নীল মার্বেল চোখ

রেশম লতা

আকাশে মেঘ জমে খৈ-পর্বত। এমিলা পাহাড়ের কোণ ঘেঁষে ঠেসে যাওয়া জাংতিম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। অদূরে কিছু বলাকা আস্তে করে হাওয়া ছিটিয়ে কুয়াশায় মিলিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎই দুটো পাথরকুচি কান একটা ধীর ঝর্ণার পাশবন হতে নীল ডাকে থমকে যায়। শুষ্কচুল, মাথায় ঝুপড়ি, পিঠে একগাধা বনোআখ। এক হাতে রাম’দা অপর হাতে তিনটে সাবুডাল। বয়ে যাওয়া নম্র খালের ধার গুনছে তার প্রচন্ড ক্লান্ত শরীর। খুব সতর্ক পায়ে সংযত সুরের শব্দরাগে এমিলা ঝুমপায়ে নেমে এলো পূর্বে রাখা তালখন্ডের কাছে। আর কয়েক মুহূর্ত থামুন আমি আসছি। স্রোতহীন ঢেউয়ে এমিলা এগুচ্ছে। তালখন্ড অপর পাশে থামতেই শরীরের সব দ্রব্যাদি ছুঁড়ে দিল তার উপর। হাত দুটো বাড়িয়ে নরম গালে চেপে অনুভব করুন এমি, আপনাকে পাওয়ার জন্য কি নির্মম যজ্ঞে ঠুসে যাচ্ছে আমার কোমল হাত। এ’কাজ আমার পূর্ব বংশের কেউ কখনো করবে বৈ চোখেও দেখেনি। হুকুম দেওয়ার অভ্যস্ত তর্জনী আজ হুকুমের দাস। আপনার নীল মার্বেল চোখকে ভালোবেসে কতইনা জর্জরিত হচ্ছি।_ বাবা তাঁত ব্যস্ত শেষ দিয়ে নিশ্চিত সিগপথে হাঁটা ধরবেন। আমার অপেক্ষা উনার অপেক্ষা না বাড়ায় তাই অতি শীঘ্রই চলুন। _ আপনার নিষ্ঠুরতা নিশ্চয়ই আমাকে আহত করে এমি। উঠে আসা সরু সিগপথ ক্রমশ ফুরিয়ে আসলেও তাদের মাঝে প্রেম এখনো বাসা গড়েনি। তিনটে বছর, যখন আর তিনটি বছর আগে আলাস্কান্দা পাদদেশে এমনই এক সরু পথে ভেড়ার বহর চড়িয়ে চগ্গকি ষোড়শী পবিত্র মনে চলছিল তখন সাদাগাড়ির আঘাতে রক্তাক্ত দেহ রাবার গাছে ছিটকে পড়ে। মিজোরামের সেবাশ্রমে তিনটি বছর কেটে গেছে। অপরাধবোধের দুর্বলতা বড়ই আশ্চর্য! যদি সেখানে দুটি বিপরীত লিঙ্গের অবুঝ আত্মার উপর হয় তবে দায় চোখ উথলে উঠে। উঠানামা বিবেকের কাছে তাই হেরে যায় সামুদ। দায়িত্ব আর প্রেমের টানে নিজেকে চগ্গক প্রধানের কাছে আত্মসমর্পণ করে। প্রধানের একমাত্র কন্যা হলদে বর্ণের এমিলা। এমিলা ঠিক ছুটন্ত হরিণের মত ছিল। কিন্তু আজ তার জ্যোতিহীন নীলাভ চোখ। তার ধূসর দেহ সীগবাসী দেখলেও সে আর সীগ নদী দেখতে পায় না, দেখতে পায় না প্রিয় ভেড়াগুলোকেও। প্রবল ইচ্ছে, আকাঙ্খা আর বাঁধভাঙা হৃদয়ের অবারিত প্রেমস্ফুল থাকা সত্ত্বেও, খুব কাছাকাছি হাঁটা সত্ত্বেও, নিঃশ্বাসের স্পর্শ পাওয়া সত্ত্বেও দেখতে পায়নি সামুদ নামের এই প্রথম পুরুষটাকে। এতক্ষণে চাঁদের আলোয় অবশ দেহ কাঠটুকরোয় হেলে পড়ে সামুদের। উতরানো জীবন ফেলে প্রায়শ্চিত্তের অনশনে ক্ষয়ে চলে উচ্চবংশীয় শরীর। দাম্ভিক হৃদয় স্বর্গীয় সৌন্দর্য দেখেই নত হয়। সেমপুত্রও হয়েছে। এমিলার নীল মার্বেল চোখ দেখে। হালকা কুয়াশাময় বাতাসে দুলে যায় নিন্দিফুল, সাবাস্তাঝাড়, এলনগাছ আর ভেড়ার তুলোর মতো কর্ষিত যাতনা। এমিলা নিমপায়ে রাতের খাবার নিয়ে সামুদের পাশে দাঁড়ায়। আস্তে করে ডেকে বলে_ উঠুন, খেয়ে নিন হয়ত আর কোনো রাত কিংবা দিনে এমন খাবার খেতে হবে না। এই অন্ধ এমির হাতে তৈরি রান্না কষ্ট করে চিবোতে হবে না। শর্তমতে তিনবছর অতিক্রমের পর আগামীকাল ভোরে আপনার বাবা এসে আপনাকে নিয়ে যাবেন আর আমাকে দিয়ে আসবেন চোখ সারাতে দূর একটা হাসপাতালে। তার ঠিকানা আপনাকে কিংবা আমাকেও নাকি জানানো হবে না। দুটো গাড়ি দু দিকে মোড় নিবে। হয়ত সপ্তাহখানেক লাগবে তারপর সব শান্ত। প্রধান তার মেয়েকে ঠিক আগের মতই সুস্থ পাবে। সেম ফিরে পাবে তার প্রিয় পুত্রকে। হয়ত শুনেননি আমার নীল মার্বেল নাকি কালো করে দিবে। আমি তো জাংতিম ফল পাকড় পাড়ত পারব, রাজহাঁসগুলোকে নদী অবধি ছেড়ে আসতে পারব কিন্তু আয়নায় নীল মার্বেল দেখতে পাবো না। আর পাব না আপ..। বলুন এমি আপ কি? সত্যি করে বলুন আমাকে আপনি দেখতে চান না? আমি আপনার আলোময় চোখে দেখার দৃশ্যেগুলোর টুকরো অংশও হতে পারি না? আপনার এতটা অযোগ্য আমি? মাত্র একটা ভুল, ব্রেক ফেইল। এর জন্য আমিই দায়ী কি না সেটা আপনারা পুরোপুরি না জেনেও তিনটে বছর কেটে নিয়েও কি আমাকে অপরাধীর তালিকায় রাখবেন? আমি সব জানি এমিলা, আপনি আমাকে ভালোবাসেন। সেদিন যখন আমাকে সাপে কামড়ে দিল, মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছিল তখন আধোচেতনে কেবল আপনাকেই দেখছিলাম অঝোরে কেঁদেই যাচ্ছিলেন আর বলছিলেন দোহাই তোমাদের উনাকে বাঁচাও, বাঁচাও তোমরা। ঝাপসা চোখে দেখছিলাম আপনি আপনার বাবার পায়ে পড়ে প্রচন্ত আকুতি করছিলেন সম্ভবত নিজের এক্সিডেন্টের দিনও এভাবে চিৎকার করে বলেননি আপনাকে যেন কেউ বাঁচায়। বেয়ে চলা পাহাড়ি জীবন যতই পাহাড় ছুঁয়ে আসমানে ঠেকে যাক না কেন এমিলার হৃদয়ে মাস জুড়েই বেদনার তোলপাড়। ইনলি গাছের ঝরা পাতারা যতই নিঃশব্দে সাওলিঘরের চাল ঘেঁষে শ্লথ কুয়োয় পড়ে যাচ্ছে ততই তার কালো চোখের আলো যেন প্রতিবিম্বিত হচ্ছে। কিন্তু এমিলার অজানা আকাঙ্ক্ষা আর পূর্বেকার উদ্যোম কোথাও একটা সুতো কেটে দিচ্ছে। এদিকে কাঁটা বেড়া উপ্রে শত্রুপক্ষের সঙ্গে মিত্রতা করতে প্রধানের হাতিয়ার যেন এমিলা। এমিলাকে বিয়ে দেয়ার জন্য সে কি তোড়জোড়। সন্ধ্যা তারার সাক্ষীতে ক্রমশ দিন ঘনায়। ফুল সময়ের কয়েক দিন আগে হঠাৎই সেই সাদা গাড়িটার আবির্ভাব। থামল এমিলার ঠিক সামনে যখন সে মঙ্গল কামনায় মন্দিরে যাত্রা দেয়। গাড়ি থেকে জুম পোশাকে মোড়ানো লাঠি হাতে এক সুদর্শন পুরুষ নামে আর পিছন হতে এমিলার দুটো পাথরকুচি কান নীল ডাকে থমকে যায়। সেমপুত্র? আপনার চোখ?__ আমার চোখ প্রেম আর প্রায়শ্চিত্তের দহনে চগ্গক উনবিংশীর কালো চোখের জ্যোতিতে এঁটে গেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *