৬০ টাকায় বাংলাদেশ – আমার অন্য পথ ~ শান্তনু ঘোষ পর্ব-৩

৬০ টাকায় বাংলাদেশ – আমার অন্য পথ
~ শান্তনু ঘোষ
পর্ব-৩

আগে যা ঘটেছে:
গেদে ষ্টেশনে ইমিগ্রেশন পর্ব শেষ হয়েছে। ইমিগ্রেশন কাউন্টারে বিভিন্ন অভিজ্ঞতা হল। আমার সামনের দুজনকে ওরা আটকে দিল। আমি একটু ভয়েই ছিলাম। কি জানি আমার কোন সমস্যা তৈরি হবে না তো! যাক ভালো ভাবে মিটে গেছে।

তারপর…

এবার কাস্টমস চেক করিয়ে রেল লাইনের ডান দিকে সরু পায়ে চলার রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছি। আমার বাম দিকে রেল লাইন চলে গেছে সোজা বাংলাদেশ। এই লাইন ধরেই মৈত্রী এক্সপ্রেস যায়। লাইনের দুধারে বিশাল উঁচু ও শক্ত লোহার রেলিং দেওয়া। কিছুদূর হাঁটার পরে একটি লেভেল ক্রসিং এল। সেটা পেরিয়ে বামদিকে বর্ডার সিকুরিটি ফোর্স এর অফিসের সামনে এসে পড়েছি। আরো দু-চার জন যাত্রী আছে।

আমার সামনেই একটি পরিবার। স্বামী ও স্ত্রী। খুবই সাধারণ পোশাক। বয়স ষাটের কাছাকাছি। মহিলা বোরখা পরে আছেন। তবে মুখ ঢাকা নয়। ভদ্রলোক নিয়মিত নামাজ পড়েন মনে হল। দাড়ি আছে। গোঁফ নেই। ২৪ পরগণার কোন এক গ্রামে বাড়ি বললেন।

বাংলাদেশ যাচ্ছেন। তাদের আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে। তাদের ছেলে ছাড়তে এসেছে। এসব শুনতে পাচ্ছি।

কারণ এখন তাদের সিকুরিটি চেক হচ্ছে। ঠিক পেছনেই লাইনে দাঁড়িয়ে আমি দেখছি।
এখানে কোন এক্স-রে স্ক্যানার নেই। সব মালপত্র বার করে হাতে ধরে ধরে চেক করা হয়। তাই সময় লাগে।

বি এস এফ ক্যাম্পটি বেশ সুন্দর। কত গাছ। ছায়া ঘেরা। নেহাৎ থাকতে দেয় না। তাহলে এখনই বাঙালী ট্যুর অপারেটররা “চলুন বেরিয়ে আসি গেদে ক্যাম্প” বলে নতুন প্যাকেজ চালু করাতে পারত।

বড় বড় গাছের নিচে একটি টিনের চালের খোলা ছাউনিতে চলছে লাগেজ চেক। সব কিছুর মধ্যেই এক অস্থায়ী ব্যবস্থার ছাপ।

টেবিলের উপরে ওনাদের ব্যাগ একের পর এক খোলা হচ্ছে। অন্যান্য লাগেজের সাথে আছে তিনটে বড় বড় বাজারের ব্যাগ। তাতে এক এক করে ৬টা বড় বড় কম্বল ঠাসা।

বি এস এফ কর্মী প্রশ্ন করছে এই বিষয়ে। আরো জানতে চাইছে কোথায় ও কেন যাচ্ছে।

এসবের পরে মেটাল ডিটেকটর দিয়ে বডি চেক হবে। বেশ সময় সাপেক্ষ। আমি একটু টেনশনে আছি। কারণ আমার তো ওপারে গিয়ে ট্রেন ধরতে হবে। সময় হয়ে আসছে।
এনাদের এত সময় লাগছে দেখে। একজন কর্মী আমাকে আগে ডেকে নিয়ে বডি চেক করিয়ে নিলেন।

এরপর আমার লাগেজ চেক হবে।
আবার লাইনে দাঁড়ালাম। এখন আমার পালা।

আমার লাগেজ বলতে একটি রুকস্যাক আর ক্যামেরা ব্যাগ। রুকস্যাকে কিছু জামাকাপড় ছাড়া বিশেষ কিছু নেই। বি এস এফ কর্মী ওটা একটু ঘেঁটে ছেড়ে দিলেন।

মুশকিল হল ক্যামেরা ব্যাগ নিয়ে। এটা অনেক জায়গায় হয় তাই মানসিক ভাবে প্রস্তুত ছিলাম।
একটা বড় DSLR, GOPRO, গিম্বাল, তার আনুসাঙ্গিক, এত কিছু দেখে সিকুরিটির লোকজন সব সময় সন্দেহ করেন। অনভিজ্ঞ লোকের কাছে এগুলো প্রশ্ন জাগাতেই পারে। বিশেষত আজ যখন সন্ত্রাস ছেয়ে গেছে, আর সেখানে আধুনিক প্রযুক্তির এত ব্যবহার।

এসব দেখে ভদ্রোলকের মনে যে অনেক প্রশ্ন জাগছে বুঝতেই পারছি। চলছে একের পর এক প্রশ্ন। তার সাথে উনি জিনিসগুলো ঘেঁটে দেখছেন। এত কিছুর পরেও সন্দেহ যায়নি।

আবার প্রশ্ন এল, কি কাজ করি।
উত্তর, সরকারী চাকুরী।
কোথায়? উত্তর দিলাম।
এই উত্তরে একটু ভরসা পেলেন মনে হয়। কিন্তু তাও দ্বিধা যায় না।

এবার উনি ওনার হায়ার অফিসারকে ডেকে আনলেন। সেটাই স্বাভাবিক।

এই ভদ্রলোক মনে হয় অনেক অভিজ্ঞ। উনি একটু দেখে জিজ্ঞেস করলেন, এগুলি আমার নিজের কিনা। কেন নিয়ে যাচ্ছি। সঙ্গে করে নিয়ে ফিরব কিনা।

সব প্রশ্নের ঠিক ঠিক উত্তর দিয়ে পাস করলাম।

দূর্গা বলে আমি ছাউনি থেকে বেরিয়ে এসে এদিক ওদিক দেখছি। কোনদিকে যাব ?

সামনে একজনকে জিজ্ঞেস করাতে একটু দূরেই দেখিয়ে দিলেন কয়েকটি সাইকেল ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। বললেন ওই ভ্যানে করে যেতে।

বুঝলাম ওই ভ্যানগুলি আমাকে নিয়ে যাবে বাংলাদেশ বর্ডার ক্যাম্পের কাছে।

দুটো ভ্যান দাঁড়িয়ে। একটিতে বসেছি। ভাড়া ৩০ টাকা।

ভ্যান ছাড়ছে না দেখে আমার চিন্তা বাড়ছে। ওদিকে দর্শনা হল্ট থেকে ট্রেন ধরতে হবে। ট্রেন মিস করলে দুঃখ আছে কপালে। বাংলাদেশে ট্রেন অত ঘন ঘন নেই শুনেছি।

আমি জিজ্ঞেস করি, কখন ছাড়বেন দাদা।
চালক দাদা বললেন, ওই যে একটি বড় দল আসছে। ওদের নিয়ে যাব। আমি গল্প জুড়েছি ওনার সাথে। জানলাম এই নোম্যান্স ল্যান্ডে কেবল মাত্র তারাই ভ্যান চালাতে পারে, যাদের জমি এখানে পড়েছে।

আগে ভালো কাস্টমার হত। কিন্তু ইদানিং কাস্টমার কমে যাওয়ায় উপার্জন নেই। তার এক বড় কারণ এই গেদে বর্ডার দিয়ে বাংলাদেশি নাগরিকরা ভারতে প্রবেশ করতে পারে না।

আমি এবার ক্যাম্পের দিকে দেখি, খোল ও অন্যান্য বাদ্য যন্ত্র নিয়ে পুরুষ মহিলার ৬ জনের একটি দল বি এস এফ কে কিছু একটা বোঝানোর খুব চেষ্টা করছে।

এক ভদ্রলোক খুব জোরে জোরে বলছেন, এই মহিলা তো সারা পৃথিবী ঘোরেন, কোথাও ওনার এইসব জিনিসপত্র আটকায়নি। কি জিনিস আটকেছে তা ঠিক বুঝতে পারছি না। হয়ত বাদ্যযন্ত্র হবে।
বেশ খানিকক্ষণ তর্কাতর্কির পরে দলটি ছাড়া পেল।

এবার ভ্যান ভরে গেছে। ভ্যান চলল বাংলাদেশ এর দিকে। আমার পাশেই ওই দলের একজন বসেছেন।

জিগ্গেস করে জানলাম, ওনারা পাবনায় যাচ্ছেন কীর্তন গাইতে। ওনাদের পোশাক দেখেও তাই মনে হচ্ছিল আমার। এমন নাকি মাঝে মাঝেই ডাক পান ওনারা।

এবারও একধারে মৈত্রীর রেল লাইন। উঁচু রেলিং দিয়ে ঘেরা। ভ্যান চলেছে নো ম্যান্স ল্যান্ড দিয়ে। ইন্ডিয়ার বি এস এফ ক্যাম্প ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে। আমি বেশ রোমাঞ্চিত।

বেশ কিছুটা যাবার পরে দেখলাম রেল লাইনের ধারে সিমেন্টের ফলকে বড় বড় করে লেখা
বাংলাদেশে আপনাকে জানাই স্বাগত।
Welcome to Bangladesh.

মনের ভিতরে এক অন্য অনুভূতি হচ্ছে।
বিদেশ ভ্রমণ তো আগেও করেছি। কিন্তু এমন অনুভূতি হয়নি।
পৌঁছে গেছি বাংলাদেশ ।

আবেগ উত্তেজনায় বাড়িতে ফোন করে ফেললাম।
হ্যাঁ। বাংলাদেশে ঢুকে পড়লেও আমার ভারতীয় জিও সিম একটু কাজ করছিল। কিন্তু মাত্র একটি দাগ। বুঝতে পারছি আর একটু ভিতরে গেলে এই সিম অকেজো হয়ে যাবে।

এবার আবার একপ্রস্থ নিয়ম কানুন পার হতে হবে।
প্রথমেই চাইল করোনা ডাবল ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট।
কিন্তু আমার তো সেটা নেই !!
আমি তো মাত্র একটি ভ্যাকসিন নিয়েছি।
কি হবে এখন !

ক্রমশঃ

ছবি: সংগৃহিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *