বস্তির যিশু ✒️✒️ মৌসুমী

বস্তির যিশু

মৌসুমী

আজকের দিনে বস্তির সকলের ঘরে কেক খাওয়া হলেও হারান সামন্তর টিনের চালের ঘরে পায়েস হয়েছে।। হারানের বউ গৌরী পায়েস রেঁধেছে তার একমাত্র নাতি বিশুর জন্য।। বিদেশ থেকে ফিরছে বিশু তার ডাক্তারী পড়া শেষ করে। হারানের নাকে নতুন গুড়ের পায়েসের গন্ধ আসতেই হারানের তিরিশ বছর আগের দিন টা মনে পড়ে গেল।

সরকারি হাসপাতালে ডাক্তার দাদা যেদিন হারানের হাতে একটা ফুটফুটে সদ্যোজাত শিশুকে দিয়ে বলেছিল ‘হারান আজ পঁচিশে ডিসেম্বর তোমার ঘরে যিশু এসেছে।। কিন্তু মুর্শিদাবাদ গ্ৰামের অশিক্ষিত হারানের কাছে যিশু নামটা নতুন।। যিশু কে সেটা হারান সামন্ত রা ঠিক মতো জানে না।। তাই সেদিন ডাক্তারের দেওয়া যিশু নামটা হারানের কাছে বিশু হয়ে যায়।।

সরকারি হাসপাতাল থেকে বস্তি মাত্র চল্লিশ মিনিটের পথ সাইকেলে।। পথে যেতে হারানের মনে পড়ছিল সেই দিনটা যেদিন রথীন, কাশীদের মতো কয়েকজন বন্ধু নিয়ে ঝিমলি কে তার শ্বশুর বাড়ি থেকে উদ্ধার করে নিয়ে এলো বস্তিতে।। ঝিমলি হারানের একটি মাত্র মেয়ে।। যে সময় ঝিমলি কে হারান নিজের কাছে নিয়ে আসে সে সময় ঝিমলি অন্ত্যস্বত্বা।।

মুর্শিদাবাদে যতটুকু জায়গা ছিল সব বিক্রি করে একমাত্র কন্যা ঝিমলি আর অসুস্থ স্ত্রী গৌরী কে নিয়ে মফস্বলে একটি ঘিঞ্জি বস্তিতে একটা ঘর নিয়ে থাকতে শুরু করে।। বন্ধু কাশীর সাহায্যে ওই বস্তির বাইরে একটা দেওয়ালে পান, গুটখা, বিড়ি সিগারেটের ঘুমটি দোকান খোলে হারান। ( এই দেশের মানুষের একটা বিশেষ গুণ আছে।। একটি পথ শিশু কে বিস্কুট কিনে দিতে মন চায় না অথচ হাজার হাজার টাকা তামাকের জন্য খরচ করে) ।।

একদিন পল্টু নামে বৌবাজারের ছেলে পেশায় একটি রিক্সাচালক এর সাথে ঝিমলি পালিয়ে যায়।। কিন্তু বিয়ের পর থেকে মদ আর জুয়া ঝিমলি কে একদিন ও পল্টুর সাথে সুখে দুখে সংসার করতে দেয়নি।। রোজ রাতে মদ খেয়ে ঝিমলি কে মারতো পল্টু।। যখন অত্যাচার চরমে চলে যায় তখনই এক পরিচিতর থেকে হারান ঝিমলি খবর পায় আর সাথে সাথে নিজের কাছে নিয়ে আসে।।

কিন্তু বিশুর জন্মের তিন মাস পরে অপুষ্টি জনিত কারণে ঝিমলি পৃথিবীর সব মায়া কাটিয়ে ছোটো বিশু কে তাদের কাছে রেখে চিরদিনের মতো চলে যায়।। সেই থেকে হারান এবং তার স্ত্রী গৌরী বিশু কে অনেক কষ্টে বড় করে।।

পঁচিশ বছর পর

হারান দাদু, ও হারান দাদু, বস্তির মোড়ে একটা গাড়ি থেকে খুব সুন্দর একটা লোক নেমে এই দিকে আসছে গো! হাঁপাতে হাঁপাতে কথাটা বলল জবা।। হারান জবার কথা শুনে দরজার দিকে যেতেই দেখে লম্বা, সুদর্শন একটা ছেলে হারানের সামনে দাঁড়িয়ে।। হারানের পা ছুঁয়ে প্রণাম সেড়ে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলল, দাদু ভেতরে যাবে না! বিশু কে জড়িয়ে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল হারান।।

ঘরে গিয়ে পরিস্কার হয়ে গৌরীর রাঁধা পায়েস তৃপ্তি
করে খেয়ে বিশু বলল, দাদু তোমাকে আর দিদা কে আমি আমার কাছে আমার নতুন ফ্ল্যাটে নিয়ে রাখবো।।

দুপুরে বস্তির ছোট বড় সবাই বিশু কে দেখতে এলো।।। সকলের খুব আনন্দ তাদের বস্তির বিশু আজ ডাক্তার বিশ্বরূপ সামন্ত, তাদের বস্তির যিশু।। বিশু সবাই কে কথা দিলো বস্তির সকলের চিকিৎসার দায়িত্ব তার।। সেই দিন সন্ধ্যায় ডাক্তার বিশ্বরূপ সামন্ত বস্তির সবাই কে মাংস ভাত খাওয়ায়।।।
সকলের কাছে সে বিশু নয় তাদের বস্তির যিশু।।।
তবে বিশুদের যিশু হওয়ার লম্বা সফর টা যে কতটা কষ্টের, দুর্গম, কত ক্রুশ বিদ্ধ হতে হয়েছে সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে সে গল্পটা নয় থাক।। বস্তির গরীব, অসহায় মানুষ গুলো যে তাদের নিজেদের রক্ষাকবচ একটা যিশু পেয়েছে এটাই শেষ কথা।।।
বস্তির মানুষ গুলোর জন্য বিশ্বরূপ সামন্ত মতো একটা বস্তির যিশু খুব দরকার এই সময়।।,শুধুমাত্র বেথলেহেমে নয় কলকাতার অনেক বস্তিতেও যিশুদের জন্ম হয়।।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *