*ধাক্কা* কেয়া রায়

*ধাক্কা*

কেয়া রায়

আটা ডলতে ডলতে নীলিমা আড়চোখে টিভির দিকে চেয়েছিল। ওর বর অনিমেষ টিভি দেখতে দেখতে উঠে গেছিল কোনো কাজে। টিভিতে একটা মেয়ে…একটা প্রতিবাদী মেয়ে দীপ্ত গলায় সোচ্চারে বলছিল, “যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কেন আমি চাকরী পাব না? আমি কোর্টে গেছি সুবিচারের আশায়। আমার থেকে কম নম্বর পেয়ে কি করে কেউ চাকরী পেয়ে যায়! দেশে কি আইন আদালত সংবিধান কিছুই নেই?”

ধন্য রে মেয়ে! ধন্য তোর পরিবার! নীলিমারও তো প্রাইমারী স্কুলের চাকরিটা হওয়ারই ছিল। অনেক আশায় বুক বেঁধে ছিল ও। অনেক পড়াশোনা করেছিল। হল না। পিছিয়ে থাকা বিজন সুজন জলি মলিরা কী জানি কোন মন্ত্রবলে ঢুকে গেল স্কুলে। বাদ পড়ে গেল দিন আনি দিন খাই ঘরের নীলিমা। সেদিন রাগে ক্ষোভে অন্ধ হয়ে গেছিল নীলিমা। বিডিওর টেবিল চাপড়ে চিৎকার করে বলেছিল, “চাকরি পেতে হলে কি চাই, বলুন? টাকা নাকি যোগ্যতা?” ঘাড়ধাক্কা খেয়েছিল সেদিন বিডিওর চেম্বার থেকে। গরীব ঘরের মেয়েদের তো জীবন ভর কেবল ধাক্কা আর ধাক্কা। কিন্ত ধাক্কা তো দেওয়া উচিৎ এই অসাড় অনড় সমাজ ব্যবস্থাকে।

মা বলেছিল, “অনেক হয়েছে ল্যাখাপড়া। চাকরি পাবে না ছাই! ল্যাখাপড়া করা মেয়ে ঘাড়ের ওপর মস্ত বোঝা। পাত্তর দেখে বিয়ে দিয়ে দাও মেয়ের।” মা পাশে দাঁড়ায়নি মেয়ের। লড়াইটা লড়তে পারেনি নীলিমা। অনেক অনুনয় বিনয় বিফলে গেল। টিভির মেয়েটার মা নাকি পাশে দাঁড়িয়েছে। মা টিচার যে। নীলিমার অশিক্ষিত মায়ের প্ররোচনায় এবার বাপের বাড়ি থেকে ঘাড় ধাক্কা। মায়ের ঘাড় থেকে অনিমেষের ঘাড়ে। ঠিক যেন ফুটবল। লাথখোর। অনিমেষ চটকলের লেবার। বছরে ছয়মাসই কারখানা বন্ধ। ওর হতাশার আস্ফালন ফলানোর মাধ্যম হলো নীলিমা।

অথচ মেধা তালিকা অনুযায়ী নিয়োগ হলে আজ নীলিমার জীবনটাই অন্যরকম হতো। স্বপ্নের মতো জীবন। আচ্ছা, এখনও কলকাতায় গিয়ে ধর্নায় বসলে হয় না? অনেকেই তো বসে আছে রোদ ঝড় জল মাথায় করে। এই অপমানের জীবন তো চায়নি সে। ছোট থেকে মেধাবী। ছোট থেকে শিক্ষকতার স্বপ্ন দেখা নীলিমা! কেন ঐ টিভির ববিতার মতো গর্জে উঠতে পারেনি!

হঠাৎ পেছন থেকে রামধাক্কা! অনিমেষ। “হারামজাদী, বসে বসে টিভি দেখছে! সংসারে চারবেলা গিলছে আর আয়েস করছে!”
রান্নাঘর থেকে শাশুড়ি বলল, “দে না কষে দু ঘা। কাজেকম্মে মন নেই। ফেলে দিয়ে আয় বাপের ঘরে।”

আটা নিয়ে রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে সতৃষ্ণ চোখে টিভির দিকে তাকাতে তাকাতে নীলিমা অস্ফুটে বলল, “ঐ মেয়েটা, ঐ মেয়েটা..ও ..ও যেন পারে।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *