলেন নেতাজি না হলে গান্ধিজি কে তিনি জাতির পিতা আখ্যায় ভূষিত করতেন না।তবে নেতাজি এটা বুঝতে পেরেছিলেন মর্মে মর্মে যে জাতির ঘুমানোর দিন এখই শেষ হওয়ার উচিৎ। এবং স্বাধীনতার জন্য মারিয়া হয়ে ওঠা উচিৎ।সেই উদ্দেশ্যেই তিনি প্রথম এতো বড়ো সেনাবাহিনী তৈরি করেন প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে বিদেশের হাতে বন্দি হওয়া ভারতীয় সেনাদেরকে নিয়ে। আন্দোলন মানেই স্রোতের বিপরীতে এগিয়ে চলা এটা আত্মস্থ করেছিলেন নেতাজি।
তবে একটা কথা বলে রাখি সাম্রাজ্যবাদের ক্ষুধা কোনো দিনও মেটে না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইংল্যান্ডের যে অর্থ ক্ষতি হয় তা ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে রাজকোষ ঘাটতি মেটানোর উদ্দেশ্যে আরো বেশি করে কঠোর ও কঠিন শাসনতান্ত্রিক প্রতিবিধানে মনোযোগ দেয় ইংল্যান্ড। যায় ফলস্বরূপ রাউলাট আইন, জালিয়ানওয়ালাবাগ ইত্যাদি ইত্যাদি। তাই বৃহত্তর আন্দোলনের পথ ছাড়া কোনো উপায় ছিলো না। রাউলাট আইনের নির্মমতা বিচার করে গান্ধিজি নিজেও বলেন ‘এই আইন গুলি এবং এই ধরনের অন্যান্য আইন আমরা ভদ্র ভাবে মেনে নিতে রাজি নয়’
‘এই আইনে উকিল নেহি, দলিল নেহি, আপিল নেহি।’
ব্রিটিশ শাসনকে তিনি ‘শয়তাবাদ’ এর পরিচায়ক বলে মন্তব্য করেন।
জালিয়ানওয়ালাবাগে জেনারেল ডায়ার পঞ্চাশটি রাইফেল থেকে গুলি শেষ না হওয়া পর্যন্ত গুলি বর্ষনের নির্দেশ দিলো এবং ঐ দিন সন্ধ্যায় সান্ধ্যআইন জারি করে আহতদের মুখে জল দেওয়ার জন্যও কাউকে গৃহের বাইরে আসতে দেয় নি।এর ফলে সভ্যতা ও সাম্রাজ্যবাদের মুখোশধারী ইংরেজ শাসনের কদর্য ও ভয়াবহ রূপটি উদঘাটিত হলে গান্ধিজি বলেন ‘এই শয়তান সরকারের সংশোধন অসম্ভব, একে ধ্বংস করতেই হবে।’
এই প্রসঙ্গে বলে রাখি নেতাজি এই ‘শয়তানবাদ’ এর ধ্বংসকর্তা রূপেই আবির্ভূত হন।স্বামীজির চেতনায় যুবসমাজকে ইস্পাত দৃঢ় পেশি শক্তি সম্পন্ন করে তুলতে আপ্রান চেষ্টা করেন নেতাজি। তিনি বারবার বুঝিয়ে দেন যে,পৃথিবীর একমাত্র সচেতন ও শক্তিশালী জাতিই স্বাধীনতা অর্জন এবং তা রক্ষা করতে পারে।
****আমাদের এই মহান ঈশ্বরের মৃত্যু আজও রহস্যময় এক সমুদ্র। এই জাতির ঈশ্বর যতদিন পৃথিবীর বুকে মানুষ থাকবে ততদিন পূজিত হবেন।নেতাজির নাম শুনলেই যেন জাতির মেরুদণ্ড সোজা হয়ে যায় স্বাধীনতার ক্ষুধা শিরায় শিরায় প্রবাহিত হতে থাকে। যিনি গান্ধিকে জাতির পিতা বলেন আজ ভারতীয় সমাজ যেন তাঁকেই জাতির পিতা মনে করেন। আজ ভারত মাতার বীর যোদ্ধাদের রক্তে যেন নেতাজির রক্তই প্রবাহিত হচ্ছে।
পৃথিবীর ইতিহাসে আজ অব্দি বিনা রক্ত পাতে কেউ স্বাধীনতা পায় নি। সেখানে গন্ধির অহিংসার নীতি কতটা ফলপ্রসূ হবে সেটা নিয়ে অনেকই সন্দিহান ছিলো। বিশেষ করে ব্রিটিশের মতো একটা হিংস্র সাম্রাজ্যবাদী শাসক যেখানে প্রতিপক্ষ সেখানে এই রকম অহিংসা নীতি নিয়ে আন্দোলন কতটা প্রাসঙ্গিক সেটা যুব সমাজের বক্ষ বিদির্ণ করা চিন্তার কারণ হয়ে প্রকট হতে থাকে আমেরিকার স্বাধীনতা লাভের বা ফরাসি বিপ্লব বা রুশ বিপ্লব এর ইতিহাস জানার পর। তবে এই রকম একটা সাম্রাজ্যবাদী সরকারের ক্ষুরধার অস্ত্রের সঙ্গে লড়াই করার জন্য ভারতের তেমন কোনো অস্ত্রও ছিলো না। একের পর এক দেশীয় রাজা তাদের সর্বশক্তি দিয়েও ইংরেজ সরকারের অস্ত্রের কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছেন।তাই গান্ধিজি মানব এবং মানবতার উপরে নির্ভর করেই স্বাধীনতা অর্জনে বা জাতির মঙ্গলে ব্রতী হয়েছিলেন।
সুতরাং গান্ধিজি এবং নেতাজি দুজনেই আজ জাতির চোখে ভগবানের পরবর্তী স্থান পেয়েছেন একথা না বলে যদি বলি যে ভগবানের আগে স্থান পেয়েছেন তাতেও অত্যুক্তি হবে না। যেমন নেতাজির মতো বড়ো আইকন আজও মেলেনি, ভবিষ্যতেও মিলবে কি না তাও সন্দেহ আছে ।তেমনই গান্ধিজির মতো আদর্শও আজও পৃথিবীতে অমিল।
নেতাজির সঙ্গে হিটলার এবং মুসোলিনির সম্পর্ক দেখে ভারতীয় রাজনীতিবিদ এবং কূটনীতিবিদদের একাংশ বিচলিত হতে পারেন একথা ভেবে যে নেতাজির হাত ধরে হয়তো একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারতো। তবে এটা নিছকই কল্পনা মাত্র কারণ নেতাজি কোনো দিন হিটলার বা মুসোলিনির আদর্শ বা নীতিগত কথা ভুলেও উচ্চারণ করেন নি। তাঁর প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিলো শত্রুর শত্রুকে আপন করে তাদের থেকে সাহায্য নিয়ে দেশ কে স্বাধীন করা। কথিত আছে প্লেন দূর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু হয়।কিন্তু ভারতবাসী আজও এই রিয়েল হিরো,জাতির রক্ষাকর্তার মৃত্যু মেনে নিতে পারেনি।তাই এই ভগবানের কোনো মৃত্যু দিবস নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *