৬০ টাকায় বাংলাদেশ – আমার অন্য পথ ~ শান্তনু ঘোষ

৬০ টাকায় বাংলাদেশ – আমার অন্য পথ
~ শান্তনু ঘোষ
পর্ব-৯

আগে যা ঘটেছে:
চলেছি রাজশাহী। পথে নাটোরের রাজবাড়ি দেখার জন্য সামান্য বিরতি নিয়েছি। অনেকটা জায়গা জুড়ে নাটোরেরে রাজবাড়ি । অল্প সময়ের মধ্যে দেখা যায় না। আমাদের তাড়া আছে বলে পরীক্ষার আগে ফাঁকিবাজ-ছাত্রের-তাড়াতাড়ি-বইয়ের-পাতা-উল্টানোর মত করে যতটুকু পারলাম দেখে নিয়ে গাড়িতে চাপলাম। এবার গাড়ি চলেছে রাজশাহী।

তারপর…
প্রায় এগারোটা বাজে। গাড়ি চলছে ‘নাটোর – রাজশাহী হাইওয়ে’ ধরে। রাস্তা বেশ ভালোই। পথের মাঝে কোথাও জনপদ, কোথাও বা গ্রাম। এমনই দেখতে দেখতে আসছি। পারিপার্শ্বিক দৃশ্য দেখলে মনে হবে কলকাতা থেকে বনগাঁ যাবার রাস্তায় আছি।

এই সব যত দেখি ততই আমার ওই একটা প্রশ্নই খোঁচা দেয় মনে। কিছুই তো ভিন্ন নয়। তাও দুটো ভিন্ন দেশ। ভিন্ন ভাবনা। অন্তরে অন্তরে কতটা কঠিন প্রাচীর। একদিন তো অনেকের মত আমার পূর্বপুরুষকেও এই দেশ ছাড়তে হয়েছিল। সব কিছু ফেলে রাতারাতি প্রাণ হাতে নিয়ে রাতের অন্ধকারে পালাতে হয়েছিল। অজানা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের হাতে পুরো পরিবারটা সঁপে দিয়েছিল নিজেদের।

আজও বাংলাদেশে থাকা বেশ কিছু মানুষের লুকিয়ে রাখা যন্ত্রণার ভীত-গোপন প্রকাশ দেখে মনটা দমে যায়। তাঁরা প্রকাশ্যে আনার সাহস পায় না। জানে তাতে ক্ষতি বই লাভ নেই। কেউ সাহায্য করবে না। তাই চুপ করে অপমান সহ্য করে দিন যাপন করতে বাধ্য। যাবার কোন জায়গা নেই। উপায় নেই।

বাংলাদেশের সুস্থ-সুন্দর মনের বন্ধুরা বার বার বলে, বাংলাদেশ সুন্দর দেশ। মানুষ খুব সহৃদয়। এখানে ভয়ের কিছুই নাই। কথাগুলো মিথ্যে নয়। তাঁদের জন্যই আজও বাংলাদেশ সুন্দর। কিন্তু বিষ এক ফোঁটা থাকলেই ক্ষতি করার জন্য তা যথেষ্ট।

সেই বিষ বাংলাদেশে আছে। কিছু লোক আছে যারা বিভেদের পূজারী। তারা তো চুপ করে বসে নেই। আর ওই কিছু লোকের প্রভাব অনেক বেশী হয়। সে কথা বাংলাদেশের সুস্থ মনের মানুষ জানে ও মানে।

দুষ্ট লোক তো সব দেশেই থাকে। তা থাকে। কিন্তু দেশের সরকারকেও কোথাও যদি দুষ্টের সাথে কিছুটা আপোষ করে চলতে হয়, বিপদের শুরুটা সেখানেই। সেখানে জনগণের ভরসার স্থল কোথায় হবে তাহলে!

মনে পড়ল UNESCO-র কন্সটিটিউশানে লেখা সেই বিখ্যাত কথাটি –
‘Since wars begin in the minds of men, it is in the minds of men that the defences of peace must be constructed’
মূল কথাটি অবশ্য ঝাড়া হয়েছে অথর্ব বেদ থেকে। পশ্চিম দুনিয়া তো এমন কত কিছু যে আমাদের থেকে ঝেড়েছে তার হিসেব নেই। ভারতের প্রাচীন পুঁথি চুরি করে, জ্ঞান চুরি করে এখন নিজের নামে পেটেন্ট করে আমাদের কাছেই বিক্রি করছে।

সে যাই হোক গে, মোদ্দা কথা হল, মানুষের মনের জগতে পরিবর্তন না আসলে – প্রকৃত পরিবর্তন কখনই আসবে না।

গাড়ি চলছে ভালোই। কৌস্তভকে বলি, রাস্তায় পুঠীয়ার রাজবাড়ি পড়বে। চাইলে একবার দেখে নিতে পারি।

ড্রাইভার ভাইকে বলাতে, তিনি বলেন যে, হ্যাঁ, একটু বাঁক নিয়ে যেতে হবে। তাই আমরা মেইন রোড ছেড়ে বাঁদিকে একটা সরু রাস্তায় ঢুকে পড়েছি।

মাঝপথে একটা বাজার মত জায়গায় আবার একটু চা-বিরতির জন্য থামলাম।
খুবই সাদামাটা চায়ের দোকান। একটা মুদী দোকানের অ্যাপেন্ডিক্স এর মত ছোট লেজুর হয়ে রাস্তার দিকে এগিয়ে আছে। নেমে আড়মোড়া ভেঙ্গে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম দোকানের দিকে। কৌস্তভ নেমেই দোকানে বলে দিল, ওয়ান-টাইম।

আমি বললাম, আমায় লাল চা দেবেন। দোকানী আমাকে শুধরে দিয়ে বললেন, ওহ, লিকার চা খাবেন।
বাংলাদেশে সব জায়গায় লিকার চা পাওয়া যায়। ইন্ডিয়াতে আমি এমন পাই না। এখানে অনেকটা পরিমানে চা দেয়। আর দাম বেশ কম, সব জায়গায় ৬ টাকা। যেন সরকারী বাধা রেট। মজা পাচ্ছি।

শীতের মিষ্টি রোদে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক দেখছি। সামনের মুদী দোকানটা বেশ সাজানো। দোকানে ভিড় নেই। একজন ক্রেতা কিছু কিনতে এসে দোকানীর সাথে গল্প জুড়েছে। তাদের গ্রামে জমি জমা নিয়ে গোলমালের গল্প। খুবই সাধারণ। তার মধ্যেই এসে গেল তাদের পার্টি-পলটিক্সের কথা।

পশ্চিমবঙ্গে লাল-লাল জামানায় বেড়ে ওঠা। পলিটিক্সের গন্ধ পেয়েই এক-পা দু-পা করে এগিয়ে গেলাম । কান খাড়া করে শুনছি ।

ক্রেতা বলছেন, বেশী ঝামেলা পাকাইলে, আওয়ামীলীগের নেতারে ধইরা লইয়া আসুম। ও তো আমাগো কথা শুনবই। আরে আমার বাড়ির ৩৬ টা ভোট।
আমি চোখ বড় বড় করে শুনছি, এক বাড়িতে ৩৬ টা ভোট! কত বড় পরিবার রে বাবা!
দোকানী এবার বি এন পি নিয়ে কিছু বলছে। পাশে দাঁড়িয়ে আমি উৎসাহী শ্রোতা।

আওয়ামীলীগ আর বি এন পি হল বাংলাদেশের দুই বড় রাজনৈতিক দল। সর্বদা প্রতিপক্ষ। তাই এদের বিষয়ে সাধারণ মানুষের মনে কি ভাবনা চলছে জানতে আমার খুবই ইচ্ছে। অজান্তেই মাথা নাড়ছি।

ওদের কথার মাঝে দু-একটা প্রশ্নও করছি। চায়ের দোকানের আড্ডায় প্রায় ঢুকে পড়েছি। অতি উৎসাহিত হয়ে আমি কিছু বলতে যাচ্ছি…
এমন সময় কৌস্তভ, কানে কানে বলল, এখানে পলিটিক্স নিয়ে একদম কথা বলবি না। যতই টেম্পটেশন হোক না কেন।
আমি তাই ঢোক গিলে মন দিয়ে চা খেতে শুরু করি।

চা পান পর্ব শেষে। গাড়ি আবার চলছে। এবার পুঠীয়ার রাজবাড়ি।
সরু রাস্তা দিয়ে গাড়ি হঠাৎ একটা বিশাল বড় মাঠের সামনে এসে উপস্থিত। মাঠের অপর প্রান্তে দেখছি এক ছোটখাটো প্রাসাদ ভবন। দেখেই বোঝা যায় যে আগেরকার দিনের জমিদার বাড়ি।

ইন্দো-সারাসেনিক আর্কিটেকচার এর ধাঁচে তৈরি। ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে এমন একখানা প্যালেস যিনি এই সুদূর প্রান্তে দাঁড় করিয়েছিলেন তাঁকে সেলাম। ইন্দো-গথিক ডিজাইনের বড় বড় থাম ওয়ালা প্রাসাদটি দেখলেই প্রথমে কলকাতার আলিপুরে সরকারী টাঁকশাল বিল্ডিং এর কথা মনে হবে, কিংবা ন্যাশনাল লাইব্রেরী। আর থাম গুলি দেখলে তো জিপিও, টাউন হল, বা প্রিন্সেপ ঘাট মনে আসবেই।

ইতিহাস বলে যে, রানী হেমন্ত কুমারী দেবীর জন্য এই ভবনটি বানানো হয়েছিল। মূলত চারটি অংশ আছে – কাছারি, মন্দির, অন্দর মহল, আর মহারানীর থাকার মহল। এখানেও চারদিকে বড় বড় দীঘি কাটা আছে। তখনকার দিনে সুরক্ষা ব্যবস্থার একটা দিক। বাড়িটির ভিতরে ঢুকতে টিকিট লাগে। সময় কম থাকায় আমরা ঢুকছি না। বাইরে থেকেই দেখছি। মূল ভবনটির অবস্থা তেমন ভাল নয়। ভালো করে সংস্কার-সংরক্ষণ প্রয়োজন।

রাজবাড়ির সামনে সুবিশাল উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ। পশ্চিমবঙ্গে এমন খালি জায়গা পড়ে থাকলে এতদিনে প্রমোটিংএ চলে যেত।

প্রাঙ্গণের সামনে আর বাঁ-পাশে রাস্তা । ডান দিকে দীঘি। দীঘির পাশ দিয়ে রাজবাড়ি পেছনে যাওয়া যায়। সেদিকে এসে দেখি অযত্নে অপালিত আমবাগান। সেখানে কিছু যুবক-যুবতী নিভৃত সময় অতিবাহিত করতে ব্যস্ত।

আমরা চলে এসে প্রাসাদের পাশে পঞ্চরত্ন গোবিন্দ মন্দিরে গেলাম। টেরাকোটার কাজের সুন্দর নিদর্শন রয়েছে মন্দিরের গায়ে। মন্দির প্রাঙ্গণের বাকি মন্দিরগুলো ভেঙ্গে গেছে।

আদিতে পুঠীয়া ছিল লস্করপুর পরগণার একটি গ্রাম। লস্কর খাঁ নীলাম্বর এর নাম থেকেই এই লস্করপুর নাম । তিনি ছিলেন পুঠীয়ার প্রথম জমিদারের ভাই। পরবর্তী কালে এই জমিদারী ভাগাভাগি হয়ে যায়। এখন যা সামনে দেখছি তা হল পাঁচ আনি ভাগের অংশ।

এই সম্পত্তি ভাগাভাগির রোগটা মনে হয় বহুকাল আগে থেকেই বাঙ্গালীর রক্তে আছে। নাটোরের জমিদারীতেও একই অবস্থা দেখেছি। বাঙ্গালী নিজের পরিবারেই মিলেমিশে থাকতে পারে না, তো দেশে কি করে মিলেমিশে থাকবে ! পরিবারের সম্পত্তি ভাগের মত দেশটাও ভাগ করে নিয়েছে।

কিন্তু লক্ষণীয় যে এই খাঁ বাবুরা কত সুন্দর মন্দির করেছিলেন। তাই খাঁ দেখেই অত হা হা করার কিছু নেই। বিষয়টির গভীরে জানা প্রয়োজন। খাঁ বা খান উপাধি দেওয়া হত সেই সময়। অনেক হিন্দু রাজা বা জমিদারও সেই উপাধি পেতেন এবং ব্যবহার করতেন।

ক্রমশঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *