৬০ টাকায় বাংলাদেশ গমন – আমার অন্য পথ – শান্তনু ঘোষ

৬০ টাকায় বাংলাদেশ গমন – আমার অন্য পথ
– শান্তনু ঘোষ
পর্ব-১
বছর খানেক আগে কৌস্তভ একবার হয়ত মুখ ফসকে বলে ফেলেছিল, এখন বাংলাদেশে পোষ্টেড আছি । আয় একবার ঘুরে যা।
পরে হয়ত ওর মনেও নেই। কিন্তু আমি ভুলিনি।
নিয়মিত নানা কথায়, নানা কায়দায় ওকে ফোনে জানাতাম, আমি কিন্তু যাবো বাংলাদেশ।
অবশেষে কোন এক কায়দায় বা আলকায়দায় বাংলাদেশ যাবার ভিসার আবেদন করেই ফেললাম।
কিছুই তো জানি না।
চেনা বা অচেনা বাংলাদেশ গমনকারী ও ভ্রমণকারীদের বিভিন্ন সময়ে ফোন করে উত্যক্ত করে গমনের পদ্ধতি জানার চেষ্টা করতাম।
অবশেষে সব থেকে উৎকৃষ্ট পদ্ধতি কৌস্তভই বলল।
সে পথে চলে মাত্র ৬০ টাকায় সোজা বাংলাদেশ সীমানায় পৌঁছে গেলাম।
মনে হয় এখন পর্যন্ত আমার পরিচিতজনদের বৃত্তে আমিই প্রথম এই বিশ্ব রেকর্ড সৃষ্টি করতে চলেছি।
অনেকেই সুসজ্জিত রূপে বাংলাদেশ গমন করে। কি সুন্দর সুন্দর ছবি দেয় ফেসবুকে। এয়ারপোর্ট, প্লেন, মৈত্রী এক্সপ্রেস, নিদেন পক্ষে লাক্সারি বাসে বসে। নীচে ক্যাপশন : গোয়িং টু ঢাকা বা ফ্লাইং টু দ্য কান্ট্রি অফ হিলসা।
তাদের পাশে আমার এই ৬০ টাকার গমনের ছবি দিতে হবে ভেবেই কেমন কেমন লাগলো।
কি লিখব তাই ভাবছিলাম। গোয়িং টু গেদে ?
আর ছবিটা দেব ভিড়ে ঠাসা গেদে লোকালে চ্যাপ্টা হয়ে বসে আছি ?
এমনিতেই তেমন ফ্রেন্ড নেই ফেসবুকে। আর এসব ছবি দেখলে তো বাকিরাও ছেড়ে চলে যাবে।
ভাববে, ধুস এই লোকটার তো কোনো পজিশনই নেই। এর সাথে ফ্রেন্ডশিপ করে কি ফায়দা ?
সবাই স্ট্যাটাস দেয় নানা সুন্দর ছবি দিয়ে। কত লাইক পায় । আহা দেখেও সুখ।
কিন্তু আমি সব সময় অন্য পথে ভ্রমণ করি। তাই আর সে রাস্তায় না গিয়ে ভিসা পাবার পরেই কৌস্তভকে ফোন করে ওর সুবিধা মত সময় জেনে নিলাম। কারন গিয়ে পড়ব তো ওর ঘাড়েই।
অসম্ভব ব্যস্ততা থাকা সত্ত্বেও ও ঠিক সময়মত সব কিছু ছবির মত বুঝিয়ে দিল। এমনকি কোথায় কার সাথে যোগাযোগ করতে হবে তাও বলে দিল আর তাদের ফোন করে জানিয়ে দিল। এতে আমার যাত্রা সুগম হবে। তারপর বলল, যা এবার টিকিট কেটে গেদে লোকালে উঠে পর।
আমিও অফিসে ছুটির আবেদন করে দিলাম।
একসময় কলকাতায় রোজ সকালে অফিস যাওয়ার পথে দেখতাম বেকবাগানে বাংলাদেশ ডেপুটি হাই কমিশনের অফিসের সামনে লম্বা লাইন, ধাক্কাধাক্কি, চিৎকার। প্রথমে ঠিক বুঝতাম না কিসের লাইন ওটা। পরে জেনেছিলাম, বাংলাদেশ ভিসার জন্য লাইন। লোকের মুখে শুনেছি, অনেক ভোরে এসে লাইন দিতে হয়। তারপরেও কাগজ পত্রের নানা ঝামেলা থাকে। তাই ভিসা পাবার কাজটি অত সহজ নয়। অতএব সুধীজন আমায় জানিয়েছিলো যে এজেন্ট না ধরলে কপালে কষ্ট আছে।
এইসব দেখেশুনে তো আমার সাহস হয়নি বাংলাদেশ যাবার। আর আমি তো এজেন্ট ধরতে পছন্দ করি না। যা নিজেই করতে পারি, তার জন্য পরনির্ভর কেন হব, আর বেশী টাকা কেন দেব !
আমি কিপটে তো !!
আমার পূর্ব পুরুষদের নিজের দেশ অবিভক্ত বাংলাদেশ। আমার মন সব সময় টানত। ঠাকুরমা, বাবা, তাঁদের মুখে শোনা কতগুলো জায়গার নাম কেমন যেন মায়াবী লাগত। সেই সাথে দেখেছি দেশত্যাগের অব্যক্ত যন্ত্রণার ছাপ।
ঢাকা, বিক্রমপুর, বরিশাল, চাঁদপুর, গোয়ালন্দের স্টীমার ঘাট, নারায়ণগঞ্জ, ঢাকেশ্বরী মন্দির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, এই অবিন্যস্ত শব্দগুলো মনে গেঁথে গিয়েছিল। স্বপ্ন ছিল একদিন যাবোই যাবো। ছোটবেলায় ম্যাপ বইতে বারবার দেখতাম। ভাবতাম, ঈশ্ এত কাছে জায়গাগুলো, কিন্তু যাওয়া সহজ নয়।
ইচ্ছে তো থেকেই যেত।
কিন্তু ওই ধাক্কাধাক্কি ভিসা চিত্র সামনে এলেই মন দমে যেত।
একবার মনে হল দেখি তো অনলাইন কিছু হয় কিনা। অমনি গুগুল সার্চ। পেয়েও গেলাম একটা লিঙ্ক।
সেখান থেকে পাওয়া ফোন নং এ ফোন করে খুব ভালো ব্যবহার পেলাম। ফোন-সহায়ক সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন কি করে ভিসার আবেদন করতে হবে।
কি কি প্রয়োজন।
অনলাইনে আবেদন করে ও পরে নির্দিষ্ট দিনে বাংলাদেশ ভিসার সল্টলেক অফিসে গিয়ে নথি ও ৮২৫ টাকা জমা করে সময়মত মাখনের ষ্টাইলে ভিসা পেয়ে গেলাম। নেই ধাক্কা, নেই চিৎকার। শুনেছি এজেন্ট নাকি ২০০০ টাকা নেয়। বাপরে !!
দুঃখ একটাই, মাত্র ৬০ দিনের ভিসা আর সিঙ্গল এন্ট্রি দিল। যদিও আমি মাল্টিপল এন্ট্রির আবেদন করেছিলাম।
এবার কৌস্তভকে ফোন করে ওর সুবিধা মত একটা দিন ঠিক করলাম।
ঠিক হল শিয়ালদহ থেকে সকাল ৭:৪০এর গেদে লোকাল ধরে সোজা গেদে ষ্টেশন। তারপর যেমন যেমন যেমন কাজ আসবে, তেমন তেমন করতে হবে।
অপেক্ষা করছি যাত্রা শুরুর জন্য…
ক্রমশঃ
রহস্য আছে লেখায়।