আত্মজা

সুদেষ্ণা সিনহা

ধারাবাহিক উপন্যাস
অধ্যায় -২

সার ঘরে একবার উঁকি দিয়ে জবা দেখল অলোক সান্যাল বসে আছে সোফায়। হাতদুটো কোলের কাছে জড়ো করা। মনে হচ্ছে নিটোল স্বাস্থ্যে কিছুটা ভাঙন ধরেছে। গায়ের  রঙেও সেই উজ্জ্বলতা নেই। মুখ চোখ কিছুটা তামাটে বর্ণের।মুখে গলায় অজস্র বলি-রেখা, তাতে বয়সের ছাপ সুস্পষ্ট।  উস্কখুস্ক  কাঁচা-পাকা চুল কপালের উপর ছড়িয়ে পড়েছে।গালের শুকনো চামড়ায় শুঁয়োপোকার লোমের মতো সাদা খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। মনে হচ্ছে,বেশ চিন্তিত । চোখের দৃষ্টি  সামনের দেওয়ালে ছড়ানো। কপালে কয়েকটা রেখার কুঞ্চন। ঘাড় একদিকে হেলিয়ে, ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কি  যেন ভাবছে। কি এত ভাবছে ! খুব অন্যমনস্ক লাগছে! নাকি প্যাঁচ কষছে, সেই আগের মতোই। এই লোকটাই যে তার জন্মদাতা — একথা ভাবতে গেলেই মাথাটা গরম হয়ে যায় জবার।বুঝতে পারে না কেন যে নিজের উপরই একরাশ বিরক্তি এসে জমা হয়! গাটা রি রি করে জ্বলে ওঠে। পেটের ভিতর থেকে কেমন যেন গুলিয়ে ওঠে জবার । শুধু কি তাই? মনটা ছটফট করতে থাকে!মনের যত বিরক্তি এক হয়ে কি যে যন্ত্রণা দেয় তাকে! এই অনুভূতি তার একান্ত নিজস্ব। এ নিয়ে কারোর কাছে কথা বলা যায় না।তার সে ইচ্ছেও হয় না। শুধুমাত্র বুলটিমাসিই কিছুটা বোঝে তাকে। বুকের চাপা যন্ত্রণাটা অসহ্য হয়ে উঠলে বুলটিমাসির কাছে দুটো কথা বলে স্বস্তি পায় সে । এই পৃথিবীর আর কাউকেই বোঝাতে পারবে না সে অলোক সান্যালের পিতৃত্ব তার কাছে কতটা ঘৃণার। ।
          মায়ের জন্য খুব কষ্ট হয় জবার।বেচারা মা!জীবনে কিছুই পাইনি মা।  মনের কষ্টের কথা মায়ের কাছে সচরাচর বলে না জবা। বরং তার পূর্ণতা,তার ভালবাসা দিয়ে মাকে সে হাসিখুশী রাখতে চায়। তার মনে হয়,আত্মজা হিসাবে একমাত্র সেই পারবে  তার মায়ের সব দুঃখ ভুলিয়ে দিতে।

      এখন সবে সকাল সাতটা ।  মাকে আজ সে নীচে নামতে দেয়নি। সে মোটেও চায় না মা অলোক সান্যালের মুখোমুখি হোক।
          নীচে নামার সময় মাকে সে বলেই দিয়েছে,তোমাকে চা পাঠিয়ে দিচ্ছি।তুমি আজ নীচে নামবে না। উপরে বসেই নিজের মতো যা খুশী করো।
        মা বলেছে, তোর বড়মামা আসবে,বুলটিরা আসবে,রান্নার মেয়ের ব্যবস্থা করা —- তুই কি একা সবটা সামলাতে পারিস।            
   —– আরে দেখই না মা। আই অ্যাম নট আ বেবি নাও।

       রান্নার লোকটা আসতে এখনও ঘন্টাখানেক বাকি।বাসন্তির মা এসেছে।বহুদিনের পুরোনো লোক।সেই ঘর ঝাড়পোছ,বাসন মাজা,কাপড় কাচার কাজ করে।

      বাসন্তির মাকে রান্নাঘরে ডাকে জবা। ফুল কাটা কাপে লিকার চা আর দুটো ক্রিম-কেকার বিস্কুট প্লেটে সাজিয়ে দিয়ে বলে,দিয়ে এসো মাসি।

      বাসন্তির মায়ের চোখেমুখে বিরক্তি সুস্পষ্ট।চোখের ঈঙ্গিতে বসার ঘর দেখিয়ে বাসন্তির মা বলে,পারোও বাপু তোমরা । ছোট মুখে বড় কথা বলি…..  যেমন দিদিমণি,তেমন তুমি। আমাদের ছোটলোকদের ঘরে এ সব বেচাল মনিষ্যির ঢোকার সাহস হতোনি।তোমরা বড়লোক।তোমাদের কথা আলাদা।

       ডান হাতের তর্জনী মুখে ঠেকিয়ে জবা স্বন্ত্রস্তভাবে ফিস ফিস করে,চুপ চুপ।শুনতে পাবে যে!

      বাসন্তীর মা গজ গজ করতে থাকে, ও লোক শুনল আর না শুনল আমার বয়েই গেল।ওর খায় না পরি।

         বাসন্তির মা চায়ের কাপ-প্লেট হাতে এগিয়ে যেতে রান্নাঘরটা একটু গুছিয়ে নিল জবা।
          চায়ের সসপ্যান, চায়ের ছাঁকনি,চামচ,কাপ,প্লেট–সব  ধুয়ে চায়ের বাসনের তাকে তুলে রাখল সে।বাসনকোসন আজ বেশী নামানো যাবে না।এমনিতেই আজ বাসন্তীর মায়ের মেজাজ চড়ে আছে।

         একটু পরেই রান্নার মেয়েটা আসবে। এক্ষুনি রান্নার ব্যবস্থা করে ফেলা দরকার।আজকাল রান্নার লোকেরাও যা হয়েছে! এক মুহূর্তও দেরী করা চলবে না।ঘড়িতে সময় বাঁধা।আরে রান্নার সরঞ্জাম বের করতেও তো কিছুটা সময় লাগে।
       প্রতিদিন রান্নার মেয়ের একই কথা, দিদি ,কি কি রান্না  হবে আজ? ও মা, এখনো বের করে রাখনি? পরের বাড়িটায় যেতে দেরী হয়ে যাবে যে!
         অবাক হয়ে যায় জবা। দশটা-পাঁচটার অফিসকর্মীরাও বুঝি এতটা সময় মানে না
          জবা জানে,তার মা একেবারেই ঝুটঝামেলা,অশান্তি পছন্দ করে না। মা তাই কোন উত্তর করে না।নীরবে রান্নার সরঞ্জাম বের করে দেয়।
      
       জবা স্টীলের ড্রাম থেকে মেপে মেপে তিন কৌটো চাল একটা বড় বাটিতে রাখে,তার উপর কলের জল ছেড়ে দেয়।বাটির জল অর্ধেক হলে কলের জল বন্ধ করে দেয় সে।এসব রান্নার মেয়ে,রীতার কৌশল।আগে থেকে চাল ভিজিয়ে রাখলে ,তাড়াতাড়ি ভাত সিদ্ধ হয়ে যায় নাকি।তাতে তার সময়ের কিছুটা সাশ্রয় হয়।কৌটো থেকে মুগের ডাল বের করে প্রেসার কুকারের কাছে রাখে সে।ডীপ ফ্রিজ থেকে রুই মাছের টুকরোগুলো বের করে জলে ভিজিয়ে রাখে ।এরপর সব্জিগুলো একে একে বের করতে করতে আজকের মেনুগুলো মনে মনে সাজিয়ে নেয়।
            বড়মামা ব্যাঙ্গালোরে ডক্টর দেবী শেঠীর কাছে চিকিৎসাধীন।বছর খানেক হল ওখান থেকেই ওপেন হার্ট সার্জারি করে এসেছেন।বড়মামা খুব নিয়মে খাওয়াদাওয়া করেন।রেড মিট,দুধ,ঘি,বড় মাছ,মশলাদার রান্না একেবারে খান না তিনি।       
         ডাক্তার বলে দিয়েছেন,সারা দিনে তিন চামচ তেলে তাঁর রান্না হবে।
        বড়মামী ডাক্তারের সে সব উপদেশ বাণী অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন।বড়মামার রান্না তিনি কম তেলমশলায় নিজেই করে দেন। অন্য সময় বড়মামা এ বাড়ি আসলে তার মা বড়মামার রান্না করে দেয়।
      জবা মনে মনে ঠিক করল আজ বড়মামার জন্য সে মাছের একটা প্রিপারেশন নিজেই অল্প তেলমশলায় করে দেবে।রীণার হাতে ছাড়বে না। রীণা বাকিদের রান্নাটা করবে।     
      
           অলোক সান্যালের  সাথে মিউচুয়াল সেপারেশনের ব্যাপারে বড়মামা কথা বলবেন আজ। বুলটিমাসি আর মেসোমশাইকেও আসতে বলেছে মা ।বুলটিমাসিদের ছাড়া তাদের মা-মেয়ের জীবনের কোন সিদ্ধান্তই নেওয়া সম্ভব না।
        জবা জানে না,অলোক সান্যাল কতক্ষণ এ বাড়িতে থাকবে! বড়মামার সাথে কথা বলেই কি  সে চলে যাবে?
    না ,আবার ভাব জমিয়ে বলবে, জবা মা আজ এখানে দুটো খেয়েই যাই?
      বেশ বিরক্তি বোধ করছে জবা। কি প্রয়োজন ছিল এই বাড়িতে অলোক সান্যালকে ডিভোর্সের আলোচনার জন্য ডাকার? মায়ের সম্মানহানি করে একদিন স্বেচ্ছায় এই বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল  অলোক সান্যাল । আজ সেই ঘৃণ্য জীবটাকে বড়মামা ডেকে পাঠিয়েছেন তার মায়ের  রোজগারের টাকায় তৈরী বাড়িতে আসবার জন্য।জবা মনেপ্রাণে কোনদিন চায়নি অলোক সান্যাল এখানে আসুক।  বড়মামাকেও জবা সরাসরি বুঝিয়ে দিয়েছিল সে কথা।

    —   আচ্ছা বড়মামা,ডিভোর্সের কথাবার্তা বলার জন্য এই লোককে কি আমাদের এই বাড়িতেই ডাকতে হবে?
     বড়মামা বলেছিলেন,মনের ইমোশন বাদ দিয়ে ভাবতে চেষ্টা কর।

— কিভাবে ভাবব বল?

—- শোন আমরা চাই তোমার মায়ের ডিভোর্সটা খুব তাড়াতাড়ি হোক এবং সেটা মিউচুয়াল সেপারেশন হোক। তার জন্য একটা নিগোশিয়েশনের প্রয়োজন আছে।তোমার বাবাকে বুদ্ধি দেওয়ার অনেক লোক আছে।সেই সব বুদ্ধি পেয়ে সে যদি লেজে খেলায় তখন পরে আমাদের মনে হতে পারে আমরা ভুল করে ফেলেছি। তখন অনেক দেরী হয়ে যাবে।কিছু করার থাকবে না।

— কি ভাবছ তুমি?যে লোকটা চিরকাল মাকে জ্বালাতন করে গেল,সে কি আজ অতি সহজে ডিভোর্স দিয়ে দেবে?

—-  মে বি অর মে নট বি।তবে আমাদের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।বসে থাকলে হবে না।

       জবার মনে হয়েছে, তার মা অলোক সান্যালকে শুধু বিশ্বাস করত না,মনেপ্রাণে ভালও বাসত। না হলে ওইরকম ইতর স্বভাবের মানুষটা আদতে কেমন জানার পরও বারবার ক্ষমা করে দেয় কেউ!
        মায়ের সম্বন্ধে বুলটিমাসি যা ভাবে,সেটাই আসলে ঠিক। মা যে বংশে জন্মেছে, বড় হয়েছে ,সেই বংশের একটা আদর্শ ছিল, আর সেই আদর্শকে মা চিরকাল সম্মান করে এসেছে। সেই আদর্শ থেকেই মুখোশধারী অলোক সান্যালের প্রকৃত চেহারা মা হয়তো বুঝেও বুঝতে চায়নি। হয়তো  তাকে শুধরে নেবার সুযোগ দিয়েছে বার বার ।
         খুব ছোটবেলার কথা মনে পড়ে জবার। মাঝ রাতে মা-বাবার চাপা ফিসফিসানিতে ঘুম ভেঙে গেলে সে দেখতো মা আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁদছে। জবা জিঞ্জেস করলে মা কোন উত্তর দিত না। সেই সময় বাবা ঘর থেকে বারান্দায় উঠে গিয়ে সিগারেট ধরাতো।
        সকাল হতেই আবার সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে যেত। মা রান্নার মাসিকে কাজ বোঝাতো।বাবা বাজার যেত।জবাকে স্কুলে পাঠিয়ে দুজনে দুজনের মতো স্কুলে যেত। তখন জবার মনে হতো, আগের রাত্রে সে যা কিছু দেখেছে সব স্বপ্ন।কোনটাই সত্যি নয়।তার মাকে কেউ বকতেই পারে না।তার মা কোনদিন কাঁদতেই পারে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *