🎌 প্রশান্তদুহিতা 🎌 সা য় ন্ত ন ধ র

🎌 প্রশান্তদুহিতা 🎌

সা য় ন্ত ন ধ র

আজ আমি এমন একটি দেশকে পাঠকের সামনে তুলে ধরব আমার লেখনীতে যার অনেকগুলি পরিচয় থাকলেও আমি প্রথম পরিচয়টা জানাই আমার বাবার তরফ থেকে। আমার বাবার সবচেয়ে প্রিয় দেশ জাপান। এর অনেক গল্প শুনেছি ছোট থেকেই। কখন যে ভালোবেসে ফেলি এই প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ দেশটিকে তা নিজেও ঠিক জানি না। পৃথিবীর পূর্ব গোলার্ধে অবস্থিত এই দেশটিতে সূর্য প্রথম উদিত হয় বলে একে “উদীয়মান সূর্যের দেশ” বা জাপানী ভাষায় “নিপ্পন” বলা হয়। উত্তর থেকে দক্ষিণে হোক্কাইডো, হনসু, সিকোকু, কিউসু এই চারটি বড় দ্বীপ এবং ৬৮৪৮ টি ছোট দ্বীপ নিয়ে গঠিত জাপানের মানচিত্রের দিকে তাকালে মনে হয় যেন একটি শঙ্খচিল প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে ডানা মেলে দিয়েছে। চারিদিকে নীল জলরাশির মধ্যে শঙ্খচিল স্থির হয়ে রয়েছে, জলরাশি তার ডানায় হালকা ঢেউ এর দোলা দিচ্ছে। পূর্বাচলের প্রাঙ্গণে এই দেশের মানুষেরা খেলে বেড়ায় সমুদ্রকে আপন করে নিয়ে। উড্ডীয়মান শঙ্খচিলের তীক্ষ্ণশিষ ধ্বনিতে তাদের স্বপ্নের দুয়ার উন্মোচিত হয়। দারুচিনির ঘন অরন্যের মধ্য দিয়ে পাহাড়ি পথে যাবার সময় দেখতে পাই একটি জাপানী তরুণী দারুচিনি সংগ্রহে ব্যাস্ত। মন গেয়ে ওঠে কাজী নজরুল ইসলামের গান –
“দূর দ্বীপ–বাসিনী,
চিনি তোমারে চিনি।
দারুচিনির দেশের
তুমি বিদেশিনীগো, সুমন্দভাষিণী।
প্রশান্ত সাগরে
তুফানে ও ঝড়ে
শুনেছি তোমারি অশান্ত রাগিণী।
বাজাও কি বুনো সুর পাহাড়ি বাঁশিতে?
বনান্ত ছেয়ে যায় বাসন্তী–হাসিতে।
তব কবরী–মূলে
নব এলাচীর ফুল দুলে
কুসুম–বিলাসিনী।”

জাপানের দ্বীপগুলি প্রশান্ত মহাসাগরীয় অগ্নিবলয়ের মধ্যে অবস্থিত তাই এখানে ১০৮ টি ছোটবড় জীবন্ত আগ্নেয়গিরি রয়েছে। দিনে গড়ে ১৪ বার কেঁপে ওঠা তো খুব সাধারণ এখানে। আর কখনও কখনও সুনামি নামক সমুদ্র দানবের আক্রমণও রয়েছে। নয়টি বড় বনাঞ্চল ও সাঁইত্রিশটি রামসর সাইট (সংরক্ষিত জলাভূমি) থাকায় এখানকার জীববৈচিত্র্যও লক্ষ্যণীয়। হঠাৎ দেখা মিলতে পারে জিগোকুডানি উষ্ণ প্রস্রবণে প্রাকৃতিক রূপচর্চা করছে জাপানীজ ম্যাকাকের দল। এই দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অসাধারণ আর তাকে আরও মহিমান্বিত করেছে সেদেশের মানুষের সৃষ্টি। বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল শহর রাজধানী টোকিওর “Sky Tree” টাওয়ার টি বিশ্বের সর্ব্বোচ্চ, যার উপর উঠলে দেখা যায় শুধুই আকাশচুম্বী অট্টালিকার সারি। বিশ্বের ২০ টি হেরিটেজ সাইট ছড়িয়ে রয়েছে গোটা দেশ জুড়ে। হনসু দ্বীপে অবস্থিত জাপানের সর্ব্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট ফুজিয়ামা একটি আগ্নেয়গিরি। ভোরবেলায় সূর্য উঁকি দেয় এর তুষারাবৃত শৃঙ্গে, আর দিনের বেলায় এর কোলে ছড়িয়ে থাকা চা বাগান ও চেরী গাছের ফুলগুলি স্বর্গীয় অনুভূতি এনে দেয় মনে। শরৎ কালে চেরী ফুলের গোলাপী আভায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে এই পর্বতের সানুদেশ। কিন্তু হঠাৎ সেদিন শুভ্র শরৎ সকালে মায়াবী রোদের রূপালী ঝালর ছিন্ন ভিন্ন করে বিষাক্ত বাসুকীর ফণা দিগন্ত কে ঢেকে দিল, তিন দিনের ব্যাবধানে ১৯৪৫ সালের সেই দিন দুটিতে হিরোশিমা ও নাগাসাকি তে আছড়ে পড়ল “লিটল বয়” ও “ফ্যাট ম্যান”, মুহূর্তে ধ্বংসপ্রাপ্ত হল সবকিছু। তারপর … তারপর সেখান থেকেই ফিনিক্স পাখির মত উত্থান তার। প্রবল দেশপ্রেম দেখিয়ে সেখানকার জনগন বর্তমান বিশ্বের শ্রেষ্ঠ, সুন্দর দেশে পরিণত করেছে প্রশান্তদূহিতা কে। সবদিক থেকে বিশ্বের প্রথম সারির দেশগুলির অন্যতম আমাদের এশিয়া মহাদেশের গর্ব জাপান। শিল্প ও প্রযুক্তিতে যেমন এর সমতুল্য দেশ খুবই কম তেমনই পরিবেশ রক্ষাতেও পিছিয়ে নেই সে। Environmental Performance Index –এ ৩৯ তম স্থান দখল করেছে সে, যা তার পরিবেশের প্রতি দায়িত্বশীল হবার প্রতিশ্রুতির প্রমাণ। কিন্তু এতকিছুর পরেও সে অভিশাপ স্বরূপ “হিবাকুশা” দের বহন করে। এখনও কতো মানুষের চোখে জল এনে দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে “হিরোশিমা পিস মেমোরিয়াল”।
প্রিয় পাঠকগণ মন খারাপ হয়ে গেল? এবার তাহলে একটু মন ভালো করে নেওয়া যাক। চলুন মনে মনে ঘুরে আসি এই সুন্দর দেশের সুন্দরতম অংশ হোক্কাইডো দ্বীপ থেকে। শিঙ্কান্সেন নামক ট্রেনে চড়ে, টানেলের ভিতর দিয়ে, সুগারু প্রণালী অতিক্রম করে হনসু থেকে চলে এলাম জাপানের উত্তরতম ভূখণ্ড হোক্কাইডো তে। হোক্কাইডো সবচেয়ে বেশী পরিচিত আগ্নেয় পর্বত, উষ্ণপ্রস্রবণ ও তুষারাবৃত অঞ্চলের জন্য। জাপানের বৃহত্তম বনাঞ্চল “ডাইসেসুজান ন্যাশনাল পার্ক” হল জীবন্ত আগ্নেয়গিরি “আসাহি”র বাড়ি। শিকোট্সু-টোয়া ন্যাশনাল পার্কে রয়েছে সুদৃশ্য ক্যাল্ডেরা হ্রদ এবং মাউন্ট ফুজির Look-alike “মাউন্ট য়োটেই”। অরোকেরিয়া কুকি, ক্রিপ্টোমেরিয়া জাপোনিকা সমৃদ্ধ সরলবর্গীয় ঘন অরণ্যের মধ্য দিয়ে পদব্রজে যাত্রাকালে গা ছম ছম করে। মনে হয় এই বুঝি কোন ব্রাউন বিয়ারের সম্মুখীন হতে হবে। তাই ভয় কাটাতে “গুপী-বাঘা” র শরণাপন্ন হলাম-
“এ যে দৃশ্য – দেখি অন্য,
এ যে বন্য, এ অরণ্য।
হেথা দিনেতে অন্ধকার-
হেথা নিঃঝুম চারিধার।
হেথা ঊর্ধ্বে উঁচায়ে মাথা দিল ঘুম
যত আদিম মহাদ্রুম।”
এভাবে এক সময়ে পেরিয়ে এলাম এই মহারণ্য। সামনে শোনা যাচ্ছে উত্তাল সমুদ্রের ঊর্মিধ্বনি কিন্তু দৃষ্টি ঝাপসা। বিশাল ঊর্মিমালা পাহাড়ি সমুদ্রতটের বড় বড় পাথরে আছড়ে পড়ছে আর জন্ম দিচ্ছে অবিচ্ছিন্ন কুয়াশা। মাথার উপরে ঘন অরণ্য, পায়ের নীচে লবণ জলে সিক্ত ঠাণ্ডা প্রস্তরখণ্ড আর চারধারে কুজ্ঝটিকা, আর তাতে সূর্যালোক পড়ে তা সাতরঙা বর্ণালীতে বিভক্ত। হাতের সামনে রামধনু আর তার সাতরং মেখে ভেজা পাথরের উপর উড়ে বেড়াচ্ছে বেশ কয়েকটি “Alpine Black Swallowtail” প্রজাপতি। তাদের কিছু কিছু মধু খেয়ে বেড়াচ্ছে “অ্যাজেলিয়া” ফুল থেকে।
এবার ফেরার পালা- ফিরছি শিঙ্কান্সেন করে, কিন্তু এখানেই গল্প শেষ নয়- চলছে অজানাকে জানা- অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করলাম বুলেট ট্রেনটি ঘড়ির কাঁটার সময় ধরে উপস্থিত। শুনলাম আজ পর্যন্ত এক মিনিটও দেরী করেনি কোন ট্রেন। এটা জাপানী দের সময়ানুবর্তিতা নির্দেশ করে। আরও বিস্মিত হলাম এক জাপানী ভদ্রলোক হাতে সূঁচসুতো নিয়ে ট্রেনে উঠে একটি ছিঁড়ে যাওয়া সীট কভার সেলাই করছেন দেখে। কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, তিনি একজন নিত্যযাত্রী, আগেরদিন ভ্রমণ করার সময় তিনি লক্ষ করেছিলেন, ঐ সীট কভারটি ছেঁড়া। তাই আজ সূঁচসুতো সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। মুগ্ধ হয়ে গেলাম তাঁর দেশপ্রেম দেখে। পরিচয় পর্বের পর কথায় কথায় জানতে পারলাম জাপানের মেয়েদের জীবনে প্রথম পানীয় চা তৈরী করার যে পারিবারিক অনুষ্ঠান তার নাম “Chanoyu”, একে ‘সাদো’ বা ‘ওচা’ ও বলে। এটা জাপানী “সবুজ চা” প্রস্তুত ও পরিবেশনের একটি নান্দনিক অনুষ্ঠান। জাপানের ঐতিহ্যময় মিষ্টির সাথে তেতো চা সুন্দর ভাবে পরিবেশন করা হয়। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য খাবার খাওয়ার সময় চোপ্ স্টিকের ব্যাবহার আমাকে অবাক করেছিল। অবশেষে “টয়ামা বিমান বন্দর” থেকে বিমানে করে ফেরা- তরুণী বিমান সেবিকা প্রত্যেক যাত্রীকে একগুচ্ছ চন্দ্রমল্লিকা ফুল দিয়ে সহাস্যে বলেছিলো – “আবার দেখা হবে”। মেঘের মধ্য দিয়ে ভেসে যেতে যেতে বিদায় জানালাম সমুদ্রদূহিতাকে।

©সায়ন্তন ধর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *