ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে (অষ্টাদশ পর্ব) ✒️✒️ সায়ন্তন ধর

ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে (অষ্টাদশ পর্ব)

সায়ন্তন ধর

লঞ্চে ব্রহ্মপুত্র পার করে ওপারে আইআইটি যাবো এই পরিকল্পনা করে বের হলাম কলিগদাদার সাথে। টোটো করে পৌঁছে গেলাম ফ্যান্সি বাজার। এরপর জন প্রতি পাঁচ টাকার টিকিট কেটে একটি লঞ্চে উঠলাম। মিনিট দশেকের মধ্যেই ছাড়বে সেটি। টিকিট কাউন্টারটিও একটি অব্যবহৃত লঞ্চ, জলে ভাসমান। আমাদের মতো আরও অনেক যাত্রী ওঠার পর একেরপর এক বাইক, সাইকেল উঠলো লঞ্চে। আমরা কেবিনের দিকে না গিয়ে ডেকের একদম সামনে এসে দাঁড়ালাম। আমি এর আগে তিস্তায় নৌকোতে চড়েছি, আজিমগঞ্জ-জিয়াগঞ্জের মাঝে ভাগীরথীতে চড়েছি জোড়া নৌকোয়, কলকাতায় হুগলী নদীর লঞ্চেও উঠেছি। কিন্তু ব্রহ্মপুত্রে লঞ্চে এই প্রথম। তাই ছবি তোলার সাথে সাথে মনে নানান ভাবনা এলো…

শান্ত নদীটি… মোটেও সে শান্ত নয়, দখিনা বাতাসের সাথে সখ্যতা গড়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসংখ্য ঢেউয়ে গাঁথছে ঊর্মিমালা,
সে তো নদী নয়, সে যে ব্রহ্মার পুত্র…

পটে আঁকা ছবিটি… পটে নয়, তীরে আঁকা রয়েছে ছবির মতো গ্রাম…

একটু হাওয়া নাই… কে বলেছে? স্নাত হচ্ছি ফুরফুরে বিশুদ্ধ হাওয়ায়… অক্সিজেন সমৃদ্ধ শীতল হাওয়ায় শুধু শরীর নয়, মনও জুড়িয়ে যায়…

জল যে আয়না তাই… অশান্ত জলরাশি আয়না হতে পারে না এটা ঠিক, তবে সে তো মনের আয়না… মন যেমন চঞ্চল, এই অফুরন্ত জলরাশিও চঞ্চল…

ঝিম ধরেছে ঝিম ধরেছে গাছের পাতায়… এতো হাওয়ায় পাতাদের ঝিম কেটে গিয়েছে, তবে কিনা এত দূরে ওরা, আপেক্ষিক ভাবে মনে হচ্ছে ওরা স্থির…

পাল গুটিয়ে থমকে গেছে ছোট্ট তরীটি… হ্যাঁ, এতক্ষণে একটা ঠিক কথা… ওই যে দূরে ছোট্ট তরী, ওর মাঝি কিন্তু সত্যিই এই পরিবেশ উপভোগ করছে, তাই তার তাড়া নেই তীরে পৌঁছোনোর…

আহা ছোট্ট তরীটি… শান্ত নদীটি…

উড়ছিল ঘুড়ি গাছটি ডিঙিয়ে… তাই? চোখে পড়েনি তো… হয়তো, হয়তো নয়… দেখতে পাইনি যে…

বন্ধ বাতাসে পড়লো ঝিমিয়ে… বাতাস তো বন্ধ হয়নি, তাহলে তো উড়তে থাকারই কথা… তাহলে হয়তো যে ঘুড়ি ওড়াচ্ছিলো তার আর ঘুড়ি ওড়ানোয় মন নেই… সেও হয়তো প্রকৃতির রূপ উপভোগে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে…

ক্লান্ত সুরে ডাকছে দূরে ঘুঘু পাখিটি… এই তো আরও একটা সঠিক কথা… কি ব্যাপার? প্রতিটি স্তবকের শেষ পংক্তিটির সাথে মিল থাকছে… সত্যিই এই দুপুরে ঘুঘু পাখি বড়ই ক্লান্ত সুরে ডাকে, আজও ডাকে, এখনও ডাকছে, হয়তো দূরের ওই তীরভূমি থেকে…

আহা ঘুঘু পাখিটি… শান্ত নদীটি…

দুষ্টু ছেলেটা গরমে ঘামে… আমি দুষ্টু ছেলে? আচ্ছা, ঠিক আছে, কিন্তু আমি তো গরমে ঘামছি না, এই প্রাকৃতিক এসিতে একটুও ঘাম হয়না…

নদীর ঘাটে জলেতে নামে… আবারো ঠিক, নামিনি এখনও, তবে নামবো তো অবশ্যই, তীরে পৌঁছোতে দাও… ব্রহ্মপুত্রকে একবারটি ছুঁয়ে দেখবো না, তাও কি হয়?…

আহা, গরমে ঘামে…

জমছে কালো মেঘ, অন্ধকার ঘনায়… নাহ্ প্রথম পংক্তিগুলো কিছুতেই ঠিক হচ্ছে না… ঘন নীল আকাশে একটু আধটু সাদা মেঘ ভাসছে ঠিকই, মেপে নিলাম জল— বুঝলাম, তাদের জল ভরা এখনও অনেক বাকি…

তাই দেখে মাঝি আকাশে তাকায়… আকাশে তাকায় হয়তো, আকাশের ওই নীলে ছড়িয়ে দিতে নিত্যদিনের যাপনব্যথা।

ক্রুদ্ধ ঝড়ে উঠবে নড়ে স্তব্ধ প্রকৃতি… হ্যাঁ যখন ঝড় উঠবে, প্রকৃতিকে তো নড়েচড়ে বসতেই হবে… ব্রহ্মপুত্রের ঘোলাটে জলে ঢেউ উঠবে আরও বড়, খোলামকুচির মতো দুলবে বড় বড় লঞ্চ… তীরের নারকেল গাছগুলো মাথা নাড়বে পাগলের মতো… হ্যাঁ, এই লাইনটিও ঠিক কারণ… এটা ভবিষ্যতের কথা বলছে…

আহা স্তব্ধ প্রকৃতি… শান্ত নদীটি…

মিনিট পনেরোর যাত্রা শেষলগ্নে, ঘোলাটে জলে কচুরিপানা দামকে কাটিয়ে লঞ্চ যখন মাজগাঁও ঘাটে ভিড়বে ঠিক তখনই দেখলাম আর একটা লঞ্চও এগিয়ে চলেছে একই দিকে। ওটা আসলে ভাসমান জেটি। প্রথমে জেটি ঘাটে ভিড়লো তারপর তার গায়ে আমাদের লঞ্চ। যাত্রাপথে একদিকে দেখতে পেলাম একটি নির্মিয়মান ব্রীজ, হয়তো ভবিষ্যতে এই ফেরী সার্ভিস শুধুই বিনোদনের জন্য থাকবে, চলার পথে গতি আনতে ব্যস্ত মানুষ ব্যবহার করবে সেই ব্রীজ। অপরদিকে দূরে উমানন্দ মন্দির আবছা দেখতে পেলাম। যেহেতু আমি যাইনি, তাই এ সম্পর্কে বেশি কিছু বলছি না, হয়তো পরে কোন পর্বে বলবো। তবে শুনেছি এটি উমানন্দ নদী-দ্বীপে অবস্থিত। অর্থাৎ এখানে যেতে হলে একমাত্র নদীপথ ভরসা। ফ্যান্সিবাজার ঘাটটিতে সারি সারি লঞ্চ, ছোট জাহাজ, নৌকো রয়েছে। বেশ জমজমাট। মাজগাঁও ঘাট একেবারেই নির্জন। ঘাটের দুই তীরে জারুল গাছের সমারোহে ঘোলাটে জলেও বেগুনী আভা মিশেছে। ঘাটে নেমে ব্রহ্মপুত্রের জলে হাত ছোঁয়ালাম একটু। তারপর একটা টোটো ধরে সোজা আইআইটির ফ্যাকাল্টি গেট। ভিতরে প্রবেশ করেও হাঁটতে হবে অনেকটা কিন্তু হাতে দুশোটি হারবেরিয়ামের ওজন নিয়ে হেঁটে যাওয়া মুশকিল। একজন কলিগবন্ধুকে ফোন করলাম, ও অপেক্ষা করতে বললো, স্কুটি নিয়ে আসবে। চোখে পড়লো একটা নীলিগুলমোহর গাছ, গাছের তলটা নীল হয়ে রয়েছে ঝরাফুলে। এরপর স্কুটিতে করে তিনজনে চললাম অফিসের উদ্দেশ্যে। যাত্রা পথে গুলমোহর, কনকচূড়া, লাল সোনাইলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলাম। অফিসে পৌঁছে আরও এক সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিল। আমাদের এক কামরার অফিস নতুন বিল্ডিংএ শিফ্ট হয়েছে, কর্পোরেট লুক পেয়েছে। গেস্টদের বসার জন্য আলাদা অভ্যর্থনা কক্ষ। ইনোভেশনগুলিকে ডিসপ্লে করার জন্য আলাদা কাঁচের ঘর। হার্বেরিয়ামের চেম্বারে তাক যুক্ত ক্যাবিনেট। সবকিছু একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে চলে এলাম পুরনো ঘরটিতে। এবার অপেক্ষা ডিরেক্টর স্যারের জন্য।

(ক্রমশঃ)

1 thought on “ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে (অষ্টাদশ পর্ব) ✒️✒️ সায়ন্তন ধর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *