৬০ টাকায় বাংলাদেশ – আমার অন্য পথ ~ শান্তনু ঘোষ

৬০ টাকায় বাংলাদেশ – আমার অন্য পথ
~ শান্তনু ঘোষ
পর্ব-৮

আগে যা ঘটেছে:
ঈশ্বরদী ষ্টেশনে নেমে একটি রিক্সা নিয়ে চলে এসেছি কৌস্তভদের অফিসের গেস্টহাউজে। আসার সময় জিলিপি কিনে এনেছি। কৌস্তভ অফিসে আছে। আর কিছু সময় পরে আসবে। ইতিমধ্যে গেস্ট হাউজের ছেলেটি আমাকে একটা ঘর দেখিয়ে দিয়েছে। আমি জিনিসপত্র রেখে একটু ফ্রেস হয়ে নিচ্ছি। এমন সময় দেখি কৌস্তভ এসে গেছে। এসেই অনেক প্রশ্নবাণ ছুড়ে দিল আমাকে। তারপর আমরা বসেছি আগামীকালের ঘোরার বিষয়ে আলোচনা করতে। প্রাথমিক ভাবে ঠিক হল যে, আগামীকাল নাটোরের রাজবাড়ী দেখে রাজশাহী যাওয়া হবে।

তারপর…

আগামীকাল কৌস্তভ ছুটি পাবে। মাত্র একদিনই। খুবই ব্যস্ত মানুষ। তাও একটি ছুটির দিন বন্ধুর জন্য উৎসর্গ করবে।

ঈশ্বরদী থেকে আমি দুটো জায়গায় যাবো ভেবেছি। একদিকে শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ি দেখতে, আর অন্যদিকে রাজশাহী ও নাটোরের রাজবাড়ী দেখতে।

বন্ধু আমাকে বলল, যে ও মাত্র একদিন যেকোনো একদিকেই আমার সঙ্গে যেতে পারবে। আমি কোনটা চাই ভেবে নিতে বলল।

কৌস্তভ হল ফুলহাতা কর্পোরেট ম্যান। তাই একটা ছোট “কস্ট-বেনেফিট” এনালিসিস আলোচনা করে নেওয়া হল। তারপর আমারা ঠিক করলাম যে আগামীকাল রাজশাহী আর নাটোরেরে রাজবাড়ী যাওয়া হবে। এখানে অবশ্য আমার ‘কষ্ট’ আর ‘বেনেফিটের’ কথা ভেবেই ও এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ ও থাকলে একটা গাড়ির ব্যবস্থা হবে। আর তাতে আমি সুখে ঘুরতে পারব। কারণ রাজশাহী অনেকটা দূর।

ও বলল, শিলাইদহে তুই বাসে করেও চলে যেতে পারবি বেশী দূর নয়। ওটা বরং তুই একাই দেখে আসিস। আমার দেখা হয়ে গেছে।
আমিও খুশি খুশি রাজি হয়ে গেলাম।

রাতের খাবার খেয়ে অনেকদিন পরে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছি। স্কুলের দুই বয়স্ক-বন্ধু এক জায়গায় হলে যা হয় আর কি। পুরানো সেই দিনের কথা…স্কুল জীবনের কথা… কলেজ লাইফ…। তখন ঘটে যাওয়া অনেক কিছুর পেছনের জানা-অজানা কারণগুলো উন্মোচিত হচ্ছে। সেইসব কথা চলছে। ইতিমধ্যে ওর সহধর্মিণী ফোন করলেন কলকাতা থেকে। ভিডিও কল। সেও তো জানে যে আমি এখানে উপস্থিত। তেনাকেও তো অনেকদিন চিনি। তাই ভিডিও কলেই ইয়ারকি-মজা আর হাই হাই-বাই বাই করা হল।

কৌস্তভের কাছ থেকে শুনছি বাংলাদেশে ওর কাজ করার অভিজ্ঞতা। ভালোমন্দ মিশিয়ে বেশ উপভোগ্য কাজের অভিজ্ঞতা হয়েছে ওর। ওকে বলে দেওয়া হয়েছিল, বেশ সাবধানে চলাফেরা করতে। প্রথমদিকে একদম গুড বয় হয়ে চলত। পরে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। এখন অনেকটা সাহসী।

প্রাত্যহিকিতে কিছু শব্দ যেমন, আসসালামু আলাইকুম, পানি, ফোন দেওয়া, এমন আরও কিছুর ব্যবহার অভ্যেস করে নিয়েছে। বাংলাদেশে কেউ ফোন করে না, ফোন দেয়। কি মিষ্টি শব্দ ! ইশ, আমায় যদি কেউ বলত ফোন দিব, আমি তো সানন্দে বলতাম, দিলে একটা আপেল ফোন দিও।
গল্পে গল্পে রাত অনেক হয়ে গেল। এবার না ঘুমালে আগামীকাল তাড়াতাড়ি উঠতে পারব না।

সকালে আমার ঘুম তাড়াতাড়ি ভেঙ্গে যায়। আর ঘুরতে গেলে তো আরও তাড়াতাড়ি। পাহাড়ে গেলে তো খুব ভোরে উঠতে হয়। কিছুদিন আগেই গাড়োয়ালে গিয়ছিলাম। হিমালয়ের কোলে কার্ত্তিকস্বামী মন্দির থেকে সূর্যোদয় দেখব বলে, কনকচৌরি গ্রাম থেকে এত অন্ধকার থাকতে হাঁটা শুরু করেছিলাম যে এক জায়গায় পাহাড়ি পায়েচলা পথে পথ ভুল হয়ে গেছিল। পরে কিছু স্থানীয় লোক ঠিক রাস্তা বলে দেয়।

আবার পরের দিন, তুঙ্গনাথ থেকে আরও উঁচুতে চন্দ্রশীলা (১৩০০০ ফুট) যাবার জন্য কত অন্ধকার থাকতে উঠে হাঁটা শুরু করেছিলাম। সেখানেও স্কুলের অন্য দুই বন্ধু ছিল। খুবই ঠাণ্ডা । তাও সবাই হাঁপিয়ে লাফিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলাম। নইলে তো হিমালয়ের বরফ আবৃত শৈল শিখরের উপরে সূর্যোদয় দেখা যাবে না। সে এক অনবদ্য অভিজ্ঞতা। ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। তাই একটা ফিল্ম তৈরি করে তাতে সেই সৌন্দর্য ধরে রাখার চেষ্টা করেছি। ইউটিউবে আছে আমার সেই তুঙ্গনাথ ভিডিও।

কৌস্তভের জন্য এই বেড়াতে যাওয়া একটু কষ্টকর হবে। ওর অত সকালে ওঠার অভ্যেস নেই। বেচারার একটি দিনই ছুটি । কিন্তু আমার জন্য বলিদান দিচ্ছে। ব্রেকফাস্ট পেতে একটু দেরী হল। বেরোতে বেরোতে প্রায় ৮ টা হয়ে গেল। দুয়ারে দেখি একটি বিদেশী গাড়ি দাঁড়িয়ে।

গাড়ি দেখে আমি বেশ চমকালাম। এমন গাড়ি তো আমি জীবনেও দেখিনি। জানতে পারলাম বাংলাদেশে প্রচুর “পূর্ব-ব্যবহৃত” বিদেশী গাড়ি আমদানি করা হয়। কারণ বাংলাদেশে এখনো নিজস্ব গাড়ি তৈরির কারখানা নেই। ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই হবে। তখন হয়ত এই বিদশী গাড়ি আর আমদানি করতে হবে না।

চালককে প্রশ্ন করে জানলাম, কেনার সময় গাড়িটি প্রায় ৬০ হাজার কিলোমিটার চলেছিল। অন্তত মিটারে তাই ছিল। কিন্তু এখনও এই গাড়ি নতুনের মতই চলে। ‘কোন সমস্যা নাই’। রাস্তায় দেখছি ছোট গাড়ি সবই বিদেশী। কিন্তু ভারতের বাজারে উপস্থিত ব্র্যান্ডগুলো চোখে পড়ছে না, দু একটা হুন্ডাই আর টয়োটা ছাড়া।

তবে প্রচুর বাজাজ, হিরো, আর ইয়ামাহা বাইক দেখতে পাচ্ছি। শুনলাম যে, বাংলাদেশে এই বাইকের দাম ভারতের বাজারের তুলনায় প্রায় দেড় থেকে দ্বিগুণ বেশী।

আমরা প্রথমে যাবো নাটোরের রাজবাড়ী। গুগুল দেখাচ্ছে ৫০ কিমি। আর সময় লাগবে ১ ঘন্টা। আর রাজশাহী প্রায় ৯৫ কিমি সময় লাগবে ২.৩০ ঘন্টা। গুগুল যা দেখাচ্ছে দেখাক। আমরা আমাদের মত চলেছি।

রাস্তায় এক জায়গায় একটা চা-বিরতি নেওয়ার জন্য থামলাম। একেবারে নির্ভেজাল রোড-সাইড ঝুপড়ি চা দোকান। পশ্চিমবঙ্গে আমরা দেখেছি এমন দোকান দেখলেই কোন কোন মন্ত্রী চা বানাতে চলে যান সেই দোকানে।

পরিচ্ছন্নতার কথা মাথায় রেখে কৌস্তভ বলে দিল, ‘ওয়ান টাইম’ দেবেন।
আমি ভাবি, এই ‘ওয়ান টাইম’ কি ব্যাপার? চা তো একবারই খাব? সেটা আবার আলাদা করে বলার কি আছে ! আর ‘ওয়ান টাইম’ না বলে দিলে কি চা দিতেই থাকবে? টু টাইম, থ্রি টাইম…?

চা এল। দেখলাম সে এক মজার ব্যবস্থা। ষ্টীলের কাপের ভিতরে একটা প্লাস্টিকের কাপ বসিয়ে তাতে চা দেওয়া হল। ‘ওয়ান টাইম’ মানে বুঝলাম ডিস্পজেবল ।

চা খেতে খেতে চালককে জিজ্ঞেস করি, নাটোর আর কত দূর ?
সে বলে, আর ২০ কিলো।
আমি ভাবলাম, আরে ভাই আমি কি নাটোরের ওজন জিজ্ঞেস করেছি নাকি !
একটু পরে বুঝলাম যে, কিলো বলতে আসলে কিলোমিটার বলতে চাইছে। চলতি কথায় বাংলাদেশে দূরত্ব সবাই “কিলো” তেই বলে। আলু অবশ্য কেজিতেই বিক্রি হয়।

বাংলাদেশের এই ছোট ছোট বিষয়গুলি আমাকে বেশ আকর্ষণ করছে। একটা দেশ, তার মানুষ, তার সমাজ চিনতে এই আপাত তুচ্ছ ঘটনা গুলি খুব সাহায্য করে। বড় বড় স্ট্যাটিস্টিকস, গ্রাফ, চার্ট তো বড় বড় লোকদের জন্য। আমার মত হেটো-মেঠো ভ্রমণপিপাষুর জন্য এই এক-একটি বিন্দু জুড়ে জুড়ে একটা ছবি তৈরি হয়। মানুষকে অনেক কাছ থেকে জানা যায়।

জানালা দিয়ে বাইরে দেখছি। রাস্তার ধারে জায়গায় জায়গায় অনেক বড় করে হয় ব্রাজিল, নয় আর্জেন্টিনার পতাকা টানানো। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে বিশ্বকাপের প্রভাব। অনেক বাড়ির ছাদেও লম্বা বাঁশের ডগায় ওই পতাকা উড়ছে। যদিও বিশ্বকাপ গত মাসেই শেষ হয়ে গেছে।

এসব ভাবতে ভাবতে দেখি আমাদের গাড়ি বাঁদিকে সরু রাস্তায় ঢুকে পড়েছে। এদিক দিয়েই নাটোরের রাজবাড়ী যেতে হবে। রাস্তা বেশ সরু। তার মধ্যেই দেখলাম নানা জায়গায় ‘বনলতা সেন’ নাম টা লেখা আছে। এই নামটা এখানে অকাতরে ব্যবহার করা হয়েছে। সেই নামে একটা স্কুলও আছে মনে হল।

নাটোরের রাজবাড়ীর সামনে বড় গেট। লাল রং। গেট বন্ধ। টিকিট কেটে ঢুকতে হবে। এখানে বাংলাদেশী ও বিদেশীদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন দামের টিকিট।

গেটের বাদিকে এক বড় বোর্ডে রাজবাড়ীর ইতিহাস লেখা আছে। এতটা লেখা পড়ার ধৈর্য বা সময় নাই। তাই পিড়িং পিড়িং করে একটু পড়ে বাকিটা ছবি তুলে নিলাম। আপনাদের পড়াবো বলে।

গেট পার হতেই মন ভরে গেল। আহা কি সুবিশাল প্রাঙ্গণ। সত্যি রাজবাড়ী বলেই অনুভূত হয়। সামনে অনেকটা লম্বা খালি প্রান্তর। তার মাঝখান দিয়ে রাস্তা। সেই রাস্তা ধরে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলছে। দুধারে গাছ গাছালি। কিছু দূরে রাজকিয় ঢঙ্গে তৈরি দু-একটি দালান দেখা যাছে। কোনটার কি মাহাত্য তা পড়ে জানতে হবে। আমি তেমন জানিনা। আসলে সময় কম। তাই আমি জায়গাটা ভালো করে ঘুরে দেখতে চাইছি। আর ইন্টারনেটের যুগে, নাটোরের রাজবাড়ীর ইতিহাস তো আমি ঘরে বসেও পড়তে পারব।

ছবি তোলার সরঞ্জাম নিয়ে কাজ শুরু করি। ও মা! একটু পরেই দেখি ভিডিও ক্যামেরার মেমরি কার্ড টা এরর দেখাচ্ছে। তার মানে দেহ রাখল। মাথায় হাত। এখন আমি নতুন মেমরি কার্ড কোথায় পাই? যাই হোক। ভিডিও ক্যামেরা রেখে ষ্টীল ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলতে থাকি। ফিল্ম শুটিং-এর জন্য দারুণ লোকেশান।

একটু ছোট করে বলে দেই। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে রাজবাড়ী। ১২০ একর। ভিতরে অনেকগুলো বিভিন্ন সাইজের বাড়ি বা ভবন। সেকালের জমিদার বাড়ির স্টাইলে তৈরি। পুরো এলাকাটি ওরা দুটো ভাগে ভাগ করেছে। ছোট তরফ আর বড় তরফ। তরফ অর্থ জমিদারীর অংশ বা মালিক।

অনেক ভবন ভেঙ্গে গেছে, আধ ভাঙ্গা পড়ে আছে। তবে কয়েকটির সংস্কার করা হয়েছে। ভিতরে পাঁচটি বড় বড় পুকুর বা দিঘি আছে। নিরাপত্তার কথা ভেবে খনন করা হয়েছিল। দিঘির পারে সুন্দর বনবীথি।
একটা প্রাচীন মন্দির এখনও আছে। শ্যামসুন্দর মন্দির। সংস্কার হয়েছে। নিত্য পূজা হয়।

কৌস্তভ হাফ ব্রাহ্মণ। ঢুকে গেল মন্দিরে। বেশ বড় জায়গা। ভিতরে নানা দেব দেবীর মূর্তি। এক মাঝবয়সী মহিলা এগিয়ে এলেন। তিনি আর তার স্বামী এই মন্দিরে পূজা ও দেখভাল করেন। পাশেই থাকেন। দালান ঘরটা দেখালেন। সেখানে দাওয়ায় বসে একটি মেয়ে লেখাপড়া করছে। জিজ্ঞেস করাতে বললেন যে, ওনার ছোট মেয়ে। ক্লাস এইটে পড়ে। বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে বারো ক্লাসে পড়তে পড়তে। এখন ছোট মেয়েও চাইছে বিয়ে করতে। শুনে আমি হাঁ হয়ে গেলাম।

রাজবাড়ীর এত বড় এলাকার সংরক্ষণের জন্য অনেক অর্থের প্রয়োজন। সরকার হয়ত ততটা দিয়ে উঠতে পারে না। এইখানে পিকনিক করার ব্যবস্থা আছে। টাকা দিয়ে বুক করা যায়।

অনেকেই বন্ধু-বান্ধব, প্রেমিক-প্রেমিকা, পরিবার নিয়ে বেড়াতে এসেছে। আমরাও এদিক-ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ভবন-পুকুরগুলো ঘুরে দেখছিলাম। কিন্তু মনে খোঁচা দিচ্ছে সময়। কারণ রাজশাহী যেতে হবে। বেলা বাড়ছে।

ওদিকে রাজশাহী থেকে এক বন্ধু দু-বার ফোন করে জিজ্ঞেস করেছে আর কত দেরী হবে সেখানে পৌঁছাতে। সে অপেক্ষা করছে। তাই আর দেরী না করে, এবার গাড়িতে উঠে রওনা দিলাম রাজশাহীর দিকে।

ক্রমশঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *