যদিও দুপুর তবুও রাত্রি এখন ✒️✒️ ম ধু মি তা বে তা ল

যদিও দুপুর তবুও রাত্রি এখন
ম ধু মি তা বে তা ল

(৬)
“মাতৃত্বই নারীসত্তার লক্ষ্মণ-গণ্ডি”
আবহমানকাল ধরে পুরুষ সামাজিক বন্ধনে ও তাদের কাল্পনিক নির্মণের মাধ্যমে নারীকে কয়েকটি রূপে মুড়ে রাখতে চায় ও রেখেছেও। সেইগুলি হোলো মা, বোন, স্ত্রী এবং কন্যা। এর বাইরে আর সব নারীই যেন সাধারণ পরনারী। আর পরনারীর ক্ষেত্রে তো যেকোনো শব্দই ব্যবহার করা যায়– অপয়া, কুলটা, নষ্টা, ভ্রষ্টা চরিত্রহীনা ইত্যাদি। একটি স্বতন্ত্র ও সাকার অস্তিত্বের অধিকারী হয়েও নারী কখনও নিজের পরিচয়ের স্রষ্ঠা হতেই পারলো না। পুরুষ কখনও সব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে নারীকে শুধুমাত্র একজন নারী হিসেবে দেখতে বা ভালোবাসতে বা সম্মান দিতে পারলো না। নারীর পূর্ণতা নাকি মাতৃত্বেই। নারীর আর সব গুণই যেন নির্গুণ। তাই যারা মা হতে পারে না তাদের নারীজীবন বৃথা বলে এ-সমাজ মানে ও তাদের বন্ধা জাতির তকমা লাগিয়ে অপয়ার তালিকায় ফেলে দেয়। অন্তত আমাদের দেশে আজ পর্যন্ত কোনো নারীই মা হব না বলে একতরফা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। এখানেও নিজেকে সম্পূর্ণ নারী বলে প্রমাণ দেওয়ার জন্য তাকে অবশ্যই মা হতে হয়। পুরুষ নিয়ন্ত্রিত সমাজ নারীদের জন্য একটা বিশেষ জাতিও নির্ধারণ করে দিয়েছে– তা হলো ‘মায়ের জাত’। নারীত্বের অন‍্যতম শ্রেষ্ঠ প্রকাশ ও বিকাশ মাতৃত্ব হলেও, এক্ষেত্রে আমি বলবো নারীদের আসলে কোনো জাত হয় না। নারীকে বহুরূপেই সজ্জিত হয়ে সুখে-আনন্দে, দুঃখে-শোকে, যুদ্ধে-ঝঞ্ঝায় অবতীর্ণ হতে হয়। কখনও স্ত্রী, কখনও মেয়ে, কখনও বোন। নারী কিন্তু কখনোই সর্বদা নিজেকে মা-নামের ভাবমূর্তিতেই বেঁধে রাখতে পারে না বা সে চায়ও না। তাই সব সম্পর্কের মায়াজালেই নিজেকে সঁপে দেয়। নারীর অনেক গুণপনার মধ্যে মাতৃত্ব অন্যতম, তবে তা একমাত্র নয়।

“নারী জলের মতন পরিবর্তনশীল”
বিয়ের পরে পরেই নারীর পরিবার, বাসস্থান, পারিবারিক ভূমিকার সঙ্গে তার গোত্রেরও পরিবর্তন ঘটে। আর বিধর্মী বা ভিন্ন সম্প্রদায় বা জাতের পাত্রের সঙ্গে বিবাহের ফলে নরীটিকেই ধর্ম বা সম্প্রদায় বা জাত পরিবর্তন করতে হয়। এমনকি নামেরও পরিবর্তন ঘটাতে হতে পারে। এক্ষেত্রেও দায়টা এসে পড়ে নারীর ওপরেই। উপাধি অথবা পদবীর ক্ষেত্রেও একই নিয়ম মেয়েদের জন্য প্রযোজ্য। তবে এখন অনেক মেয়েই বিবাহ পূর্ববর্তী পদবীও একই সঙ্গে ব‍্যবহার করে। এতে হাঁসজারুজাতীয় সমস‍্যাও হয়‌। অনেক মেয়েরই মনে কাজ করে যে প্রচলিত সংস্কারটাই যেন ঠিক। আবার কেউ কেউ মনে করে মেয়েরা বিয়ের পরে স্বামীর পদবীটা ব্যবহার করবে এটাই তো স্বাভাবিক। তাদের একবারও মনে হয় না যে, তারা ইচ্ছে করলেই জন্মসূত্রে পাওয়া বাবা-মায়ের যে পদবীটা এতদিন ব্যবহার করে এসেছে, বার্থ সার্টিফিকেটে, শিক্ষাগত একাধিক শংসাপত্র ও নথিতে, ভোটার কার্ড ও আধারে যে পদবী ব‍্যবহৃত হয়েছে, সেটাই বিয়ের পরেও ব্যবহার করা যায়। এমন কি পদবীহীন নিজের নামটুকুও ব্যবহার করার আইনগত অধিকার তার আছে। এইরকম আরও অনেক ক্ষেত্রে মেয়েদেরই সচেতনভাবে এই বিষয়গুলোকে নিজের জীবনে কার্যকর করার জন্য বিশেষ এগিয়ে আসা দরকার। পক্ষান্তরে উল্টো ছবিই পরিলক্ষিত হয়। এতদিন ধরে মেনে নেওয়া, খাপ খাইয়ে নেওয়া, আপোষ করা, নিজেকে পরিবর্তন তথা রূপান্তরের মাধ‍্যমে হাজার সমস্যা মকাবিলা করার মাধ‍্যমে নারীকে শুধু টিকে থাকতে হয়। মেয়েদের এই মেনে নেওয়ার শিক্ষা ও তার অনুশীলন খুব ছোটো থেকেই ঘরে ঘরে শুরু হয়ে যায়। নারী তার পরনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের মাধ‍্যমে অনেকটা জলের ধর্ম লাভ করে। বাবার সংসারে একরকম, স্বামীর সংসারে স্বামীর মতো, আবার ছেলের সংসারে ছেলে-বৌমার মতো করে মানিয়ে থাকতে হয়। আমাদের সমাজে মা-মেয়ে এবং শাশুড়ি-বৌমার সম্পর্ক এক নিক্তিতে মাপা হয় না বলে নারীর সমস্যা বহুগুণিত। নারীর এই যাপনগত পরিবর্তন, রূপান্তরের আত্মগত শক্তি কিন্তু কখনোই, কোথাও শংসিত হয় না। নিজের লোকজনও নারীর এই অন্তর্গত শক্তিকে শ্রদ্ধা তো দূরের কথা, মেনে নিতেই চায় না। সামাজিক যত পরির্তন শুধু নারীর জন্যই।

“স্ত্রী সীল-মোহরের মানবী আসলে পরিচারিকা”
এখনও অনেকেই মনে করেন নারী বিষয়ক যেকোনো আলোচনাই ঠিক না। তা অশ্লীল অথবা বিতর্কিত। আমি এই বিতর্কের পথে গিয়েই বলবো নারী বা নারীদের অধিকার নিয়ে যত কথা বলা যাবে সমাজ ততই উন্নত চেতনায় জাগ্রত হবে। নারীর হাঁটা-চলা-কথাবলা-হাসি সবকিছুরই হেতু ও পরিমাপ নির্ধারণ করে পুরুষ। আবার পুরুষ নারীকে বিয়ের জন্য নির্বাচন করে নারীটির শারীরিক গঠন ও যৌন-সৌন্দর্যের উপর ভিত্তি করে। তার মেধা-মনন-জ্ঞান-শিক্ষা-দীক্ষার বিশেষ কোনো মূল্যই দেওয়া হয় না। বিচার করা হয় তার কুমারিত্ব নিয়েও। তার আচার-আচরণ, শারীরিক গড়ন দেখে সতীত্বের সিদ্ধান্ত নেওয়াও হয়। বিয়ের পাত্রীর জন্য গালভরা স্তুতি হলো ‘লক্ষ্মীমন্ত’, ‘শ্রীময়ী’। তারপর বিয়ে হওয়ার পর তার চরিত্রের ওপর ” স্ত্রী ” নামক বিশেষ সীল-মোহর দিয়ে ঘরের পরিচারিকা হিসেবে মান্যতা দেওয়া হয়। এরপর এই পুরুষটিই শর্তসাপেক্ষে তার জীবনের ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান পরিচালনা করবে‌, ওঠা-বসা-খাওয়া-পরা-চলাফেরা ইত্যাদি ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করবে। নারীর জীবনের নিজস্ব কোনো চাহিদা সংসারে গুরুত্ব পায় না। যেন তা থাকতেও নেই। নারী শারীরিকভাবে অসুস্থ বা অকেজো হলে পুরুষকে অন্য নারীর সন্ধান করতে হতে পারে। অথচ পুরুষের অক্ষমতার সাত খুন মাপ হয়ে যাওয়াই দস্তুর। নারীর অন‍্য পুরুষ খোঁজা কিন্তু মহাপাপ। তাই নারীদের অন্যের জন্য নিজেকে সবসময় সুস্থতার প্রমাণ দিতে দিতে বেঁচে থাকতে হয়। নারীদের সুস্থ-অসুস্থতার বিষয় যেন কোনোভাবেই গুরুত্ব পেতে চায় না। নারীর কাজই হচ্ছে অন্যের জন্য বেঁচে থাকা, নিজের জীবন বিলিয়ে দেওয়া। এই বাধ্যবাধকতা নারীরা নতমস্তকে স্বীকারও করে নেয়।

“পিছুটানটুকু পিছনেই পড়ে থাক”
স্বামী-সন্তান-সংসারের মায়াজালে জড়িয়ে পড়া একজন বিবাহিতা রমণীর অনিবার্য ভবিতব‍্য। অনেক চেষ্টাতেও কিছুতেই এই পিছুটান মেয়েরা ছিন্ন করতে পারে না। বাপের বাড়ির নামের পিছুটান, শ্বশুরবাড়ির কৌলিন‍্যের পিছুটান, বিভিন্ন সংস্কারিক পিছুটানও তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। এই বহুবিধ পিছুটানেই নারী তার নিজত্বকে হারিয়ে ফেলতে ফেলতে একটা সাংসারিক যন্ত্রে পরিণত হয়। তখন তার নিজের জন্য কিছু ভাবাও নিছক স্বার্থপরতা মনে হতে থাকে। ফলে নারীশক্তির সিংহভাগই অন‍্যের জন্যে ব‍্যয়িত হয়ে যায়। তার সংসার বা পরিবারের জন্য নিঃস্বার্থ শ্রম ও সময় দান কোনোভাবেই মূল্য ও মর্যাদা পায় না। নারীর মনন-মেধা রান্না-মাজা-মোছা-কাচাতেই ধোয়া হয়ে যায়। নারীশক্তির অন্তর্গত স্ফুলিঙ্গের তাই বড়ো অভাব। আর এই কারণেই বুঝি অনেকটা পিছিয়ে পড়ছে নারীমুক্তি আন্দোলনের রথ। তাই সবার আগে বলবো নিজস্ব চাহিদা ও অবস্থান বুঝে নারীদেরকেই আগে সর্বাঙ্গীনভাবে নারীবাদী হতে হবে। তবেই নারীমুক্তির নবসূর্য উদিত হতে পারে।
( চলবে )

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *