পুরুলিয়ার গ্ৰামীণ অর্থনীতির উপর হাটের গুরুত্ব ✒️ কল্পোত্তম

পুরুলিয়ার গ্ৰামীণ অর্থনীতির উপর হাটের গুরুত্ব

কল্পোত্তম

পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য জেলাগুলির তুলনায় অর্থনীতির দিক থেকে পুরুলিয়ার অবস্থান একেবারে পেছনের সারিতে। এর মূল কারণ হিসেবে এই জেলার ভৌগোলিক অবস্থান, ভূমির গঠন, সর্বাধিক জায়গা জুড়ে অনুর্বর মৃত্তিকার উপস্থিতি এবং ভৌম জলের স্বল্পতা বিশেষ ভাবে দায়ী। তবে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়ার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো সরকারি পরিকল্পনাগুলোর বাস্তবায়ন না হওয়া। এর জন্য স্থানীয় নেতা-নেত্রী এবং এই অঞ্চলে নিযুক্ত আধিকারিকরা বিশেষ ভাবে দায়ী।
স্বাধীনতার পর থেকেই পিছিয়ে পড়া পুরুলিয়ার উন্নয়নের জন্য চাষবাস, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য নানা ক্ষেত্রে একের পর এক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। সেইসব পরিকল্পনার আন্তরিকভাবে রূপায়ণ না হওয়ার কারণে অর্থনৈতিক দিক থেকে পুরুলিয়ার অবস্থান রয়ে গেছে পূর্ববৎ।
স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময় এবং তার পরবর্তী দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর সময়জুড়েও এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থার তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি। শিক্ষার হার সরকারি হিসেবে বেশি করে দেখানো হলেও বাস্তবের মাটিতে দেখা যায় পুরুলিয়া জেলার গ্ৰামাঞ্চলের প্রায় নব্বই শতাংশ সরকারি স্কুলের ফাইভ, সিক্স, সেভেন ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীরা রিডিং পড়তেও জানে না। তাছাড়া এই অঞ্চলের কাছাকাছি সেইভাবে কোনো অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিযুক্ত শহরও নেই। তাই শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠেনি। যার ফলস্বরূপ এই অঞ্চলের মানুষের চাহিদার তুলনায় কাজের যোগান একেবারেই কম। আর অর্থনীতির নিয়ম অনুসারে যেখানে কাজের পরিমাণ কম এবং লেবারের যোগান বেশি সেখানে লেবারের দাম কমে আসবে স্বাভাবিকভাবেই। তাই পুরুলিয়াতে এখনও (ইদানিং গড়ে ওঠা ছোটো ছোটো শহরগুলো বাদ দিলে) একশো দেড়শো টাকার বিনিময়ে সারাদিন কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন মানুষ।
কেন্দ্রে অটল বিহারি বাজপেয়ি প্রধানমন্ত্রী হয়ে আসার পর গ্ৰামাঞ্চলের উন্নয়নের লক্ষ্যে “গ্রামীণ সড়ক যোজনা” শুরু হয়। সেসময় এই প্রকল্পের আওতায় পুরুলিয়া জেলার অনেকাংশ জায়গা জুড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। ফলে আর কিছু সুবিধা হোক বা না হোক প্রত্যন্ত এলাকায় বসবাসকারী চাষীদের বহুকষ্টে উৎপাদন করা সবজিপাতি স্থানীয় বাজারগুলিতে বাজারজাত করা সম্ভব হয়।
পুরুলিয়া জেলার গ্রামীণ অর্থনীতি মূলত দাঁড়িয়ে আছে ক্ষুদ্র চাষীদের চাষবাস থেকে উৎপাদিত পণ্য, বন্য ও পাহাড়ি অঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা গাছের কাঠ, পাতা, দাঁতন, বিভিন্ন ধরনের হস্তশিল্প, পশু পালন এবং ক্ষুদ্র শহর ও বাইরের জেলা বা রাজ্যে গিয়ে মজুরি করে পাওয়া সামান্য বেতনের উপর।
চাষিদের এই উৎপাদিত শাক-সবজি, বিক্রির যোগ্য হয়ে ওঠা হাঁস, মুরগী, গরু, ছাগল, ভেড়ি, পাহাড় ও জঙ্গল থেকে সংগ্ৰহ করে আনা কাঠ, পাতা, দাঁতন, হাতে তৈরি করা চাটাই, ঝাঁটা, কুলা, ঝুড়ি, কুমোরদের তৈরি নানা রকম মাটির পাত্র যেমন কলসি, ভাঁড়, তাওয়া, যাযাবর জাতি মালোয়ারদের এলুমিনিয়াম ও পিতল দিয়ে তৈরি পয়লা, সেরা, পাই, প্রভৃতি বিক্রি করার জন্য ধীরে ধীরে বেশ কিছু হাট গড়ে ওঠে। এই হাটগুলোই পণ্যের বিনিময়ে অর্থ রোজগারের কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে শেষ পর্যন্ত।
পুরুলিয়া জেলার আনাচে কানাচে এমন অসংখ্য হাট রয়েছে। যার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটা নিয়ে আলোচনা করবো আমি।
১/ বলরামপুর হাট—- বলরামপুর শহরের নিকটে বসা এই হাট বহু পুরাতন এবং বহু জনপ্রিয়। এই হাটে কেনাবেচার জন্য ঐ এলাকা বা শুধুমাত্র পুরুলিয়া জেলা নয়, কাছাকাছি অন্যান্য রাজ্য থেকেও বহু মানুষ এসে থাকেন। গরু, কাড়া(মহিষ), ছাগল, ভেড়া, হাঁস মুরগী থেকে শুরু করে প্রায় সমস্ত কিছু পাওয়া যায় এই হাটে। দূর দূরান্ত থেকে আসা গরু-কাড়া পাইকার বা অন্যান্য পাইকারদের সমস্ত রকম সুরক্ষার জন্য হাটের চারপাশে উঁচু দেওয়াল দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে। হাট থেকে বেরোনোর মূল রাস্তাগুলোতে গেট বসানো হয়েছে। যাতে কেউ চুরি করে পালিয়ে যেতে না পারে।
এই হাট প্রতি মঙ্গলবার বসে। বর্তমানে হাটের ভিতর দু’একটা স্থায়ী দোকান থাকলেও বাকি সমস্ত দোকান অস্থায়ী। সাপ্তাহিক এই হাটে লক্ষাধিক ক্রেতা বিক্রেতার আগমন ঘটে। এছাড়াও ২/ কাশিপুর (বৃহস্পতিবারে বসে) হাটের চরিত্র এবং লোকসমাগম প্রায় একই। তবে ৩/ঝালদা (মঙ্গলবারে বসে) ৪/তালতল (রবিবারে বসে) ৫/বরটাঁড় (সোমবারে বসে) এবং ৬/কালিমাটি হাটের চরিত্র একই রকমের হলেও এই হাটগুলো খোলামেলা জায়গাতে বসে আসছে শুরু থেকে। ফলে এই হাটগুলোতে কোনো স্থায়ী দোকান নেই।
পুরুলিয়া জেলার কাঠের হাটগুলোর মধ্যে সুপরিচিত হাটগুলো হল– ১/ কাঁটাডি ২/ ছোটো উরমা ৩/ সুইসা ৪/ ডাভা ৫/ কুত্থিটাঁড় ৬/ বরাবাজার ৭/বান্দ্যোয়ান ৮/ রাইডি-বেড়াদা ৯/ তুলিন প্রভৃতি। এইসব হাটগুলোতে জ্বালানি কাঠ সহ কাঠের তৈরি খাট, হাল, জুঁয়াল, রোলা, এবং গাঁইতি, কোদাল, কুড়ুলের বোঁটা সহ শালপাতা দাঁতন প্রভৃতি পাওয়া যায়। এছাড়াও শাক-সবজি, বিভিন্ন হস্তশিল্প এবং কোথাও কোথাও বাদ দিয়ে প্রায় সমস্ত হাটেই হাঁস মুরগি পাওয়া যায়। পুরুলিয়া জেলার প্রায় সমস্ত হাটেই স্থানীয় সাঁওতাল মহিলারা হাঁড়িয়া (ভাতের সঙ্গে বাখর মিশিয়ে তাকে তিনদিন রেখে তারপর সেটা থেকে তৈরি একপ্রকার পানীয় দ্রব্য) বিক্রি করার জন্য নিয়ে আসেন।
এছাড়াও চার পাঁচ কিলোমিটার অন্তর অন্তর সাপ্তাহিক এবং অর্ধ সাপ্তাহিক শাক সবজির হাট বসে। স্থানীয় এলাকার ক্ষুদ্র চাষিরা এইসব হাটগুলোতে উৎপাদিত দ্রব্য বিক্রি করে পাওয়া অর্থে সংসার প্রতিপালন করে থাকেন।
স্থানীয় হাট গুলোতে কেনাকাটা করতে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা এতো বেশি থাকে যে, একটু বড় মাপের হাটের দিন ঐ হাটের সাত আট কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে থাকা গ্ৰামগুলোতে ঘরে থাকার লোক থাকে না। বাচ্চাদের হাতে ঘরের চাবি ধরিয়ে দিয়ে সকলেই চলে যান হাটে। ফেরেন সেই বিকেল বেলা। তাই ঐ এলাকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলোতে ঐ দিনই সাপ্তাহিক মর্নিং স্কুল বসার দিন নির্ধারণ করা হয়। যাতে বাচ্চারা তাড়াতাড়ি স্কুল থেকে ফিরে এলে তাদের হাতে চাবিকাঠি তুলে দিয়ে নিশ্চিন্তে হাটে যেতে পারেন ঘরের লোক।
বলতে গেলে পুরুলিয়া জেলার গ্ৰামীণ অর্থনীতির মেরুদণ্ড হলো এই হাটগুলো। এগুলোকে কেন্দ্র করেই এখানকার অর্থনীতির চাকা সচল থাকে।

______________

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *