দুর্গাপূজার একাল-সেকাল ✒️✒️ ছন্দা চ্যাটার্জি

প্রবন্ধ

দুর্গাপূজার একাল-সেকাল

ছন্দা চ্যাটার্জি

বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ জাতীয় উৎসব দুর্গাপূজা।এই উৎসবের প্রাক্কালে শুধু বাঙালির প্রাণজগতে নয়, প্রকৃতিজগতেও যেন অমেয় আনন্দের ঢেউ বয়ে যায়।শরতের সোনালী আকাশে,শিউলিঝরা আঙিনায়,শষ‍্যশ‍্যামল মাঠে,জলে-স্থলে সর্বত্র প্রাণের প্রাচুর্য ও সম্পদের মহিমা হিল্লোলিত হতে দেখা যেত পঞ্চাশ বছর আগেও। পুরোনো আমলের পূজার আয়োজনের সঙ্গে বর্তমান পূজার কিছু পার্থক্য নির্দেশ করার জন‍্য আজ এই প্রবন্ধের অবতারণা। অবিভক্ত বাংলায় একসময়ে বাঙালির জাতীয় উৎসব দুর্গাপূজা অক্লেশেই বলা যেত। এখন বলতে হয় হিন্দুবাঙালীর উৎসব। যাই হোক্, দেবী দুর্গা আরাধিতা হন-বিদ‍্যা,বিত্ত ও শক্তির মূর্ত প্রতীক হিসেবে।
প্রায় সাড়ে তিন’শ বছর আগে তাহেরপুরের হিন্দু রাজা কংসনারায়ণ এই মহাপূজার প্রবর্তন করেছিলেন তা শিক্ষিত বাঙালি মাত্রেই জানি।পুরাণে কথিত আছে রাবণবধের জন‍্য শ্রীরামচন্দ্র অকালবোধনের আয়োজন করেছিলেন। আসলে বঙ্গে বসন্তকালে বাসন্তী পূজাই প্রচলিত ছিলো।কংসনারায়ণ শ্রীরামচন্দ্রের অকালবোধনের -“থিম”- টাই গ্রহণ করেন। আবার অনেকের মতে ১৬১০ সালে বেহালার সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের মণ্ডপেই প্রথম দুর্গাপূজার প্রচলন হয়। এরপর ইংরেজ আমলে শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দেব এবং কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় পূজা প্রচলন করেন। তাঁরা রাজ-উপাধি ও রাজত্ব অর্জন করেছিলেন ইংরেজদের তোষণ করে। বাঈ নাচ দেখিয়েই ইংরেজদের কব্জা করেছিলেন তাঁরা।পূজার আয়োজনের মূল উদ্দেশ্যই ছিল সেটাই।বারোয়ারী দুর্গাপূজা শুরু হয় হুগলি জেলায়। বারোজন বন্ধু বা ইয়ার মিলে চাঁদা তুলে শুরু করেন বারোয়ারী দুর্গাপূজা।

দুর্গাপূজার সঙ্গে বাঙালির বিবাহিতা কন‍্যার তিনদিনের জন‍্য পিত্রালয়ে আগমনের একটা প্রতীকী সংযোগ আছে।তার জন‍্যই এই পূজার মধ‍্যে বাঙালির একটা আবেগ কাজ করে।একদিকে মা জগৎমাতা,মহাশক্তির আধার, আবার দেশমাতৃকাও তিনি।তাঁরই প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে। এই ছিল সেকালের বাঙালির দুর্গাপূজার -“থিম।” একদিকে মা অসুরদলনী,অন‍্যদিকে আদরিনী কন‍্যা।-“এবার আমার উমা এলে আর উমা পাঠাবো না”- সেকালে গ্রাম বাংলার আকাশ বাতাসে ঊষা নামতো ভোরের আগমনী সুরে।এই মাতৃমূর্তির দিকে তাকালে লেখতে পাই দশপ্রহরণধারিনী দেবীপ্রতিমার সমস্ত অবয়বে শত্রু নিপাতের দৃঢ়তা,অথচ তাঁর উজ্জ্বল প্রসন্ন চক্ষুতারকায় মধুর বাৎসল‍্যের আভাস। তাঁর বামে দক্ষিণে দেখো তাঁর সন্তান লক্ষ্মী,সরস্বতী,কার্তিক,গনেশ সহ তাঁর নিটোল পরিপূর্ণ ঘরখানি আমাদের একান্নবর্তী পরিবারের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।তাই সেকালের দুর্গাপূজার থিমই ছিলো একচালা ঠাকুর।
আমাদের শৈশবে দেখেছি সম্পন্ন ব্রাহ্মণ ও জমিদারবাড়ির পূজাই ছিল অঞ্চলের একমাত্র পূজা।আমাদের জ্ঞাতিবাড়ি ছিল সেই বাড়িটি। ষষ্ঠির বোধন থেকে শুরু করে বিজয়া দশমীর সিঁদুরখেলা সবই অনুষ্ঠিত হতো সেই বাড়িটিকে কেন্দ্র করে। অঞ্চলের সকলেই সেই আনন্দধারায় গা ভাসিয়ে দিত। রথের দিনে হতো খুঁটি পূজো,কাঠামোয় মাটি পড়ত। বাড়ির ঠাকুরদালানেই নির্মান শুরু হতো মাতৃমূর্তির। তিলে তিলে মৃন্ময়ী মূর্তি চিন্ময়ী রূপ পরিগ্রহ করতেন। ছোট ছেলেমেয়েরা রোজ ভীড় করে মূর্তি গড়া দেখতে যেতাম।

মহালয়ার ঊষালগ্নে রেডিও আকাশবাণীতে বেজে উঠতো -“বাজলো তোমার আলোর বেণু”-,বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের উদাত্ত কন্ঠে চণ্ডীপাঠ কীযে এক শিহরণ জাগাতো শিশুমনে তা বলে বোঝানো যাবেনা। আজ এই গতির যুগে টিভির বিভিন্ন চ‍্যানেলে যতই মহিষাসুরমর্দিনী দেখানো হোক, আমার মতো অনেকেই আছেন যাঁরা মহালয়ার ভোরে রেডিওই চালাবেন।
তখনো পূজায় চাই নতুন জামা।কিন্তু তা কখনোই আমাদের আব্দার জেনে হতো না।আমার দরিদ্র কেরাণী বাবা,আমার স্কুলশিক্ষক জেঠুমনি,আমার ব‍্যবসায়ী কাকুমনিদের ব‍্যক্তিগত আয়ে তফাৎ ছিলই। নিজের নিজের স্ত্রী সন্তানদের দামী কাপড় কিনে দেয়ার সঙ্গতি অনেকেরই ছিল।কিন্তু প্রবলপ্রতাপ ঠাকুদ্দার নিয়ন্ত্রণে মা-জেঠিমা-কাকিমা দের নিজেদের জন‍্য পৃথক মূল‍্যবান বস্ত্রাদি কেনার সাহস ছিলো না।শান্তিপুরে আমাদের বাড়িতে কুটিরপাড়ার তাঁতঘর থেকে শাড়িওলা আসতেন কাপড়ের গাঁঠরি নিয়ে।পূজো উপলক্ষ্যে বাড়ির প্রতিজন বৌ
,বিবাহিত মেয়েদের জন‍্য একই দামের একই নক্সার শাড়ি কেনা হতো। রং পছন্দ করার অধিকার অবশ‍্য বৌ ও মেয়েদের থাকতো।জ‍্যেঠতুতো খুড়তুতো,পিসতুতো সব ভাই ও বোনেদের জন‍্য আসতো জামা তৈরির থান ও ছিট কাপড়।প্রত‍্যেক ভাইএর জন‍্য একই কাপড়ের সার্ট-প‍্যান্ট (হাফপ‍্যান্ট), তৈরী করতেন দর্জিকাকু। বোনেদের জন‍্য একই ছিটের ও ছাঁটের ফ্রক তৈরী হতো।বারো বছরের ওপর দিদিদের জন‍্য আসত লাল,নীল,হলদে,সবুজ রঙের ওপর খড়কে ডুরে শাড়ি।অপেক্ষা করতাম কবে বড়ো হবো,ঐ রকম শাড়ি আমারও হবে। আমাদের আলাদা করে কোনও পছন্দ গড়ে ওঠেনি।মায়ের পূজোয় কারো মনে যেন হীনমন‍্যতা না ঘটে তাই পরিবারের মধ‍্যে থেকেই সাম‍্যবাদের এই শিক্ষা আমাকে আজও গর্বিত করে।তখন পূজোর আনন্দটাই ছিল আসল।সকাল থেকেই মা, ঠাকুমা, জেঠিমা,কাকিমারা পূজোর কাজ করতে চলে যেতেন সাবেকি পূজোবাড়ি। প্রতি দুপুরে ভোগ প্রসাদ বিতরণ হতো। কোনও বাড়িতে দুপুরে উনুন জ্বলতো না। সেই প্রসাদের স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে।রাতে হ‍্যাজাকের আলোয় ঝলমল করতো আঁধার গ্রাম। হ‍্যাজাক ঘিরে কী পোকা! কী পোকা! তখনো বৈদ‍্যুতিক আলো আসেনি। তবে ইলেকট্রিক তার সংযোগের কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল।তখন আমি বছর সাতেকের হবো।
সেই সময়ে শান্তিপুর স্টেশন অঞ্চলে বারোয়ারি পুজোয় নতুন ধরণের মূর্তির উদ্বোধন হলো।মা দুর্গা সিংহের পিঠ থেকে অসুরের ওপর লাফিয়ে পড়ছেন।তাঁর চোখে নাকি মাতৃত্বের লেশমাত্র নেই।দাদু, জেঠু,কাকুরা অবশ‍্য বলছিলেন,মায়ের চোখে একটু নরম ভাব থাকলে মুখখানা কিন্তু ঠিক সুচিত্রা সেনের মতো।ভালোই হয়েছে তবে ভক্তি আসছে না।পনেরো ষোলো বয়সের কিশোর দাদারা দশ বার করে ছুটছে সুচিত্রা সেন দেখতে। কার্তিক ঠাকুরের ফুল প‍্যান্ট,চোখে গগলস্,তীর-ধনুকের বদলে হাতে রাইফেল।গনেশ শুঁড় দিয়ে গদা বাগিয়ে তেড়ে যাচ্ছে অসুরের দিকে।লক্ষ্মী ও সরস্বতীর পায়ে হাইহিল জুতো,চোখে কোনা উঁচু চশমা। একচালা উধাও।অনেকটা জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে নিউক্লিয়ার ফ‍্যামিলি।বুড়োরা হাহাকার করছেন। সত‍্যিকারের মাতৃমূর্তি দর্শন করতে,অঞ্জলি দিতে ভীড় করছেন,সান‍্যাল বাড়ি,মৈত্রবাড়ি,লাহিড়ি ও মুকুজ‍্যে বাড়ির দুর্গাদালানে। তাঁদের সশঙ্ক প্রশ্ন হয়তো এমনই ছিল যে,এই মণ্ডপ পরিকল্পনাই কী একান্নবর্তী পরিবারের বিরক্ত সদস‍্যদের একান্ত বাসনা এইভাবে রূপ পরিগ্রহ করেছিলো। হয়তো বা!

কালপ্রবাহ বয়ে চলে।বর্তমানে থিম পুজোর রমরমা। চাঁদা তুলতে তুলতে আমরা কেউ কী একবারও লক্ষ্য করেছি যে, ভক্তিমার্গ নয়,জ্ঞানমার্গ নয়, আমরা লক্ষীকে ভুলে কুবেরের স্বর্ণসম্পদে লুব্ধ হাত বাড়িয়েছি? অজস্র অর্থ সংগৃহীত হচ্ছে,ক্লাবগুলো পাচ্ছে অনুদানসহ নানা রকম আনুকুল‍্য।মস্ত মস্ত ম‍্যারাপ বাঁধা হচ্ছে,বিচিত্র আধুনিকতার সাজে দেবীকে শ্রী থেকে সরিয়ে এনে চোখ ধাঁধানো ঔজ্জ্বল্যের মধ‍্যে বসিয়ে দিয়েছি। প্রতিযোগিতা বেড়ে বেড়ে দেবীপ্রতিমার উচ্চতাকে অতিক্রম করে গেছে আত্মদম্ভ।মিলনমন্ত্র পরিণত হয়েছে কলহবীজে।জোরালো লাউডস্পিকার চতুর্দিকে তার গর্জন ছড়িয়ে দিচ্ছে, তার কন্ঠনির্গত উৎকট ধ্বনিপুঞ্জের সঙ্গে সঙ্গীত বা দেবী কারো কোন সম্পর্ক আছে বলে আমি মনে করি না। হ‍্যাঁ,ঘরে ঘরে প্রসাদ বিতরণ করি বটে, এহ বাহ‍্য।
উৎসবে,ব‍্যসনে আমরা যা খরচ করি, দুর্ভিক্ষে তার কত শতাংশ ব‍্যয় করি? আর রাষ্ট্রবিপ্লব? বাদ দিলাম সে কথা।চলছে কার্ণিভাল,চলছে বিতর্ক। ইউনেস্কের স্বীকৃতি এবং বিতর্ক।

নিষ্প্রাণ শুষ্ক প্রমোদরীতির শরণী বেয়ে বছরের পর বছর অতিক্রান্ত, আমার সাত বছর বয়সের স্মৃতিতে মাতৃমন্দিরের পূণ‍্য অঙ্গন আর মহিমান্বিত হয়ে ওঠেনি। জেঠুমনিদের আক্ষেপ এখনো শুনতে পাই। তাঁরা অশনিসংকেত অনুভব করেছিলেন। তাই গরীব দাদার মেয়েকে ফুটপাতের সস্তা ছিটের জামা কিনে দিয়ে নিজের মেয়েকে দামী ড্রেস কিনে দিতে ছোট ভাইয়ের বাধে না।

মণ্ডপে কেবল কাঙালের উপস্থিতিই তো নয়,দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলো,যারা সন্তানের চোখের জল মোছাতে পারেনা, শিশুকে কোলে নিয়ে ম্লানমুখে এসে দাঁড়ায় মায়ের দুয়ারে,দূরাগত অতিথির মতো–তখন হঠাৎ বুঝতে পারি,সব ব‍্যর্থ হয়েছে,-
–“মিছে সহকারশাখা,মিছে মঙ্গলকলস।”– চতুর্দিকে ব‍্যানারে উচ্চকিত প্রচার করছি -“সার্বজনীন পূজা”-। হায়,মন্দিরের নিভৃত কোনেও ঐ শব্দ দুটির জন‍্য কোনো জায়গা রাখিনি।
-“দেবী প্রসীদ”– বলে যে মন্ত্র উচ্চারণ করবো, দেবী কী সত‍্যিই প্রসন্ন হবেন?

হায়, আমরা তবু ভুলে যাই। স্বত উদ্ভাসিত এই সত‍্যের মুখেও আবরণ পড়ে যায়, আমরা এতোই দুর্ভাগা। সার্বজনীন কথাটাকে পুজার একটা বিশেষণমাত্রে পরিণত না করে কবে তাকে আমরা আবার একটা পূজার চরিত্র করে তুলতে পারবো? হয়তো সেদিন বিলম্বিত,তবু সেই মহাপূজার দিনের জন‍্য আমাদের সমগ্র সাধনা উন্মুখ হয়ে থাকুক। আজ আমাদের মহাপতনের হতভাগ্য দিনকে অতিক্রম করে চতুর্দিকে যেন হিংসা,দ্বেষ ঘৃণাকে পদদলিত করে সার্বজনীনতার মন্ত্র জেগে ওঠে। স্বতন্ত্র করে যেন কাউকে শেখাতে না হয়।
-“দেবী প্রসীদ।”–

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *