আজ আমার কলমে,,,,কিছু না বলা একান্তই মনের গোপন কথা,,,,, কলমে-নিতুচৌধুরী,,,,

আজ আমার কলমে,,,,কিছু না বলা একান্তই মনের গোপন কথা,,,,,

কলমে-নিতুচৌধুরী,,,,

আজ সাত চল্লিশের একজন মহিলা আমি। কিন্ত এখনও কিছু কিছু ব্যাপার ঠিক বোধগম্য হয়না আমার। এখনও ঠিক নিজেকে শিক্ষিত বলতে লজ্জা লাগে আমার। প্রতিবাদী মনটা মাঝে মাঝে বলে ওঠে,কি করতে পেরেছিস মানুষ হয়ে?পেরেছিস নিজের গা থেকে দূর্বল নারীর তকমাটা ঝেড়ে ফেলতে,পেরেছিস শো কলড সামাজিক ট্যাবুগুলো খুলে ফেলতে, পেরেছিস সত্যিই নিজেকে শিক্ষিত করতে?
আমার প্রিয় পাঠকগন বোধগম্য হচ্ছে না তো ঠিক কি কারণে, কেন এই হীনমন্যতা বা আত্ম গ্লানির শিকার আমি?জানতে গেলে আপনাদের ও আমার সঙ্গে যেতে হবে সেই আশির দশকে,,, ,

মেয়েটির বয়স তখন নয় বছর কয়েক মাস। সম্ভবতঃ তৃতীয় শ্রেনীর থেকে ফাস্ট ডিভিশনে পাশ করে চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী হয়ে মাত্র কয়েক দিন স্কুলে গেছে। স্কুল টা তার খুব প্রিয় জায়গা,একদিন না গেলে কেমন যেন পাগল পাগল লাগে। যেমন একদিন খেলতে না যেতে পারলে লাগে। আর পাগল পাগল লাগে পূজো না করতে পারলে।এই কাজগুলো যেন তার সারাদিনের সব থেকে প্রিয় কাজ।
হঠাৎই একদিন সে দেখলো তার দু পা বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পরছে।কিন্ত সে কিছুই বুঝতে না পেরে চিৎকার করে বলে ওঠে, বাবা, দেখো আমার কি হয়েছে।যৌথ ফ্যামিলির বাড়িতে প্রথম কন্যা সন্তান হওয়ার সুবাদে সে একটু বেশিই আদরের বিশেষ করে কাকারা,জ্যাঠা, বাবা ,পিশিরা ঠাম্মা বা দাদু যেন তাকে চোখে হারায়। আর বাবার তো সে প্রিন্সেস।তো এহেন প্রিন্সেসের চেঁচামেচিতে বাড়িসুদ্ধ সকলেই ছুটে এলো। তার পর হঠাৎই পিশিরা ঠাম্মি মা বাদ দিয়ে সবাই কেমন চুপ করে সরে গেলো।বাবা কেমন কিংকর্তব্য বিমুঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে রইল মুখ কালো করে।তারপর ঠাম্মার কথাতে সেখান থেকে তিনিও সরে গেলেন। মেয়েটি ভাবতে লাগলো ব্যাপার টা কি হলো?আমার এমন অবস্থা অথচ,,,,,
এবার তার দিকে ধেয়ে আসতে লাগলো পিশিদের, ঠাম্মার, কাকিমার বাক্যবাণ,,,,
এই যে শোন, তুই কিন্ত আর ছোট নস কেমন। এবার থেকে কিন্ত ছেলেদের থেকে একটু দূরে দূরে থাকবি, বিশেষ করে রাস্তায় বেরোলে, হুটপাট খেলতে বেরিয়ে যাবিনা মনে থাকে যেন, ঠাকুর পূজো করা তো দূর ছুঁবিও না কিন্ত এখন, ভাইয়ের কাছে বা বাড়ির অনান্য ছেলেদের কাছে এসব বলতে যাবিনা কারণ এটা কিন্ত খুব লজ্জার ব্যাপার, লুকিয়ে রাখতে হয়। মেয়েটি কিছুই বুঝতে না পেরে আরও চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে এতো বারণের কথা শুনে।মাকে জিজ্ঞেস করে তার কি হয়েছে?ঠাম্মা বলে ওঠেন “তুই ঋতুমতী হয়েছিস রে ছুঁড়ি, তাই এখন থেকে প্রত্যেক মাসের এই পাঁচটি দিন তুই এই সমস্ত কাজ করতে পারবি না। আসলে এই সময় প্রায় অচছুৎ হয়েই থাকতে হয় কিনা।” সেদিন ঠাম্মার কথাই খুব অবাক হয় সে কারণ যে ঠাম্মা তার সমস্ত ছেলে মেয়েদের পড়ান বা নিজেও সারাদিন বিভিন্ন রকম বই পড়েন,তাকে সারাক্ষণ কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম শোনান তার কাছে এসব শুনে কিছুই বোধগম্য হয়না তার ।
মেয়েটিকে কতো কিছুই শেখাতে থাকে বাড়ির সব মহিলারা মিলে।কিভাবে পুরোনো কাপড়ের ব্যবহার করতে হয়, কিভাবে সবার থেকে ওই দিন গুলো সরে থাকতে হয়। কিভাবে পেটে ব্যথা করলে গরম জলের বোতল পেটে চেপে কষ্ট সহ্য করতে হয় যেন এক পাহাড়ের বোঝা চেপে গেলো তার মাথায়।সে কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎই চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো যেন এই একটু সময়েই মেয়েটি একজন ভদ্রমহিলা হয়ে উঠেছে।বাবা একটু পরেই তার কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই সে বলে উঠলো, “আমাকে ছুঁয়ো না, এখন আমি অচছুৎ যে,”।বাবা খুব রেগে গিয়ে মাকে ডেকে বললেন, “এসব কি শিখিয়েছো ওকে?” মা বলে উঠলেন তোমার মা বলেছেন “।
বাবা মুখ নীচু করে নিলেন। ছোট্ট ভাইটা, যে মেয়েটির থেকে প্রায় বছর চারেকের ছোট, যার দিদি ছাড়া খেলতে যাওয়া বারণ সেও খেলতে যেতে না পেরে দিদির সাথে আড়ি করে দিলো।রাতে বাবা-মায়ের মাঝে দুই ভাই- বোন গলা জড়িয়ে শুতে না পেরে যখন ঘুম আসছে না মেয়েটির তখন ভাইকে সে বোঝালো, পাঁচদিন পর আমি তোকে খেলতে নিয়ে যাবো প্রমিস। ভাই সেই পাঁচদিন খেলতে যেতে পারলোনা কারণ তাকে ছাড়া ওই একরত্তি ভাইটা যে খেলতেই চাইনা।
সেদিনের সেই একটা ছোট্ট ঘটনাই খুব কষ্ট পেয়েছিলো সেই মেয়েটি। কিন্ত সেদিন সে বড়ো অসহায়, বড়ো নিরুপায় ছিলো কারণ আমাদের সমাজ ব্যবস্থা,কারণ পারিবারিক বিধিনিষেধ, কারণ তাকে বোঝানো হয়েছিলো সে মেয়ে, এগুলো মেনে চলাই কর্তব্য।
একটু বড়ো হওয়ার সাথে সাথেই পাল্টে যেতে থাকে সেই চেনা গন্ডি।
মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে যাবে মেয়েটি, হঠাৎই সকাল বেলাতে আবার তার নারীত্বের বহিঃপ্রকাশ। কিন্ত কি আর করা যাবে, এখন যদিও তার বাইরে বেরোনো নিষেধ নয় কিন্ত এখনও যেন এরকম হলে কেমন লুকোনো লুকোনো ব্যাপার। বড়ো বিরক্তিকর, অস্বস্তিকর লাগে তার এসব। মনে মনে ভাবে আচ্ছা এটা তো একটা স্বাভাবিক শারীর বৃত্তিয় প্রক্রিয়া নারী রজঃ স্বলা না হলে নতুন প্রজন্মের সৃষ্টি কি করে হবে? কারোর বাচ্চা হবে শুনলে এতো যত্ন করা হয়, ঘটা করে তার সাধ ভক্ষণ অনুষ্ঠান করা হয় তাহলে পিরিয়ড নিয়ে এতো লুকোচাপা কেন? বাবা তার প্রাণের বন্ধু, কিন্ত মার কথা অমান্য করে বাবার থেকে জানতে চাওয়া যাবেনা, এসব প্রশ্নের উত্তর। তাই প্রশ্ন গুলো মনেই চেপে রাখলো।

আজ চল্লিশোর্ধ সেই মেয়েটি মানে গৃহবধুটি এখন টিভি খুললেই স্যানিটারি ন্যাপকিনের বিজ্ঞাপন দেখতে পায়। বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বোঝানো হয় কিভাবে তার ব্যবহার করতে হবে,কি কি সুবিধা তাতে, এখন আর তো লুকিয়ে রাখতে হয়না মনে মনে ভাবে সে।এখন তো এসব নিয়ে সিনেমা বানানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে পূজো করলেও কোন অসুবিধা নেই। খেলাধূলা তেও কোন অসুবিধা নেই। মনে মনে সেই সাতচল্লিশ বছর বয়স্ক মহিলাটি ভাবে আচ্ছা এগুলো আরও আট ত্রিশ বছর আগে কেন বলা হলোনা। তাহলে আমার জীবনের পাঁচটি করে মাসে অর্থাৎ বারো ইনটু পাঁচ মানে ষাট দিন। এক বছরে তার মানে তিনশো পঁয়ষট্টি দিন থেকে ষাটটি করে দিন মানে গত আট ত্রিশবছরে আমার জীবনের কতোগুলো দিন বিনা পূজোয়, বিনা খেলাধূলায়, ইনফেকশনের ভয়ে বা পেট ব্যথার কষ্টে কাটাতে হতোনা,তার সেই একরত্তি ভাই টাকেও তার জন্য কষ্ট পেতে হতোনা।
নিজের উপর খুব রাগ হয় তার কেন যে এই সময়ে পৃথিবীতে না জন্মে সেই মান্ধাতার আমলে জন্মাতে গেলো কে জানে?

পুনশ্চ: রজঃ স্বলা নারীকে অচছুৎ নয় শক্তির আধার রূপে দেখতে শিখুন কারণ তার মধ্যেই সৃষ্টির বীজ লুকিয়ে থাকে। তাকে সন্মান করতে শিখুন নাহলে সৃষ্টি থেমে যাবে,মানব জীবনের অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।পিরিয়ড কোন লুকানোর জিনিস নয়। এটি একটি কেবলমাত্র শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া তাই পিরিয়ড নিয়ে অযথা লুকোচাপা না করে আপনার বাড়ির পুরুষ সদস্য টিকে (ছেলে,স্বামী, ভাই,বাবা,)এটা বলুন, যাতে তারাও ব্যাপার টি নিয়ে অযথা বিভ্রান্ত না হয়।
কবির কলম শুধুই পাঠকের মনোরনঞ্জনের হাতিয়ার না হয়ে কখনও কখনও সামাজিক স্বার্থেও ব্যবহৃত হওয়া উচিত সেই দৃষ্টি ভঙ্গীর থেকেই এই লেখাটির সৃষ্টি।আশাকরি সকলে একমত হবেন।
ধন্যবাদান্তে -লেখিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *