সনাতন ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি। অসীম রায়।

সনাতন ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি।
অসীম রায়।

সনাতন ধর্মে নানা মুনির নানা মত প্রচলিত। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, যত মত তত পথ, সব পথের গন্তব্য একই। তবে বাস্তবে এক পথের পথিক অন্য পথ থেকে তার পথই যে শ্রেষ্ঠ সেটা প্রচারে ব্যস্ত। শ্রেষ্ঠ প্রচারেও সমস্যা ছিলো না, বলা শুরু হলো, শুধুমাত্র তার পথই প্রকৃত পথ অন্যগুলো কোন পথই নয় অথবা নিকৃষ্ট। প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় এই প্রচার এবং বিষোদগার এখন এতোটাই জমজমাট হয়ে উঠেছে যে বিভিন্ন মতবাদ এখন পরস্পর অনলাইন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছে।
মার্কেটিং এ পড়েছি Differentiation Strategy অর্থাৎ পৃথকীকরণ কৌশল। বিষয়টা হচ্ছে, বাজারে যেমনটা চালু আছে আপনার পণ্য বা সেবাকে তার থেকে কিছুটা আলাদা করতে হবে, উন্নত করতে হবে। এই কৌশলটা ধর্মীয় মতবাদে খুব প্রচলিত। যেকোনো মতের প্রচলনকারী বা পরিচালকেরা খুব সচেতনভাবে এটা করে থাকেন। তারা জীবনযাপনের কিছু বিষয়ে ভিন্নতা এনে সেটাকে তাদের মতাদর্শের আদর্শ বলে প্রচার করেন। এতে করে বাস্তবে সৃষ্টি হয় বিভেদ। যদিও সব ধর্ম, সম্প্রদায় বা মতবাদের মূল উদ্দেশ্য জগতের কল্যাণ, মানবতার কল্যাণ। কিন্তু বাস্তবতায় ধর্ম আর মতবাদের কারণেই মানুষে মানুষে বিভক্তি।
সম্প্রতি যেমন মতুয়া মতাবলম্বীদের মধ্যে অশৌচ, শ্রাদ্ধ, বিবাহ প্রভৃতি সামাজিক কাজে ভিন্নতা আনার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
শ্রাদ্ধের বেশিরভাগ প্রচলিত কার্যকলাপ ব্রাহ্মণদের সৃষ্ট এবং সেখানে তাদের স্বার্থ জড়িত এতে কোন সন্দেহ নেই। শিক্ষা বিস্তারের ফলে তাদের সেই রমরমা ব্যবসা ইতোমধ্যে সংকুচিত হয়েছে এবং হচ্ছে। এখন আর তেমন কেউই শ্রাদ্ধে ব্রাহ্মণদের গাভী দান করে না। অশৌচও শাস্ত্র মতে দু রকম- জননাশৌচ ও মরণাশৌচ। তবে এখন শিশু জন্মালে অশৌচ আর তেমন পালিত হয় না, এটাও শিক্ষার ফলে পরিবর্তন। মরণাশৌচের ক্ষেত্রে মৃতের নিকটাত্মীয়রা যে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা মান্য করে তার যৌক্তিকতা করোনাকালে কোয়ারান্টাইন দ্বারা খানিকটা প্রমাণিত। তবে শাস্ত্রীয় মতে যে বিভেদ অর্থাৎ চার বর্ণের জন্য যথাক্রমে ১০, ১২, ১৫ ও ৩০ দিন অশৌচ এটা যৌক্তিক হতে পারে না। সামাজিক বিচ্ছিন্নতা হলে সেটা সবার জন্য একই (১৪ দিন) হলেই গ্রহণযোগ্য। এখানেও পরিবর্তন হয়েছে এবং হচ্ছে।
আর যে বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় চলছে সেটা হচ্ছে শ্রাদ্ধ কার্যে ‘মস্তক মুণ্ডন’ অর্থাৎ টাক করা। শাস্ত্রে যত যাই বলা থাকুক না কেন, মাথার চুল পুরোপুরি ফেলে দেওয়া হয় যেসব সামাজিক কারণে তা হচ্ছেঃ
১। মৃতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে।
২। চুল সৌন্দর্যের প্রতীক। শারীরিক সৌন্দর্য চিরস্থায়ী নয় সেটা অনুধাবন করাতে।
৩। কারও পিতা বা মাতা মারা গেছেন সেটা তৎকালীন সময়ে চিহ্নিত করার জন্য।
৪। সৎকার বা অন্যান্য সময়ে প্রাপ্ত ময়লা ও রোগ জীবাণু সম্পূর্ণভাবে দূর করতে এবং
৫। একটা বড় আঘাত বা দুঃখ পাওয়ার পর জীবনে নতুন করে পথ চলার জন্য সবকিছু ঝেড়ে ফেলে নতুন শুরুর প্রতীক হিসেবে।
এখন অনেকে বলবেন মৃতের আত্মার শান্তি বা সৎগতির জন্য চুল ফেলা হয়। আসলে চুল ফেলার সাথে আত্মার সৎগতি হওয়া একেবারেই হাস্যকর। মৃতের দোষপ্রাপ্তি ও তার প্রায়শ্চিত্ত এবং আরও পাপের প্রায়শ্চিত্ত, এগুলোও ব্রাহ্মণদের হাতিয়ে নেওয়ার চমৎকার হাতিয়ার ছাড়া আর কিছুই নয়। চুল ফেলাটা উপরিউক্ত কারণসমূহের জন্য একটা সামাজিক রীতি মাত্র। তবে উক্ত কারণসমূহের কোন কোনটা সময়ের সাথে সাথে কিছুটা যৌক্তিকতা হারাচ্ছে।
এই রীতিও কারও নিকট অযৌক্তিক হলে তিনি যুক্তিযুক্ত কারণ উপস্থাপন করে সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা করতে পারেন, তবে সামাজিকতাকে অবজ্ঞা করে নয়। তাছাড়া কেউ পিতামাতার প্রতি এভাবে শ্রদ্ধা প্রদর্শন নাও করতে পারেন বা আদৌ কোন শ্রদ্ধা নাও করতে পারেন, সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে যারা রীতিটি পরিপালন করেন তাদের সামনে ‘মতুয়া মতে মস্তক মুণ্ডন না করাটা রীতি’ এইটা উপস্থাপন করাটা অগ্রহণযোগ্য। সামাজিকতা আর ধর্ম এক নয়। সামাজিকতার সঙ্গে যারা ধর্মকে মেশান তারা হীন স্বার্থে সেটা করেন। সামাজিক কোন রীতি পরিবর্তন করতে হলে সেটা সামাজিক সচেতনতামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে করতে হবে, ধর্মের দোহাই দিয়ে নয়। তাইতো শ্রী সাগর ঠাকুর স্পষ্ট বলেছেন, “সামাজিকতা আর ধর্মকে আমরা যেনো এক করে না ফেলি। মতুয়াদের ভর্ৎসনা করে আরও বলেছেন, “শ্রাদ্ধ আর বিবাহের মত সৃষ্টি করার জন্য কি প্রভু হরিচাঁদের আবির্ভাব হলো?
পরিশেষে বলি, সনাতন শুধু একটা ধর্ম নয় এটি একটি সংস্কৃতি। এলাকা ভেদে এই ধর্মের মানুষের মধ্যে জীবনাচরণ, রীতিনীতিতে রীতিমতো পার্থক্য বিরাজমান। শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব, ব্রাহ্ম, সৎসঙ্গ, মতুয়া প্রভৃতি মতবাদেও রয়েছে অনেক অনেক ভিন্নতা। ভিন্নতা থাকলেও যার যার পছন্দসই মতে সে ধর্ম পালন করে, এটাই হিন্দু ধর্মের উদারতা। আরও একটা বিষয়, বছরের পর বছর ধরে সনাতন ধর্মে সংস্কার চলে আসছে এবং এটা চলমান প্রক্রিয়া। মানুষ যত শিক্ষায় এগিয়ে যাবে তত জীর্ণ মতবাদ ঝেড়ে ফেলবে এটাই স্বাভাবিক। একজন সুশিক্ষিত মানুষ যৌক্তিক বিষয়টাই গ্রহণ করবে আর অযৌক্তিক বিষয়গুলো তার কাছে অচল হবেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *