৬০ টাকায় বাংলাদেশ – আমার অন্য পথ ~ শান্তনু ঘোষ পর্ব-৬

৬০ টাকায় বাংলাদেশ – আমার অন্য পথ
~ শান্তনু ঘোষ
পর্ব-৬
আগে যা ঘটেছে:
দর্শনা হল্ট ষ্টেশন থেকে বেনাপোল এক্সপ্রেস ধরে চলেছি ঈশ্বরদী। ট্রেনে একটু ভিড় আছে। আমার সীট রিজার্ভ করা ছিল জানালার পাশে। সেখানে বসতে গিয়ে দেখি মাস্ক আর হিজাব পরা এক তরুণী সীট দখল করে বসে আছে। তাকে অনুরোধ করলাম সীট ছাড়তে। তিনি স্মার্ট উত্তর দিলেন, যে তিনি ওখানেই বসবেন, আমাকে বললেন পাশের সীটে বসতে। আমি আর কথা না বাড়িয়ে। বাধ্য ছেলের মত তাই করলাম।

তারপর…

দর্শনা ষ্টেশন থেকে ছেড়ে বেনাপোল এক্সপ্রেস চলছে ঢাকার উদ্দ্যেশে। আমি অবশ্য মাঝপথে, মানে ঈশ্বরদী ষ্টেশনে নেমে যাব। আমার ঢাকা যাবার পরিকল্পনা আছে, তবে পরে। তার আগে কদিন পাবনায় কাটিয়ে নেব।

খুব যে নিখুঁত পরিকল্পনা করে বাংলাদেশ ভ্রমণে এসেছি ঠিক তা নয়। অনেকদিন ধরেই ইচ্ছে ছিল। হঠাৎ যেন সব কিছু মোটামুটি এক রেখায় এসে গেল, আর তারপরেই বেরিয়ে পড়লাম আরকি।

পাবনা যাবার প্রধান কারণ শিলাইদহে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠি বাড়ি দেখার প্রবল ইচ্ছে। তার সাথে লালন সাঁইয়ের মাজার। আর আমার সৌভাগ্য যে, এই সময় কৌস্তভ পাবনাতেই আছে। আমার প্রথম পদার্পণ অনেকটা সহজ হচ্ছে।

আসলে আমরা যেখানেই ঘুরতে যাই না কেন, দিনের শেষে একটা নিশ্চিন্ত আশ্রয়ের ব্যবস্থা যেন থাকে, এই ভাবনা মনের ভিতরে সব সময় কাজ করে। সাধারণ মানুষ আমরা, সব সময় একটা সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ তৈরি করে রাখা আমাদের স্বভাব। তাই তো বীমা কোম্পানি গুলি করে খাচ্ছে। যেখানে অনিশ্চয়তাই মূলধন।

ট্রেন ঠিক সময়েই চলছে। আমি ভেবেছিলাম হয়ত দেরী করবে। কিন্তু না ভালই যাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় বাংলাদেশের ট্রেনের যে ছবি দেখেছিলাম, তাতে আমি রীতিমত আতঙ্কিত ছিলাম, এই ভেবে, যে এত ভিড় হবে তাতে না ট্রেনের ছাদে উঠে যেতে হয়। আমার এই যাত্রার বাস্তব অভিজ্ঞতা সেই ধারণা বদলে দিল। যাত্রীরা বেশ ভদ্র সভ্য।

জানালার ধারে বসতে না পারলেও, জানালা দিয়ে বাইরেরে দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি। সবুজ সবুজে ভরা আমার বাংলাদেশ। হ্যাঁ, আমার, আমার বাংলাদেশ!!

নিয়তির খেলা আর কিছু দুষ্টের শয়তানির পাকে-চক্রে আজ দেশ ভাগ হয়েছে। কিন্তু কোথাও পূর্বপুরুষের দেশকে আজও মনের গহনে নিজের দেশ বলেই মনে হয়। যত দেখছি, ততই দেশ ভাগের “আমার-না-ভোগ-করা-যন্ত্রণা” টা যেন বিনা নোটিসে গজিয়ে ওঠা এক বিষ ফোঁড়ার মত হৃদপিণ্ডে কষ্ট দিচ্ছে।

ভাবছি এই তো কিচ্ছুক্ষণ আগেই তো কলকাতায় ছিলাম, কয়েক ঘন্টার মধ্যেই আমি পাবনায়। কি আর এমন দূর। শিয়ালদহ থেকে শিলাইদহ – এমন কোন দূর তো নয়। কিন্তু আজ দুটো ভিন্ন দেশ। ভিন্ন ভাবনা। ভিন্ন দর্শন। ভিন্ন জীবনধারা।

সেই একই বাঙ্গালী। যার একক শক্তি একদিন ইংরেজকে এমন ভীত করেছিল যে, সে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল বাঙ্গালীর মধ্যে যে করেই হোক এক ফাটল তৈরি করতে। শেষ পর্যন্ত বেশ ভালো ভাবেই সফল হল। তার ফল তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। আর এটাও বলছি যে, বাঙ্গালীকে টুকরো টুকরো করার ষড়যন্ত্র আজও সক্রিয়। এমন ধারা চললে ভবিষ্যতে আরো দুখেঃর দিন দেখতে হবে। আমরা অস্তিত্ব হীনতায় পড়ব। কারণ বিভেদকামী শক্তিগুলি বেশ মদত পাচ্ছে।

আমার স্বভাব, নতুন জায়গায় গেলে আমি সেখানকার লোকজনের সাথে গল্প করি, একরকম গায়ে পরেই। তাতে অনেক কিছু জানা যায়, যা লোনলি প্ল্যানেট-এ লেখা থাকে না।

আমার পাশে যে তরুণী বসে, তার চোখদুটো ছাড়া মুখের আরা কিছুই দেখা যাচ্ছে না। একরকম বাচ্চা মেয়েই বলা চলে, আমার ছেলের বয়সী হবে।
জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কোথায় যাবেন?
খুব সংক্ষিপ্ত উত্তর, ঈশ্বরদী।
আমি বেশ খুশি হলাম। যাক বাবা। ঈশ্বরদী ষ্টেশন কখন আসবে, কখন নামব, এসব নিয়ে আমার আর ভাবতে হবে না। এনাকে অনুসরণ করলেই হবে।
আমি বলি, বাঃ, আমিও তো ঈশ্বরদী যাব।
জানালার দিক থেকে মৃদু হাসি। সেটা সরাসরি দেখা গেল না। চোখ দুটো একটু ছোট হল তাতেই বুঝলাম।

প্রথম আদান-প্রদানে বুঝলাম, যে ইনি মুখ ঢেকে রাখলেও, মুখ বন্ধ করে রাখবেন না।
আমার তো আরো কথা বার করতে হবে। তাই আবার গায়ে পরে কথা বলা শুরু করি।
আপনি ঈশ্বরদীতে থাকেন নাকি ?
উনি বললেন, না, বাড়ি দর্শনাতে। ওখানে কলেজে পড়ি।
– ওহ। বেশ তো। কি নিয়ে পড়ছেন?
– ভূগোল।
– কোন ইয়ার?
– থার্ড ইয়ার।
– ভূগোল কেন পছন্দ করলেন ?
– ভবিষ্যতে টিচার হবার ইচ্ছে।

কথা বেশ এগুচ্ছে। পোশাক দেখে যেমন রক্ষণশীল ভেবেছিলাম, এনি তেমন নয়। বেশ স্মার্ট।
নাম বলল, ইয়াসমিন। আমিও আমার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিলাম।
আমি বেশিক্ষণ আপনি বলতে পারি না। অনেকে খুব সুন্দর ভাবে সেই ভদ্রতাটা রক্ষা করতে পারে। কিন্তু আমার সেই সুন্দর স্বভাবটা নেই।
আমি ইয়াসমিন এর অনুমতি নিয়ে বলি, তুমি মুখে মাস্ক পরে আছো কেন। কোভিড হচ্ছে নাকি এখানে?
– না না। ধুলো ময়লা থেকে বাঁচতে।
– বাঃ ! দারুণ যুক্তি !

এদিকে এক ফেরিওয়ালা ঝুরি ভাজা ধরনের কিছু বিক্রি করছে। বাংলাদেশের ঝুরি ভাজা কেমন খেতে লাগে, পরখ করে দেখার জন্য আমি দুটি প্যাকেট কিনি।
একটা আমার আর একটা ইয়াসমিনের জন্য।
না না, সে তো নেবেই না।
বলে কী না, আমি বাইরের জিনিস খাই না।
আমি বলি, দেখ এটা একদম, বাইরের জিনিস নয়। পুরো ভিতরের জিনিস।
এই বলে আমি ওকে দেখালাম যে খাবারটা প্লাস্টিকের প্যাকেটে মোড়া আছে। মানে ভিতরেই আছে। অর্থাৎ ওটা হল ভিতরের জিনিস, বাইরের জিনিস নয়।
এই কথায়, ইয়াসমিন হেসে ফেলল। আমিও হাসলাম।
যাই হোক এবার ওর হাতে দেওয়া গেল।

আমি জিজ্ঞেস করি, তুমি মাস্ক না খুলে কি করে খেতে হয় জানো ?
ও বলে, না তো ! কি করে খায় ?
আমি বলি, আমিও জানি না।
আবার হাসি।

ওরা তিন বোন। ভাই নাই। ও ছোটো। ছুটিতে বাড়ী এসেছিলো। এখন কলেজে ফিরছে। ঈশ্বরদীতে এক জায়গায় পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকে।

টুকটাক কথা হচ্ছে। ইন্ডিয়ায় কখনো যায়নি। তবে ইচ্ছে আছে। জানালো যে নিজের দেশটাই তো এখনো দেখা হয়নি। বাংলাদেশে ভারতবর্ষকে সাধারণ ভাবে সবাই ইন্ডিয়া বলে।

দেখলাম ভারতের কিছু ঘটনা বিষয়ে টুকটাক জানে। কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম, স্কুলে তোমাদের ইতিহাসে অবিভক্ত ভারতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে কি কিছু পড়ানো হয়?

ইয়াসমিন জানালো, আলাদা করে ইতিহাস বই বা বিষয় হিসেবে ঠিক তেমন কিছু নেই, তবে ক্লাস এইট অবধি সাধারণ জ্ঞান একটি বিষয় আছে। তাতে ১৯৪৭ এর আগের ঘটনা খুব সামান্যই আছে।

বাংলাদেশ মনে হয় ১৯০৫ –এ কার্জনের বঙ্গভঙ্গ থেকে ইতিহাস কে বেশী গুরুত্ব দেয়। কার্জন খুব বুঝেশুঝেই এই বঙ্গভঙ্গ করে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভেদ তৈরি করেছিল। যদিও সেই বঙ্গভঙ্গ তখনকার মত রদ হয়েছিল। এর পেছনে লর্ড হার্ডিঞ্জ এর ভুমিকা ছিল। কিন্তু সেদিনের ও আজকের বাংলাদেশের অনেকেরই এই বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়া বেশ অপছন্দের চোখে দেখেন। তবে হ্যাঁ বিভাজনের বীজ কিন্তু রোপণ করা হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশে কার্জন বেশ সম্মানীয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি হোস্টেলের নাম কার্জন হল ।

এর পরের গুরুত্বপূর্ণ সাল হল ১৯০৬। এই বছর, ৩০শে ডিসেম্বর মুসলিম লীগের আবির্ভাব হয়। মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা স্যার সলিমুল্লাহ বাংলাদেশে একজন পূজনীয় ব্যক্তি। বলা হয় যে এতদিন জাতীয় কংগ্রেস স্বাধীনতা সংগ্রামের একমাত্র মুখ ছিল। কিন্তু সেখানে মুসলিমদের আলাদা জায়গা তো ছিল না। তাই মুসলিমদের নিজদের জন্য মুসলিম লীগ তৈরি হল।

তারপরেই বাংলাদেশের ইতিহাসের আর এক গুরুত্বপূর্ণ হল বছর ১৯৪০ সাল। লাহর প্রস্তাব। কারণ মুসলিমদের জন্য আলাদা দেশ (বা ভবিষ্যতের বাংলাদেশ) গঠনের স্বপ্ন দেখা শুরু হল। এ কে ফযলুল হক এই লাহর প্রস্তাবের উদ্গাতা। তিনি বাংলাদেশের এক প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তি। তাঁকে এই দেশে শেরে বাংলা খ্যাতি দেওয়া হয়েছে।

বোঝাই যাচ্ছে ভারতের মত বাংলাদেশেও সরকার বা বড় মাথারা ঠিক করে দেয় সাধারণ মানুষ কোন ইতিহাস বা কতটুকু ইতিহাস জানবে।

এর মধ্যেই দেখছি হার্ডিঞ্জ ব্রিজের উপর দিয়ে ট্রেন চলছে। আজকের বাংলাদেশের গর্ব – পদ্মা সেতু – হবার আগে পদ্মা নদীর উপরে এইটাই একমাত্র ব্রিজ ছিল। ইংরেজদের বানানো। এইখানে ব্রিজ তৈরির পেছনে একটি কারণ যে এইখানে পদ্মা সব থেকে কম চওড়া। আর ঢাকার কাছে।

কিছুক্ষণ পরেই ট্রেন ঈশ্বরদী ষ্টেশনে ঢুকল। আমি আর ইয়াসমিন নামলাম। ঈয়াসমিন কে বিদায় জানিয়ে আমি আমার পথ ধরি।

ক্রমশঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *