পর্ব পাঁচ মিরুজিন আলো ✒️✒️ বিজয়া দেব ।

পর্ব পাঁচ

মিরুজিন আলো
বিজয়া দেব ।

রায়কাকা কাগজকলম চাইল। জুহি এনে দিল। রায়কাকা লিখল – অন্ধকারে অনেক জীব। দিনে তাদের দেখে কেউ চিনবে না।  কথায়বার্তায় ভদ্দরলোক। এদিকওদিক ছড়িয়ে থাকে। ছেলেপুলেকে উপদেশ দেয়। বৌকে জড়োয়া গয়না দিয়ে খুশি করে। রাতে হারিয়ে যায় অন্ধকারে। সেখানে তরলের ফোয়ারা, সেখানে হৈ হল্লা ।সেখানে অবাঞ্ছিত শিশুদের রাখা হয় এক ঘুপচি ঘরে সারারাত। লম্বা এক বিছানায় সারসার শিশু। এদের মা – রা তখন কাস্টমার সামলাচ্ছে। এই শিশুগুলোর বেশিরভাগই বড় হয়ে নারীপাচারকারী দালালদের ডানহাত হয়ে যায়। আমিও তাই হয়েছিলাম।
জুহির দিকে খাতাটা এগিয়ে দিয়ে রায়কাকা গুম হয়ে বসে রইল। দেবাংশী উঠে এসে জুহির হাতে ধরা খাতাটির লেখা  পড়ল খানিকটা ঝুঁকে। তারপর বলল – জগবন্ধু, আর বলতে হবে না। আমি সব বুঝেছি। জুহি, তুমি ওকে ওসব কথা শোনাতে বাধ্য করো না।
দেবাংশী আর  এঘরে না থেকে বেরিয়ে গেল। জুহির কেমন যেন ভয় ভয় করছে। মনে হচ্ছে ঐ সামনে বসে থাকা লোকটি যেন তার রায়কাকা নয়। রায়কাকা যেন এক ঘোরের মধ্যে রয়েছে। রায়কাকা আবার বলতে শুরু করল,
-কিন্তু আমার মা আমাকে খুব কষ্ট করে পড়িয়েছিল। খানিকটা পড়াশোনা। ঐ মাধ্যমিক পর্যন্ত। মনে করেছিলাম একটা ভালো কাজ কিছু জুটে যাবে কিন্তু যেখানে যাই লোকজন কী করে যেন জেনে যায় আমি মহল্লায় থাকি। তারপর কত যে অকথ্য কথা বলে। সবার আঙুল আমার মায়ের দিকে। আমার মা, আমার ঈশ্বর। ঐ মায়ের সম্পর্কে ওসব খারাপ কথা আমার সহ্য হত না। মনে হত ঘুষি মেরে সবগুলোর নাকমুখ ফাটিয়ে দিই। একদিন ঘটে গেল মারাত্মক এক ঘটনা। মা-র জন্যেই আমি কাজের খোঁজে বেরোতাম রোজ। মা চাইত আমি একটা ভদ্রগোছের কাজ নিই। একটা আলাদা ঘর নিয়ে থাকি। মার স্বপ্ন ছিল আমি যেন বিয়ে করে সংসার করি। আমার যে ওরকম ইচ্ছে ছিল না তা বলতে পারি না। কিন্তু আমি জানতাম ওসব দিবাস্বপ্ন, বাস্তবে ওসব হবে না। এরকম হয় না। জীবন মোটেই রূপকথা নয়। একদিন এভাবেই কাজের খোঁজে গেছি। এভাবেই অপমানিত হয়েছি। একজন আমার গলা ধাক্কা দিয়ে বলল – খানকির বাচ্ছা, যা এখান থেকে। মাথায় রক্ত উঠে গেল। মা আমার সব, সবকিছু। কত কষ্ট করে মা আমাকে বড় করেছে সে আমি ছাড়া আর কে জানে! মা তো ইচ্ছে করে এই মহল্লায় আসে নি। তাকে কিছু খারাপ লোক তুলে এনে এই মহল্লায় বিক্রি করে দিয়েছিল। তারপর আমার মা একবার তো ফিরেও গিয়েছিল আমার দাদুর বাড়িতে। ঐ মহল্লারই একটি লোক তাঁকে সাহায্য করেছিল। ঐ লোকটা মার খেয়ে মরে গেল জানো! মাকে পালাতে সাহায্য করেছিল বলে। দাদু মাকে আর বাড়িতে তোলেনি। মা আবার ফিরে এল মহল্লায়।
-কিন্তু তুমি কি করলে রায়কাকা? যেখানে কাজ খুঁজতে গিয়ে খারাপ কথা শুনে মাথায় রক্ত চড়ে গেল?
-ওখানে? দিলাম এক ঘুষি একেবারে নাক বরাবর। চারপাশে সোরগোল। দেখলাম লোকটার নাক ফেটে রক্ত পড়ছে। তারপর একমাস জেল খাটলাম। মা তো কেঁদে কেঁদে পাগল। শরীর খারাপ হয়ে গেল তাঁর আমার জন্যে। শরীরটা এমনিতেই খারাপ ছিল। তিনদিনের জ্বর হয়ে মা মারা গেল। জেলফেরত যখন মহল্লায় ফিরলাম তখন সবাই আমাকে বোঝাল এখানকার হয়ে যেন কাজ করি। কারণ মহল্লায় একবার ঢুকে গেলে দুনিয়ার দরজা বন্ধ হয়ে যায়। আমিও ভেবে দেখলাম কথাটা সত্যি। আমি মহল্লার কাজেই ঢুকলাম। রাতের অন্ধকারে পাচার করে আনা মেয়েদের এনে মহল্লায় ঢুকিয়ে দিতাম। ঐ কাজ যারা করত তাদের খাতায় দাসখত লিখলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওখানেও পারলাম না।
-কেন?
-পারুল। পারুলের জন্যে।
-পারুল?
-আমি বড় পাপী, বড় পাপী।
রায়কাকা এরপর বলা বন্ধ করে দিল। সারাটাদিন আর মুখ খুলল না। নিজের কাজকর্ম করছে পুতুলের মত। তবে ওকে একটু স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। অন্যদিনগুলোতে যেমন গুটিশুটি হয়ে থাকে, আজ যেন তেমনটা নয়, অনেকটা স্বচ্ছন্দ যেন। জুহি কৌতূহল দমন করল। চাপ দেওয়া ঠিক হবে না। আজ নয়, একটু একটু করে তাকে জানতে হবে।
রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেল হঠাৎ। গাঢ় অন্ধকার। কারেন্ট নেই। এরকম সচরাচর হয় না। ভীষণ জল তেষ্টা। টেবিলে জল রাখা আছে। এই বড় বাড়িটায় মাত্র তিনজন মানুষ। কেউ কারো কাছে নেই। জুহির সঙ্গে নিজের মানসিক দূরত্ব অনেকখানি। ইচ্ছে করলেও সেই দেয়াল ভাঙ্গা খুব সহজ কাজ নয়। জগবন্ধু আছে অথচ থেকেও নেই। খুব পীড়িত এই লোকটির জীবন, অনেক কাহিনি এর অতীতজীবনে। জানতে চায় না দেবাংশী। কেন কে জানে অন্ধকারের গল্পগুলোর পৃষ্ঠা ওল্টাতে ভয় করে আজকাল। ভালো লাগে না। মনে হয় তরতর করে বয়ে যাক সময়। আর কিছু নয়, বাকি সব অন্ধকারের তাকে আলগোছে তোলা থাক। ওগুলোতে ধুলো জমুক।
ঝপ করে আলো এল। শোবার ঘরের নীলাভ আলোর ভেতর কিউবিক পেন্টিং এর আদলে টেবিল জলের গ্লাস কলমদানি ডাকছে দেবাংশীকে।

একঢোক জল খেল দেবাংশী। এক মেদুর অস্পষ্ট নীলাভ আলোর ভেতর অদেখা আলোর ভাঙ্গচুর। কোথা থেকে আসছে এই আলো? পর্দা সরিয়ে জানালায় দাঁড়াল দেবাংশী।  বাইরে এক  অলৌকিক পৃথিবী হাজারও প্রশ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মানুষের অন্তরের মত গায়ে তার আলোর রহস্যালোক।
(ক্রমশ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *