ধারাবাহিক গল্প। কন‍্যাশ্রী। চতুর্থ তথা অন্তিম পর্ব। ছন্দা চট্টোপাধ্যায়।

ধারাবাহিক গল্প।
কন‍্যাশ্রী।
চতুর্থ তথা অন্তিম পর্ব।
ছন্দা চট্টোপাধ্যায়।

এ বড়ো বিপন্ন সময়।প্রায় চল্লিশ বছর হয়ে গেল ইছামতীর কুলে ঘর বেঁধেছে তারা।অনেক অমানবিকতা,নিষ্ঠুরতার সাক্ষী তারা।যারা শোনিতস্রোতে ভেসে যেতে দেখেছে প্রাণপ্রিয় আপনজনদের,সহজে বিচলিত হবার কথা তো তাদের নয়!তবু বর্তমানে যা চলছে তাতে গায়ে কাঁটা দেয়।প্রতিদিনই দেশ জুড়ে কেউ না কেউ ধর্ষিতা হচ্ছে,খুন হচ্ছে।মহানগর থেকে গ্রাম পর্যন্ত সর্বত্র চলছে এই তাণ্ডব।মধুমতী ধর্ষকদের চিহ্নিত করে রাজাকার শব্দটির ব‍্যবহারে। অবশ‍্য এই দুর্বৃত্ত সময়ে একটাই ভরসা,সরকার থেকে নিগৃহীতার পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব‍্যবস্থা।আট থেকে আশী বছর বয়স পর্যন্ত নারী বয়স ও নৃশংসতার বিচারে ক্ষতিপূরণ পেতে পারে পঞ্চাশ হাজার থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত।গৌর মনে মনে আফসায় তার হাতে আর একটাও -“কইন‍্যা”-নেই।মধুমতী বলে-“আহারে,ঐ মাইয়াগুলিও কইন‍্যাছ্রী।মইরাও বাপ মায়ের মুখে অন্ন তুইলা দিতাসে,আমার মাইয়াদের লাহান।কিন্তু ধর্ষক ক‍্যান্ শাস্তি পায়না কও দেহি?কারণ ওরাও রাজাকার।রাজার কামে লাগে। ছিঃ!অমন টাকায় থুঃ!!”–গৌর পাল স্তম্ভিত বিস্ময়ে হতবাক হয়। কত সহজে রাজচরিত্র বিশ্লেষণ করে দিল এক মুক্তিযোদ্ধা সহীদের বিচক্ষণ কন‍্যা!সত‍্যিই তো,অন্নহীন,শিক্ষাহীন নিগৃহীত মানুষের চেতনার দ্বার কেন রুদ্ধ হবেনা কয়েক হাজার বা কয়েক লাখ টাকার বিনিময়ে?প্রতিবাদীর মুখ বন্ধ করার তো দুটি পথ-হয় ঘুষ,নয়তো খুন।

ইলিশ মাছের গন্ধে কলোনির বাতাস ম’ম করছে।শৈলেনের ঘরে আজ -“ইলশা”-রান্না হচ্ছে।তার পাঁচ বছরের মেয়ে পরীরাণীকে কারা যেন ধর্ষণ ও খুন করে পাঁকে পুঁতে রেখেছিল। অন্ধকার গলি দিয়ে মুড়ি কিনতে গিয়ে আর ফেরেনি পরীরানি।নৃশংসতাও বিভৎস রকমের।তাই শৈলেন ক্ষতিপূরণ পেয়েছে দুলাখ টাকা।সেই টাকায় আজ ইলশা মাছের ভোজ।যদিও অপরাধীরা এলাকায় থেকেও ধরা পড়েনি।

রাতে নুন,তেল,কাঁচালংকা আর পেঁয়াজকুচি দিয়ে জুত করে পাখাল (পান্তাভাত) মাখে মধুমতী।বাতাসে ভেসে থাকা ইলিশ মাছের গন্ধ লালাসিক্ত লোভার্ত জিভে মাখিয়ে তারিয়ে তারিয়ে ভাত খায়। গৌর দেখে,খেয়ে উঠে মধুমতী সরষে তেল দিয়ে পরিপাটি করে চুল আঁচড়ে খোঁপা বাঁধে।মুখে তেল মেখে ভিজে গামছা দিয়ে বলিরেখাকীর্ণ শীর্ণ মুখটি মোছে।কপালে বড়ো করে পড়ে সিঁদুরের টিপ,সিঁথিতে লম্বা করে টানে টকটকে সিঁদুর।গৌর অবাক হয়।বুড়ো বয়সে এ আবার কী ঢং!তবে মধুকে দেখাচ্ছে ভালো।কুপির আলোয় মধুমতীর প্রৌঢ় চোখের তারা নিভৃত ইশারায় আহ্বান করে গৌরকে–“মাইয়ারা কেও আর নাই গো।ঘরডা বড়ো ফাঁকা ফাঁকা ঠ‍্যাহে।কাছে আসো,আবার একডারে আনি।”-গৌরের প্রবীণ রক্তে মৃদু কাঁপন লাগে–“বুড়া হইছি,আর কী পারুম!তুই-ও তো বুড়ি হইছো!”–মধুমতী হাসে।মুক্তোদন্তে ঝিলিক খেলে যায়,কটাক্ষে দামিনী।–“পুরাপুরি বুড়ি হই নাই গো।অহনো মইদ‍্যে মইদ‍্যে যৈবন দেহা দেয়।

মধুমতীর শরীর যেন শীতের শান্ত ইছামতী।নৌকা ভাসাতে চায় গৌর পাল।বলে–“এই বয়সে কী বাচ্চা সামাল দিতি পারবা?”–সপাট জবাব দেয় মধুমতী।যে দমকা ঝড় উঠতে চলেছিল গৌরের শরীরে সেটা হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যায়।একি বলছে মধু?–“আমাগো তো হুদা মাইয়াই হয়,কয় বছর আর?বছর পাচেকের হইলেই আন্ধার গলিতে মুড়ি কিনতে পাঠাইয়া দিমু হনে।তুমি তো তাই-ই চাও!”–আগুনে চোখে তাকায় মধুমতী। তারপর গুঙিয়ে গুঙিয়ে কাঁদতে থাকে–“দুই লাখ টাকা,ইলশা মাছ,অনুরে,বনুরে,ক্ষান্ত মারেএএ”—আহত সাপিনীর মতো মুচড়ে মুচড়ে উঠতে থাকে উন্মাদিনী মধুমতীর শরীর।

মহাপাপী,নির্মম-হৃদয় গৌর পাল,যে রূঢ় বাস্তব ছাড়া আর কিছু চেনেনা,তারও চোখ কোনো এক আকুল বন‍্যায় ভেসে যেতে থাকে।এ কোন্ মধুমতী?এই-ই কী মাটিতে মিশে থাকা মহীলতার মতো গুটিয়ে থেকেও গৌর পালের সুপ্ত বিবেককে জাগানোর চেষ্টা করতো?ন‍্যায়-অন‍্যায়ের বিচার করতো দ্বিধাহীন ভাষায়?এই মধুমতীই কী অনেক দেরীতে হলেও গৌর পালের মনুষ‍্যত্বের পুনর্জারণ ঘটাতে আংশিকভাবে হলেও সফল হচ্ছিলো?গৌর পাল উপলব্ধি করে,-যে মধুমতী তার ঘরে এতদিন মঙ্গলদীপের মতো জ্বলছিলো মৃদু স্নিগ্ধ শিখায়,সেই মঙ্গলদীপ আজ যেন কোন পাষণ্ড এক ফুঁয়ে নিবিয়ে দিলো।দুবৃত্তায়ণ সম্পূর্ণ হলো।

মধুমতীর প্রতি এক অদ্ভূত মায়ায় গৌর পালের বুকের মধ‍্যেটা আচ্ছন্ন হয়ে যেতে লাগল।ভালোবাসাকে বড়ো স্পষ্ট করে চিনতে পারা এই ক্ষীণ্ন সমাজের এক শরিক রুদ্ধ বিস্ময়ে এক মুক্তিযোদ্ধার প্রতিবাদিনি ও উন্মাদিনী কন‍্যাকে বুকে আঁকড়ে ধরে বসে রইলো।
স্তব্ধ….নির্বাক……এবং….নিঃস্ব।।
সমাপ্ত।
——————————————————————–

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *