“মহাভোজ” ছবিটির রিভিউ

লেখক-সমালোচক- ব্লগার দেবযানী ভট্টাচার্য

লেখক-সমালোচক- ব্লগার দেবযানী ভট্টাচার্য “মহাভোজ” ছবিটি দেখার পর এই দীর্ঘ রিভিউটি পোস্ট করেছেন তাঁর ফেসবুকের ওয়ালে:–

” মনোজ’দা’র তৈরি #মহাভোজ ফিল্মের রিভিউ যেদিন কাগজে ছেপেছিল, সেদিনই এই টাইমলাইনে পোস্ট করেছিলাম সেটি। ছবিটা দেখব নিশ্চিত ছিল, কিন্তু দেখা হয়ে ওঠে নি আজ সকাল অবধি। অতঃপর ফোনে কথা হল মনোজ’দা’র সঙ্গে, জানতে পারলাম নজরুল তীর্থ থেকে কালই চলে যাচ্ছে ছবিটা। তাই তড়িঘড়ি গেলাম, আজ বিকেল সাড়ে চারটের শো’এ।

প্রত্যাশা বড় একটা ছিল না যদিও গল্প নিয়ে সংশয়ও ছিল না, কারণ গল্প মনোজ’দা’র লেখা এবং সে লেখা যে খারাপ হবে না তা জানতাম। কিন্তু গল্প ভালো মানেই যে ফিল্ম ভালো তা নয়। তাই মুভি যখন শুরু হল, প্রথম দৃশ্য থেকেই মন ঝকঝক করে উঠল। প্রত্যাশা বেশি ছিল না বলেই হয়ত। তারপর এগোতে শুরু করল গল্প। যত এগোলো আচ্ছন্ন করল তত। ক্রমশঃ মনে পড়তে থাকল…

নির্মেদ, ঝরঝরে চেহারার এক বাংলা ছবি #মহাভোজ। বাংলার এক গ্রামে চড়কপুজো ও নীলপুজোর আবহে কাহার সম্প্রদায়ের এক লোক নগেন ও তার নাতি বাচনকে ঘিরে রূপোলী পর্দায় আঁকা হয়েছে একখানি ছবি। বাংলার গ্রামের মানুষের হৃদস্পন্দন, তাদের বিশ্বাস, জীবনবোধ, মূল্যবোধ নিয়েছে ছায়াছবির রূপ। যতক্ষণ ছবি চলবে ততক্ষণই টানটান। ছবির কোনো দৃশ্যেই নেই কোনো মেলোড্রামা বা সেনসেশনালিজম। সবই subtle, অথচ subtlety’র আর্টফিল্মসুলভ শোম্যানশিপও এতে নেই। ঠিক যেমন সাদামাটাভাবে চলে মানুষের জীবন অথচ তার মধ্যে লুকিয়ে থাকে গল্প, #মহাভোজ’ও ঠিক তেমনি। দারিদ্র্যের গল্প, খেতে না পাওয়ার গল্প, পাঁচ ছ’দিনের ভাতের জোগাড় করতে পেরে হাতে চাঁদ পাওয়ার গল্প, একপেট খিদে নিয়ে বাপ-মরা-মা-হারানো বালকের ঠাকুরদার কাছে বড় হওয়া এবং মনের ভিতরে জীবনযুদ্ধের জন্য ‘গড়ে ওঠা’র গল্প, ভয়কে জয় করার সংঘর্ষের গল্প অথচ কোত্থাও সেই দারিদ্র্য বা সংঘর্ষ নখ দাঁত বার করে মনুষ্যত্বকে হত্যা করতে উদ্যত হয় নি। দারিদ্র্য, অসহায়তার উপস্থিতি এ ছবিতে বাতাসের মত সর্বময়, অথচ মনুষ্যত্বের চাইতে বড় হয়ে ওঠেনি কখনওই।

নগেনের হাতে টাকা নেই, 100 দিনের কাজের পাওনা মজুরি তার বকেয়া পড়ে আছে সরকারের ঘরে, টাকা উপার্জনের তেমন অন্য পথও কিছু নেই। নগেন পারে ঢাক, ঢোল বাজাতে আর পারে কায়িক শ্রমের কাজ। রেশনের চাল জোগাড় করতে গেলে রেশন কার্ড করতে হয় যার জন্যেও লাগে ঘুষের টাকা আর নগেনের হাতে নেই সেই টাকাও, তাই খাদ্য সুরক্ষার রেশন কার্ডটিও তার নেই। কে কাকে ভোট দিয়েছে তাই দেখে কাজ ও রেশন কার্ড দেওয়া হয়— #মহাভোজ’এর গল্প তুলে ধরেছে বাংলার মাটির রাজনীতির প্রেক্ষাপট, অথচ তাতে কণামাত্রও রাজনীতির গন্ধ না রেখে। এমন মুন্সিয়ানা সকলের সাধ্যানুগ বলে মনে হয় না। গল্পে কোত্থাও একবিন্দু রাজনীতি নেই, অথচ তার প্রকৃত রূপ দেখে অজান্তেই ভিজবে সংবেদনশীল চোখ। ভোট দেওয়ার অপরাধে খুন হয়েছে নগেনের একমাত্র ছেলে। অথচ ছবিতে কোথাও তার দৃশ্যায়ণ নেই, বর্ণনাও নেই। অনুক্ততার অভিব্যক্তিই এ ছবির বৈশিষ্ট্য।

জীবনযন্ত্রণার কথাকে ‘না বলার সূক্ষ্মতা’র মধ্যে দিয়ে প্রতিসৃত না করলে তা অন্তর স্পর্শ করে না। এই ফিল্মমেকারও তা দেখিয়েছেন। দেখানো হয়েছে মানুষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গিয়েছে কাটমানি, তবু মনের গভীরে আছে তা নিয়ে পাপবোধ। চড়কপুজোর সময়ে প্রধান চড়ক সন্ন্যাসীর ওপর যখন ‘ভর হল’ বাবা মহাদেবের, মানুষগুলোর মনের অন্তঃস্থল থেকে তখন বেরিয়ে এলো স্বীকারোক্তি। মানুষের অসহায়তার, বিশ্বাসের এমন মানবিক, মেলোড্রামাহীন, আর্ট-করার-প্রবণতাবর্জিত, subtle ট্রিটমেন্ট শেষ কবে দেখেছি তা বলব শেষে। মানুষের উপর ‘দেবতার ভর হওয়া’র দৃশ্য থেকে মনে পড়ে যেতে পারে ‘কান্তারা’ ফিল্মের কথা। আগাপাশতলা বাঙালী ছবি #মহাভোজ—

গল্প শুধু নয়, চিত্রনাট্য ও সংলাপও লিখেছেন মনোজ’দা। চিত্রনাট্যে কাহিনীর উপস্থাপনা এবং দৈনন্দিন জীবনের ঘটনাবলীর ট্রিটমেন্ট দেখতে দেখতে মনে পড়ছিল none other than ‘পথের পাঁচালী’— বহু বছর আগে এ রাজ্যের এক নতুন পরিচালক বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছিলেন বাংলার গ্রামজীবনের এক কাহিনী, তৈরি হয়েছিল ইতিহাস। সে ছিল তৎকালীন গ্রাম বাংলা। সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে বাংলার আর্থ-সমাজ-শিক্ষা-সাংস্কৃতিক জগতের যে স্তরের প্রতিনিধি ছিলেন হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায়, আজকের দিনের প্রেক্ষাপটে #মহাভোজ’এর নগেন তা অপেক্ষা ভিন্ন এক আর্থ-সমাজ-শিক্ষা-সাংস্কৃতিক স্তরের প্রতিনিধি। যাকে বলে সাব-অল্টার্ণ সমাজ, নগেন সেই সমাজের লোক। কিন্তু দু’জনেই বাঙালী। নগেনের জীবনকাহিনী দেখতে দেখতে ‘পথের পাঁচালী’র কথা, হরিহরের কথা মনে হওয়া ঠেকানো যাবে না। দেখতে যাওয়ার আগে ছবিটি থেকে বিন্দুমাত্র প্রত্যাশা না রেখেও যখন দেখতে দেখতে ‘পথের পাঁচালী’র কথা মনে হয়েছে, তখন এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে যে এই মনে হওয়া স্বতঃস্ফূর্ত। যাচাই করতে চাইলে দেখতে হবে #মহাভোজ।

পুনশ্চঃ— ‘পথের পাঁচালী’ দেখতে যাওয়ার মন নিয়ে #মহাভোজ দেখতে গেলে মহাভোজ’এর প্রতি অবিচার হতে পারে। কারণ সিনেম্যাটোগ্রাফি এবং আর্ট ডিরেকশনে অবশ্যই এমন বেশ কিছু ত্রুটি মহাভোজ’এর আছে, যে ত্রুটি স্বাভাবিকভাবেই ‘পথের পাঁচালী’র নেই। এতদসত্ত্বেও যখন এমন তুলনা মনে এসেছে, তখন তা থেকেই পাঠককে আন্দাজ করতে হবে ছবির গুণমান।

1 thought on ““মহাভোজ” ছবিটির রিভিউ

Leave a Reply to M K Das Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *