ছোটগল্প – “নতুন ঠিকানা” কলমে – ইলা মজুমদার

ছোটগল্প – “নতুন ঠিকানা”
কলমে – ইলা মজুমদার

… হঠাৎ উজান তিস্তাকে বলল, একটু ছাদে যাবে? তোমার সঙ্গে কথা আছে। তিস্তা একটু অবাক হয়। অন্যদিনের তুলনায় আজ উজান একটু আগেই বাড়ি ফিরেছে। বেশিরভাগ দিন রাতে ডিনার সেরে বাড়ি ফেরে। নামী মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করে।
ছাদের মাঝে দোলনাটা খুব পছন্দের তিস্তার, সেখানেই বসলো তিস্তা। রূপশালী চাঁদের ঝুরো জোছনায় তিস্তা স্নান করছে।অনেকদিনই সন্ধেয় চা খেতে খেতে গল্প আর রাতের নিভৃত রসায়ন তলানিতে ঠেকেছে কিন্তু আজ চাঁদ যেন ওদের গায়ে ঝাঁপাঝাঁপি করছে। বেশ একটু উচ্ছ্বসিত হয়ে তিস্তা গান ধরল –
……”পূর্ণিমাসন্ধ্যায় তোমার রজনীগন্ধায়
রূপসাগরের পারের পানে উদাসী মন ধায়।”

হঠাৎ কোন বিরহী কপোত যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তোমার সঙ্গে কিছু কথা ছিল তিস্তা। সিগারেট ধরালো উজান। নিবিষ্ট মনে উজানের দিকে তাকালো তিস্তা। উজানকে বেশ চিন্তিত আর ক্লান্ত দেখাচ্ছে। উজান ধীরে ধীরে কেটে কেটে বলছে , কিভাবে যে তোমাকে বলবো বুঝে উঠতে পারছিনা। একটা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাজ করছে আমার মধ্যে। তোমার মধ্যে কোন অপূর্ণতা নেই। তুমি বিদূষী, কলেজের প্রফেসর , অসাধারণ ব্যক্তিত্ব তোমার যে কোন পুরুষ তোমাকে স্ত্রী হিসেবে পেলে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করবে।
তবুও আমি সেপারেশন চাই তিস্তা
তিস্তার মনে হল হঠাৎই একটা মার্সিডিজ তাকে
চাপা দিয়ে চলে গেল। এই উজানকে তিস্তা চেনে না, হয়তো কখনো চিনতো, আজ ভুলে গেছে। কিছুটা প্রস্তুতি নিয়ে উজান বলতে লাগল, “আমি ডোনা কে ভালোবেসে ফেলেছি, ওকেই আমি বিয়ে করতে চাই।”
দু-একটা জোনাকি উড়ে চলে গেল। চারদিকে চাপ চাপ অন্ধকার। রূপশালী চাঁদ পথ হারিয়ে মেঘে ঢেকে গেলো। দাঁত দিয়ে নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরল তিস্তা। ধীরে ধীরে বলল, ঠিক আছে উজান তাই হবে। সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে উজান বলল থ্যাংক ইউ তিস্তা। নিজের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ করেছি আর পারলাম না, তুমি আমাকে মুক্তি দিলে। একটু ইতস্তত করে বলল তবে কালকেই উকিলের কাছে মিউচুয়াল ডিভোর্সের অ‍্যাপ্লাই করবো ভাবছি।
তোমার আপত্তি নেই তো?
তিস্তা বলল, যে সম্পর্কে ভালবাসার অক্সিজেন নেই, সেই দমচাপা সম্পর্ক আমার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি বুঝতে পারছিলাম তুমি আমাকে নিয়ে আর ভাবছ না, তোমার ভাবনার মানুষ আলাদা। তোমাকে আমি মুক্তি দিলাম। উজানকে দেখে মনে হল, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আসামী জোড়হাতে মুক্তি ভিক্ষা চাইছে।

এই গরমেও হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল তিস্তার। জীবনের সমস্ত উষ্ণতাই এক মুহূর্তে নিভে গেল। তিস্তা অনুভব করল উজানের ওর প্রতি আর কোন ফিলিংস নেই। জীবনের রেসে সে পরাজিত সৈনিক। দীর্ঘ দাবদাহের পর ডোনাই উজানের জীবনে হু হু উত্তুরে বাতাস।

মিউচুয়াল ডিভোর্সের খাতায় সই করার পর তিস্তা উজান কে বলল আজ আমার সঙ্গে এক জায়গায় যাবে? সময় হবে? মাথা চুলকে উজান বলল, কখন? সন্ধে ছটায়, মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে উজান অফিসে বেরিয়ে গেল।

সন্ধে ছটার সময় যথারীতি নির্দিষ্ট রেস্তোরাঁতে দুজনে চেয়ারে মুখোমুখি বসলো। তিন কাপ কোল্ড কফির অর্ডার দিয়েছি। তিস্তা আর কি খাবে বলো তোমরা? বলেই পাশে চেয়ার টেনে বসল সুন্দর ঝকঝকে এক যুবক। উচ্ছ্বসিত হয়ে তিস্তা বলে উঠলো… অরণ্য সেন, এম বি বি এস ডাক্তার, আমরা বিয়ে করবো ঠিক করেছি। অরণ্য বলল আমরা কাল থেকেই একসঙ্গে থাকব ডিভোর্স হয়ে গেলে বিয়ে করবো। তাহলে আমি আসছি তিস্তা, আমার চেম্বার আছে। অরণ্য চলে গেল। কিছুক্ষণ সেদিকেই তাকিয়ে রইল তিস্তা।
উত্তেজিত হয়ে উজান বলে উঠলো, তুমি বিয়ে করবে? কই আগে বলনি তো? তুমিও তো আমাকে আগে বলনি যে ডোনা কে বিয়ে করবে। তাহলে রোদ্দুরের কি হবে? আঁতকে ওঠে উজান। সে ভাবনা আমার একার নয় ভাবলেশহীন তিস্তা। ওকে না হয় কোন হোস্টেলে রেখে দেবো। তিন বছরের একটা শিশু হোস্টেলে থাকবে! এই কাজটা তুমি করতে পারবে? তুমি না একজন মা! এতো নীচ আর স্বার্থপর তুমি! তুমিও তো একজন বাবা, তুমি পারলে আমি পারবো না কেন?

রোদ্দুর আমার কাছে থাকবে। আমি ডোনার সঙ্গে কথা বলব, ও নিশ্চয়ই আমার সিদ্ধান্তকে মেনে নেবে। তোমার মতো স্বার্থপর ও নয়। তুমি বাড়ি যাও আমি ডোনার বাড়ি যাবো,ওর সঙ্গে কথা বলে তারপর বাড়ি ফিরব।

ভোরের দিকে বাড়ি ফিরল উজান। উস্কোখুস্কো চেহারা। ঝপ করে বসে পড়ল সোফায়। তিস্তা এক গোছা চাবি টেবিলের উপর রেখে বলল ঘরের সমস্ত চাবি এর মধ্যে আছে। ডোনা এলে ওকে বুঝিয়ে দিও।
ডোনার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক শেষ করে এসেছি। ওর
মুখ আর এ জীবনে দেখবনা।
হঠাৎ মরিয়া হয়ে তিস্তার হাত চেপে ধরলো উজান।
তোমার আদুরে সুন্দর মুখটার দিকে আমি অনেকদিন তাকাইনি তিস্তা। আমাকে ক্ষমা করে দাও। আর একবার নতুন করে শুরু করা যায় না? রোদ্দুরের জন্য। আমাদের একমাত্র আদরের মেয়ে।
এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিল তিস্তা। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কের সিমেন্ট হল বিশ্বাস, ভালোবাসা… সেটাই যখন নেই তখন শুধুমাত্র রোদ্দুরের জন্য একসঙ্গে থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি কলেজের প্রফেসর। আমার মেয়ে রোদ্দুর কে আমি একাই দেখতে পারবো, তোমার প্রয়োজন হবে না। আমি চললাম। বিধ্বস্ত উজান বলল, কোথায়?
অরণ্য সেনের কাছে?
সরাসরি উজানের চোখের দিকে তাকালো তিস্তা। অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, অরণ্য সেন বিবাহিত। আমরা দুজন ভালো বন্ধু। আমরা ক্লাসমেট।
তবে যে বললে… গলা কাঁপছে উজানের।

ওইটুকু অভিনয় ছিল। আমি আমার নতুন ফ্ল্যাটে চলে যাচ্ছি। রোদ্দুরের হাত ধরে নতুন ঠিকানায় পা বাড়ালো তিস্তা।

উজানের আকাশে উড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে বাজপাখি।…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *