পেয়ালা – পিরিচ / গল্প ( তৃতীয় অংশ ) গীতশ্রী সিনহা

পেয়ালা – পিরিচ / গল্প ( তৃতীয় অংশ )

গীতশ্রী সিনহা

এবার ফেরার পালা। স্টিয়ারিং – এ বসে বৃষ্টি। গুনগুন করে গান গাইতে থাকে উপমা, বৃষ্টিও গলা মেলায়…
——- হ্যাঁ বল উপমা, আজকের এই উপমা মিত্র হলি কি করে ?
লড়াই, নিজের সাথে নিজের লড়াই — থেকে থেমে উত্তর দেয় উপমা। সেই সাদামাটা আটপৌরে মেয়েটি অনেক যন্ত্রণা বুকে জমিয়ে ফিরে এলো বাপের বাড়ি। চারিদিকে বিদ্রুপের চাপা অট্টহাসি তাকে লক্ষ্য করে। অপমান – অপবাদের কাদায় নামতে হয় প্রতিনিয়ত। উপমা বলতে থাকে, তুই তো সবই জানিস বৃষ্টি, শুধু একটা দিন তোর – আমার দেখা না হলে কতো কষ্ট হতো আমাদের ! স্কুলে সবাই বলতো বৃষ্টি – উপমা, বাড়িতে পাড়ায় আমরা ছিলাম টুপুর – জয়ি। কিন্তু, আমার এতো বড় বিপর্যয়ে আমি তোকে ছাড়াই কাটিয়েছি।
সব মনে আছে রে আমার উপমা, —- মাসিমার মুখে শুনেছি বিয়ে হয়ে এসেছিলেন ওই ভাড়া বাড়িতে, সম্পূর্ণ বাড়িটা দশ কাটার উপর… এখনও চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই , প্রকান্ড গেটের পর অনেকটা বাগান, তারপর বিশাল লম্বা বারান্দার পর ঘর শুরু। অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে পর পর বেশ ক’টি ঘরের মধ্যে তোর একটা পড়ার ঘর ছিল। বৃষ্টিকে থামিয়ে উপমা বলে, সেই ছোট্ট অন্ধকার ঘরে একলা বসে কতোদিন ভাবতে ভাবতে ভুরু কুঁচকে উঠেছে আমার ! একটা প্রশ্নে বারবার নিজের কাছে নিজেকে বিব্রত হতে হয়েছে রে ! ‘ জয়ি ‘ এই নামটা খুবই বেমানান – অস্বস্তিকর ! সুশ্রী জয়ির জীবনে কানাকড়ি জয়ের দাক্ষিণ্যও দেখা দেয়নি তখন। ভাবতাম, জীবনের শুরু থেকেই হেরে চলা যার অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে, সেই জয়ি জন্ম মুহূর্ত থেকেই যেন পরাজয়ের অভিশাপ নিয়ে জন্মেছে। আমার দাদার পর দুই দিদি, এখানেই তো আদর্শ পরিবারের পূর্ণচ্ছেদ হতে পারতো ! হাল্কা হেসে উপমা বলে, — কিন্তু না, তা হয় কি করে ! দাদা সবেধন নীলমণি, শিবরাত্রির সলতে, বংশের সলতে মজবুত করতেই তো আরও একটি ছেলের প্রত্যাশায় জয়ি নামক কন্যা সন্তানের আবাহন। অবশ্য, তারপর জয়ির একটি ভাই হয়, আর সাথে সাথে সংসারের নিয়ম অনুযায়ী একটু যেন আলাদাভাবে বড় হতে থাকে জয়ি।
উপমা প্লিজ, আজ আর…
থামিয়ে দেয় বৃষ্টিকে উপমা।
কপট রেগে বৃষ্টি বলে, উপমা আজ তুই সমাজের প্রতিষ্ঠিত মহিলাদের মধ্যে একজন। কারও দাক্ষিণ্যে বা করুণায় তুই প্রতিষ্ঠা অর্জন করিস নি, উপমা তুই আমার অহংকার রে !
নারে বৃষ্টি, জন্মলগ্ন থেকে ধেয়ে আসা… সারাজীবন ধরে বয়ে নিয়ে চলতে বাধ্য, আমি বড় ক্লান্ত – অবসন্ন রে।
আমরা যখন স্কুলে, তখন তোর দিদিদের বিয়ে হয়েছিল। তাই নারে উপমা ?
একটু অন্যদিকে কথা ঘোরাবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল বৃষ্টি।
বিষন্ন হাসে উপমা।হাসির বিষাদ জড়িয়ে যায় পরের কথায়। হ্যাঁ , দিদিদের বিয়ের পর থেকেই পড়ার চাপের সাথে সংসারের চাপও চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। দাদা লক – আউটে আক্রান্ত, বাবার অল্প পেনশনে সংসারের চাকা আটকে যায়। ডুবে যায় বেলা শেষের ঝলসানো চড়া রোদ,নেমে আসে অদ্ভুত কিম্ভুত অন্ধকার। সেই অন্ধকার খুঁড়ে অশালীন ভঙ্গিতে আঙুল তুলে কে যেন প্রশ্ন করতে থাকে —— এরপর ? এরপর সামনে তোমার অনেকটা পথ !
—— তোর জয়ি লড়াই চালিয়ে গেছে, নিজের সাথে নিজের লড়াই, বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসার প্রস্তুতি, তারসাথে অনিবার্য ভাবে কিছু কোর্স করে নিতে থাকলাম। শুধু সাহায্য করেছে আমার মেধা, না হলে… না হলে উপমা মিত্র আজ এখানে পৌঁছাতে পারতো না রে টুপুর ! প্রথমটায় একটি বাণিজ্যিক সংস্থার টেকনিক্যাল এসিস্ট্যান্ট পদে যোগ দিই , অবশ্য অস্থায়ী পদ। বেতন তেমন উল্লেখযোগ্য ছিল না। আকর্ষণীয়া – সুন্দরী অথচ দৈনন্দিন জীবনের সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে ক্লান্ত আমি তখন খুবই সাদামাটা মামুলি মেয়ে। পায়ের তলার মাটি শক্ত করার বীভৎস দীর্ঘশ্বাস দৌড় ! জয়ের উদগ্র খিদে অনেক সময় মানুষকে আমূল-পরিবর্তন করে দেয়। বাইরে থেকে দেখলে একজন মানুষকে যেমন দেখায়, ভেতরে তখন সে সম্পূর্ণ আলাদা,অন্য একজন হয়ে ওঠে। জয়ের জন্য ব্যগ্রতা আমার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি কে বদলে দিতে থাকে।
টুপুর ! টুপুর ঠিক এই সময়ে বিজন মিত্র, এলাহাবাদের প্রবাসী বাঙালি, বিদেশ থেকে এনিমেশন কোর্স করে… এদেশে বড় মাপের একটি এনিমেশন স্টুডিও তৈরি করে। অবশ্যই সাথে ওজনদার চাকুরি।
——- সোজাসুজি বিয়ের প্রস্তাব দেয়।
আরে boss ! ইন্টারেস্টিং রে ! জয়ি বল, বল রে!
উপমা সাঁতরে চলেছে পিছনের দিকে ক্রমাগত, আনমনে বলে… আমার সেই সময়ের বর্তমান অনেকটাই গড়ে তুলেছিলাম অতীতের ওপর নির্ভর করে। না চাইলেও নাছোড়বান্দার মতো অতীত ছায়া ফেলতে থাকে পলাতক হাতিয়ারবিহীন যুদ্ধের সুড়ঙ্গপথের দিকে।
বিজন আমার অনেক কথাই বুঝতে পারতো না। যখন বিয়ের প্রস্তাব দেয় আমাকে, বলেছিলাম আগে আমার সব কথা শোনার সময় দাও।
কোনো কথা না শুনে বিজন শুধু বলে, আই লাভ ইউ উপমা। এক জীবনে কতোটুকু জানা যায় ! আমি যে জানতে চাই না উপমা !
—— আবার সেই প্রেম ? আই লাভ ইউ ! উপহাসের ভঙ্গিতে বৃষ্টি…
—– ঐ কথাটা বলতে পেরে খুশি হয়েছিল বিজন। অনেকদিন নিজের ঘরে, আয়নার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রিয়ার্সেল দিয়েছে।
—– তুই জানলি কি করে ?
—– পরে শুনেছি।
—– মানে ? বিয়ে হয়েছিল তোদের ?
—– ঐ সময় বেঁচে থাকার নিয়মে বেঁচে ছিলাম ! দ্বৈত সত্তা থাকায় মনের ভিতর দুটি ‘ আমি ‘ পাশাপাশি চলে… তাই সহজে প্রেমে পড়তে পারিনি। ভালো – মন্দ বাছাই করার সময় ছিল না।
—– উফ ! বল না… তারপর !
—– একদিন বিজন বললো, প্লিজ উপমা, প্লিজ মনটা শান্ত করো, হ্যাঁ বলো আমাকে উপমা । দেখো উপমা, আয়নার ওপর বাইরের সব ছবিরই প্রতিবিম্ব পড়ে, তাই বলে কি আয়নায় চিড় ধরে ! আয়নাকে উদারতায় মুড়ে রাখতে হয়।
—— তারমানে ! তারমানে তুই উদার হলি জয়ি ?
—— হ্যাঁ রে, অবশেষে ! একটু থেমে আবার বলে উপমা, বিজন কিন্তু দুর্দান্ত প্রেমিক ছিল। অসম্ভব প্যাশানেট। ও আমার ভিতরটা পড়তে চাইতো, আমাকে ভালো রাখার জন্য।
একটু সময় চুপ থেকে উপমা চোখ বন্ধ করে বলে… থ্যাংকস বিজন, আমাকে বেশ কিছু এক্সাইটিং মোমেন্টস গিফট করার জন্য।
গভীর দীর্ঘশ্বাস নিরাপদে লুকিয়ে বৃষ্টি বলে, —- এ এক পরম প্রাপ্তি !
কখনো কখনো মুহূর্ত ভরে যায় সুগন্ধে… কাঙ্খিত সুখ যেন আপনা থেকে ধরা দেয়। আনমনে উপমা বলে চলে — সে একটা সময় ছিল যখন লোকে চোখ ফেরাতে পারতো না আমাদের থেকে। চাকরির ব্যস্ততার মধ্যেই একটু – আধটু চুরি করে প্রেম জুটে যাচ্ছিল আমাদের কপালে ! বিয়ে হয় অনুষ্ঠান ছাড়াই। চেয়েছিলাম বিজনের সাথে চুটিয়ে জীবনকে প্রত্যক্ষ করবো।
—– করেছিস ?
—– হ্যাঁ, কিন্তু ধরনটা আর পাঁচটা মেয়ের মতো নয়। দক্ষ কর্মক্ষমতা, আত্মপ্রত্যয় বিজনকে ক্রমশ উন্নতির হাতছানি তাড়না করতো। আরও বড়, আরও উন্নতি… এইভাবে বিজন ছুটে চলতো নতুন নতুন চাকরির ব্যস্ততায়। এইভাবেই একবার চাকরি ছেড়ে আমাকে নিয়ে চলে যায় গোয়ার এক গ্রামে। যেখানে বাংলোটা ছিল কুঁড়ে ঘরের আদলে। পাশেই সমুদ্র। সমুদ্রের জল ছুঁয়ে সকালে হাঁটা। জেলেদের সাথে বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেছিল আমাদের। মাছ নিতাম ওদের থেকে। ছুটির দিনগুলো ছিল ভিন্ন স্বাদের। আহা কি জীবন ! দিন শুরু আর শেষ হতো সমুদ্রকে সাথে নিয়ে।
—— চলে এলি কেন রে জয়ি ? তামাটে জীবন কাটাতে ?
—– টুপুর ! এই টুপুর ! জানিস, ছুটির দিনে পাড়ে রাখা নৌকায় বসে আমরা বিয়ার – ফেনি মাছ ভাজা দিয়ে খেতাম… সমুদ্র বার বার আসতো আমাদের কাছে, আমরাও ফিরে ফিরে যেতাম সমুদ্রের ফেনায়িত লাবণ্যের মোহে। নিজেদের মধ্যে বুঁদ হয়ে থাকতেই অভ্যস্ত ছিলাম। বুঝতাম, গ্রামবাসী জেলেরা আমাদের খুব একটা সুস্থ ভাবতো না ! তারপর… তারপর বাঁধনছাড়া ঢেউ এর শব্দ শুনতে শুনতে দিনশেষে ঘুমিয়ে পড়তাম।
অপলকভাবে তাকিয়ে থাকে বৃষ্টি…
—— আমাদের খামখেয়ালিপনার জন্য চাকরি জীবনে দু’জনেরই ধারাবাহিকতা বজায় থাকে না তেমনভাবে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমরা একটু সচেতন হতে শুরু করেছিলাম। মিশর তখন বড় হচ্ছে।
বৃষ্টি উপমাকে থামিয়ে প্রশ্ন করে , হ্যাঁরে, মেয়ের এইরকম নাম রেখেছিলি কেন রে ?
—— মিশর ইজিপ্টে জন্মায়, তখন আমাদের পোস্টিং ইজিপ্টে।
গাড়ি জানলার বাইরে চোখ রেখে বেশ কিছু সময় চুপচাপ।
বৃষ্টি বলে ওঠে, কিরে স্মৃতি গুলো বুঝি হ্যাঁচকা টানে টাগ অব ওয়ার চালিয়ে যাচ্ছে ???? হাসতে থাকে উপমার দিকে তাকিয়ে।
—— আয়ুর সীমানা কেউ জানে না , অখন্ড নীরবতা… সেই নিথর নৈঃশব্দের হাত ধরে ঢুকে পড়লো কিছু অস্বস্তিকর এলোমেলো হাওয়া, যা মুহূর্তে ওলট-পালট করে দেয় এতোদিনের লালিত নিশ্চয়তার চেনা ছক।
দিনটা ছিল সতেরো নভেম্বর। কার এক্সিডেন্ট। বিজন তখন আটচল্লিশ বছরের ইয়াং ম্যান।

আগামী অংশ পাঠকের অনুরোধে প্রকাশ করবো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *