হিয়ার মাঝে ******* সুদেষ্ণা সিনহা

হিয়ার মাঝে
সুদেষ্ণা সিনহা

আজ সন্ধ্যে থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না মানাইকে।অতসী কেমন যেন চঞ্চল হয়ে উঠেছে। সম্ভবত ওর মনের অন্দর মহলে অদ্ভুত ও ভিত্তিহীন কল্পনার সংখ্যা বাড়ছে।
আমাকে কেউই কিছু বলেনি। তবুও আমি লোহিতরঞ্জন রায়, শহরতলির এক আধাখ্যাত কলেজের সাইকোলজির প্রফেসর সন্ধ্যেবেলায় বিছানায় গা এলিয়ে বিশ্রাম নিতে নিতে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের  সাহায্যে বুঝতে পারছি ,আমাদের ছেলে মানাই এখনো ঘরে ফেরেনি।
অতসী দরজার ভারী পর্দা সরিয়ে একবার করে ঝুলবারান্দায় যাচ্ছে। তারপর তার পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চির শরীরটাকে গ্রীলবারান্দার ফাঁক দিয়ে গলিয়ে রাস্তার মিটমিটে আলোয় মানাই এর মুখটা দেখার প্রত্যাশা করছে।
আবার একদল ছেলের হুল্লোর শুনে অতসী ছুটে গেল ঝুলবারান্দায়। কাকে যেন জিঞ্জেস করল, ” এই মানাইকে দেখেছিস রে ওদিকটায় ? ” সে কি উত্তর দিল শোনা গেল না, তবে দরজার পর্দাটাকে ফের দোলার সুযোগ দিয়ে অতসী ঘরে এসে ঢুকল। এই নিয়ে বোধহয় পাঁচবার হল।এবার ঠিক আমার সামনেটায় এসে দাঁড়াল ও,কিছু বলার অপেক্ষায়। চোরা চোখে দেখলাম অন্যদিনের মতো সাজের পারিপাট্য নেই , বাসি ফুলের মতো নেতিয়ে গেছে মুখটা । কপালে একরাশ কুচো চুলের ঢেউ ।পরনের শাড়িটাও কেমন আলগা হয়ে ঝুলে পড়েছে।থমথমে মুখে চিন্তার ছাপ।
সামনে একজন কিছু বলার অপেক্ষায় ,আর আমি ছিঃ টিকটিকির মতো ঘুলঘুলি খুঁজছি। তীব্র বিবেকের দংশনে অস্থির হয়ে উঠলাম।
– ” কিছু বলবে? ”
শাড়ির খুঁটটা তর্জনীতে জড়াতে জড়াতে অতসী বলল, “মানাই এখনও ফেরেনি গো।”
বাইরে শান্তভাব বজায় রেখে আমি বললাম, ” এত চিন্তা করছ কেন? ফিরবে । ছেলে বড় হচ্ছে না? হয়তো কোন বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে । ”
– “আড্ডা দেবে আমার মানাই? ”
অজান্তে মাতৃহৃদয়ের কোন্ দুর্বলতম জায়গায় আঘাত করে ফেলেছি বলে নিজের উপর রাগ হল।
– ” মিনুকে জিঞ্জেস করেছ? ও কোথায় ? ”
তর্জনী তুলে পাশের ঘরটা দেখাল অতসী। পড়াশোনার সুবিধার জন্য ওখানেই দুই ভাইবোনের থাকার ব্যবস্থা।পিঠেপিঠি দুই ভাইবোনে যতটা ভাব,ততটাই খুনসুটি।মাঝে মাঝে অতসী রেগে যায় , ” কি তোমার আক্কেল বলত ,বাঘে গরুকে আর কতদিন এক জায়গায় রাখবে? ”
মানাই নতজানু হয়ে প্রেয়ারের ভঙ্গীতে বলে, ” মম্ টু মান্থস্ অনলি। নীটের রেজাল্ট বেড়ালেই তো আমি চলে যাব।আর ততদিন এই জ্বলুনিটুকু সহ্য কর প্লীজ । ”

মিনুকে ডাকা হল।বেচারা কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। মানাই এর কথা জিঞ্জেস করতেই তির তির করে কেঁপে উঠল ওর পাতলা ঠোঁটদুটো। ওর কথা থেকে যেটুকু বুঝলাম স্কুল থেকে ফিরে মিনুর প্রচন্ড গরম লাগছিল,ফ্যান চালিয়েছিল সেই নিয়েই ভাইবোনে একচোট মতানৈক্য। রাগ করে ঘর থেকে বের হয়ে যায় মানাই। তারপর আর দাদাকে দেখতে পায়নি মিনু।
কি করা যায় ভাবছি ঠিক তখনই দেওয়াল ঘড়িতে আটটার ঘন্টা বাজতেই সচকিত হয়ে উঠি আমি আর অতসী দুজনেই।
ছোটবেলায় একবার  রথের মেলাতে হারিয়ে গিয়েছিল মিনু।তখন স্থানীয় থানার দায়িত্বে ছিল রমেন,আমারই স্কুলের বন্ধু।ফিরে এসে কি কান্না অতসীর!রমেনকে খবর দিতেই তৎপর হয়ে ওঠে পুলিশ প্রশাসন।সন্ধ্যেবেলায় বাসস্ট্যান্ড থেকে খুঁজে পাওয়া যায় মিনুকে। এক মহিলা ওকে কোলে নিয়ে বাসে  উঠছিল। মহিলার জামাকাপড়ের সাথে মিনুর জামাকাপড়ের মিল না থাকায় পুলিশের জালে ধরা পড়ে মহিলা। সে যাত্রায় মিনুকে ফিরে পেয়েছিলাম আমরা। অতসীর সে কি আনন্দ !
পূর্ব স্মৃতি পুনর্রোমন্থনের আশায় থানায় যাব ভাবছি,অতসী একটা বাসন্তী রঙা খাম আর একটা চিরকুট ধরিয়ে দিল আমার হাতে । আমার জিঞ্জাসু চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “খামে মানাই এর ফটো আছে আর ওই চিরকুটটায় ওর বন্ধুদের নাম আর ফোন নাম্বার ।”
একে একে মানাই এর বন্ধুদের বাড়ি থেকে ফিরে এলাম। কেউ জানে না ওর খবর। আজ নীটের রেজাল্ট বেরোনোর পর ওকে ফোন করেছিল ওরা। মানাই ফোন তোলে নি।
কোথায় যেতে পারে ভাবতে ভাবতে এগিয়ে গেলাম ইন্দ্রাণী টকিজের দিকে। যদি সিনেমা দেখতে আসে । সিনেমার শো ভেঙেছে তখন ।আস্তে আস্তে নারী পুরুষের ভিড় পাতলা হয়ে এল একসময়। ফাঁকা সিনেমা হলের সামনে আমি একা।মানাই এখানেও নেই।

এবার কোথায় যাব? ইন্দ্রাণী টকিজের সামনে চৌরাস্তা পেরিয়ে থানার মোড় । সে রাস্তাই ধরলাম।
থানায় গিয়ে যা শুনলাম তাতে আমার পিতৃহৃদয় বার বার বলতে লাগল এমনটি যেন না হয়। আজ বিকেলে একটা উনিশ-কুড়ি বছরের ছেলে নাকি গঙ্গার ব্রীজ থেকে ঝাঁপ দিয়েছে ।আর ঝাঁপ দেওয়ার আগে একটা অদ্ভুত কাজ করেছে সে ,তার চটিজোড়া আর রুমালটা একটা বাচ্চা ছেলেকে দিয়ে থানায় পাঠিয়ে দিয়েছে। জমা পড়া চটি আর রুমাল দেখতে চাইলাম । থানা থেকে বলল  – ” সকালে আসুন। ”
বড়বাবু নেই।  যিনি দায়িত্বে আছেন তিনি সব শুনে বললেন – ” নিখোঁজ ডায়েরি করবেন যে , দরখাস্ত নিয়ে এসেছেন?” মাথা নাড়লাম আমি।
নিখোঁজ ডায়েরি করে থানা থেকে বেরিয়ে এলাম যখন তখন অনেক রাত । বুকের মাঝে হাজার উথাল-পাথাল। সন্তানের অনাগমনে ক্ষতবিক্ষত জায়গাটা কাকে দেখাব আমি !কাকে দেখাব !  মানাই তুই এরকমটা করলি কেন? কি দুঃখ ছিল তোর বাবা? জীবণে ডাক্তারি প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করাই কি বড় কথা ! আমি কেমন বাবা রে,তোকে বুঝতে পারলাম না ! তুই ই কি এমনটা করেছিস?একা একা এতো বড় সিদ্ধান্ত নিতে পারলি বাবা?তোর ভয় করল না একটুকুও?
পায়ে পায়ে কখন বাড়ির সামনে এসে পৌঁছে গেছি জানিনা। নিস্তব্ধ রাত। সবাই নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে ।এখানে আমিই একমাত্র পিতা যে জানে না তার সন্তান মৃত না জীবিত । মনে হল বিশ্বদেবতা আমার জীবণ পথে কালির পুরো দোয়াতটাই উল্টে দিয়েছেন ।
হাত বাড়িয়ে কড়া নাড়তে গিয়েও হাত সরিয়ে নিলাম  ।থাক। অতসীর হাই ব্লাড প্রেসার। কিছুটা সময় বেচারা নিশ্চিন্তে থাকুক। বুক পকেট থেকে মানাই এর ছবিটা বের করে মোবাইলের টর্চে দেখতে দেখতে বড় অচেনা লাগল । বন্ধ দরজার সামনে উদ্ভ্রান্তের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম আমি আরেকটা ভোরের অপেক্ষায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *