মিরুজিন আলো (পর্ব বারো)✒️✒️ বিজয়া দেব

মিরুজিন আলো (পর্ব বারো)

বিজয়া দেব

জগবন্ধু ড্রয়িংরুমে ঢুকে কাঁধের পোঁটলা নামিয়ে বসল। চারদিকে তাকিয়ে বলে – দাদাবাবু কি একাই থাকেন?
-এক বুড়ি পিসি আছে। সারাদিন কোমরব্যথা আর কোঁকানো।
-এ্যাই কার কাছে আমার নিন্দে করছিস?
রাঙাপিসি এসে দাঁড়িয়েছে। জগবন্ধুকে সোফায় বসে থাকতে দেখে রাঙাপিসি গম্ভীর হয়ে গেল। জগবন্ধু পোঁটলাটা সোফায় তার পাশেই রেখেছে। সেদিকে বিশেষ দৃষ্টিপাত করল রাঙাপিসি। তারপর পারিজাতের দিকে তাকিয়ে বলল-এ কে? ঠিক চিনলাম না?
পারিজাত একমুখ হেসে বলে – ছোট বকুলপুরের যাত্রী।
জগবন্ধু হা হা করে হাসে। স্পষ্টতই বিরক্ত হয়ে রাঙাপিসি দাঁড়িয়ে আছে। পারিজাত বলে – তুমিও বসো না। গল্পগাছা হোক।
-আমি তো আর তোর মত পাগল নই।
-তুমিও হতে পারতে রাঙাপিসি আমার মনের মত পাগল..কিন্তু আফশোষ হলে না।
জগবন্ধু আবার হা হা করে হাসে।
রাঙাপিসি কটমট করে তাকিয়ে বলে – এ-ও পাগল দেখছি। রতনে রতন চেনে।
বলে ঘর ছেড়ে চলে যায়।
-দাদাবাবু, এই পিসি তোমার মনের মত নয় গো।
পারিজাত এবার আর হাসল না। তার পরিবর্তে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।
জগবন্ধু এবার সোফা ছেড়ে মেঝেতে বসে পড়ে। পোঁটলাটা মেঝেতে নামিয়ে রাখে।
পারিজাত ব্যাপারটা দেখে নিজেও মেঝেতে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে পড়ে।
জগবন্ধু হা হা করে ওঠে।
পারিজাত বলে – ওসব ছাড়ো তো। আগে বলো, জুহিদের বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছ কেন?
-সময় এলে বাঁধন কাটতে হয় গো দাদাবাবু।
-কোথায় যাবে?
-মহল্লায় বাবু। যেখানে আমার মা থাকত। ঐটাই আমার একমাত্র ঠিকানা দাদাবাবু। পারুলের কথা শুনে জুহিদিদি আমার সাথে ঠিকমত কথা বলছে না। আর জুহিদিদিকে আমি বড্ড ভালবেসে ফেলেছি। যেন ছোট্ট বোন আমার। ও আমাকে আগের মত বিশ্বাস করতে পারছে না।
-পারুল কে গো?
-আমাকে বিশ্বাস করে আমার হাত ধরে গাঁ থেকে এসেছিল। কিছুদিন আমরা একসাথে ছিলাম স্বামী স্ত্রীর মতই। কিন্তু মাঝখানে দালাল ছিল তো। আমি তো তাদের নির্দেশ মতই চলছিলাম। একদিন ওকে আমার মহল্লায় ঢোকাতে হল। পারুল আমাকে ভালবেসে ফেলেছিল। তো একদিন কড়িকাঠে ঝুলে পড়ল।
পারিজাত বলল-ওখানে আবার ফিরে যাচ্ছ কেন জগতদা। তুমি এখানেই থেকে যাও। অনেক খালি ঘর পড়ে আছে। ওসব পাপকাজে আর থেকো না।
-ঐটাই আমার জায়গা দাদাবাবু। ঐ খারাপ কাজটাই আমার কাজ। আপনার পিসি আমাকে মেনে নেবেন না।
-সে আমি দেখব জগত ভাই।
-সে হয় না দাদাবাবু।
-তুমি আমার ফুলবাগানে মালি হবে।
-ও কাজ আমি জুহিদিদির বাড়িতে করেছি। তবে আমি এখানে থাকতে পারব না পারিজাত দাদাবাবু।
-তাহলে তুমি জুহিদের ওখানে ফিরে যাও।
-না সে – ও হয় না।
-ওখানে আর ফিরে যেও না জগতদাদা। তোমাকে নতুন করে বাঁচতে হবে।
জগবন্ধু মনে মনে
ভাবে – বলছ বটে দাদাবাবু, কিন্তু ভদ্দরলোকদের সাথে বাঁচাটাও কম হ্যাপা নয়। এদের মনের ভেতর বড় অন্ধকার, হাজারটা প্যাঁচ।

রাঙাপিসি এবার পাশের বাড়ির কাকিমাকে নিয়ে ঢুকল।
কাকিমা বলল – পারিজাত, তোমার রাঙাপিসিকে ডাক্তার দেখাও। শরীরটা খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তুমি ছাড়া ওর আর কে আছে বলো।
-ডাক্তার দেখিয়েছি কাকিমা দিন সাতেক আগে। আজ কি যাবে?
এরমধ্যে জগবন্ধু উঠে দাঁড়িয়েছে। পোঁটলাটা কাঁধে তুলে নিয়েছে। পারিজাত পথ আটকে দাঁড়াল, কোথায় যাচ্ছ তুমি? বেশ আগামীকাল যাবে। তোমার সাথে আমার কাজ আছে। জরুরি কাজ।
জগবন্ধু অবাক হয়ে বলে – আমার সাথে কি কাজ দাদাবাবু, আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
-তুমি ঐ মহল্লায় ফিরে যাবে না, বিলকুল নয়।
-বেশ যাব না, যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাব। বেশ ছোট বকুলপুর খুঁজে পেতে নেব, নাহয় চাংড়িপোতা। হয়ে যাবে দাদাবাবু , তুমি ভেবো না।
-বেশ তুমি একটু বসো। আমি আসছি।
একটু পরে একটা ছোটখাটো ব্যাগ হাতে বেরিয়ে এল পারিজাত। রাঙাপিসি চোখ পাকিয়ে বলে – এ্যাই! ব্যাগ কিসের?
-জগতদার সাথে দু’দিন ঘুরে আসি।
-মানে?
-জগতদার মহল্লায় যাব। দেখব এবার জগতটাকে।
তবে জগতদা যদি আমাদের এখানে থেকে যায় তাহলে এখন আর যাচ্ছি না, সে পরে দেখা যাবে।
রাঙাপিসির বিরক্তি চোখমুখে ফুটে উঠেছে। পারিজাত সেটা লক্ষ করে বলে – তোমার শরীরের যা অবস্থা জগতদা থাকলে ভালোই হবে। তোমার জন্যে তো নিশ্চিন্ত মনে কোথাও যেতেও পারি না।
রাঙাপিসি জগবন্ধুর দিকে তাকিয়ে বলে – পোঁটলাটা কাঁধ থেকে নামাও। কোথায় যাবে? এখানেই থাকো আজ থেকে। কিন্তু তুমি জুহিদের বাড়িতে ছিলে না? ওদের বলে এসেছ তো? নাহলে ওরা কি ভাববে বলো তো?
জগবন্ধু অবাক হয়ে ভাবে, একটু আগে বলল, চেনে না। এখন বলছে, চেনে। সত্যি, ভারি আজব ব্যাপার। এখানে থাকা ঠিক হবে না মোটেই। কিন্তু পারিজাত দাদাবাবুটা বড্ড পাগল।
(ক্রমশ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *