শ্লীলতার দায়বদ্ধতা **** গৌতমী ভট্টাচার্য ****

শ্লীলতার দায়বদ্ধতা
গৌতমী ভট্টাচার্য
****************
শিল্প ও সাহিত্যে শ্লীলতা এবং অশ্লীলতা ভীষণ বিতর্কিত আলোচনা। সৃষ্টির আদিতে আমরা যে অরণ্যচারী আদিম নগ্ন মানুষদের দেখি সমাজের অগ্রগতির এবং বিবর্তনের সাথে সাথে তাদের আর অশ্লীল বলে মনে হয় না। যুগের পরিবর্তনের ফলে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির ও পরিবর্তন হয়।

শিল্পকলার রীতির দিক থেকে তাকালে দেখতে পাই চিত্রকররা তাদের অনেক চিত্রকর্মে ন্যুড চিত্র অঙ্কন করেন যা আপাতদৃষ্টিতে অশ্লীল বলে মনে হলেও পরবর্তীকালে তা উচ্চস্তরের শিল্পকলার স্তরে উন্নীত হয়েছে। খাজুরাহো বা কোনার্কের ভাস্কর্য আপাত অশ্লীল মনে হলেও তা অত্যন্ত উন্নত মানের শৈল্পিক উৎকর্ষের পরিচয়বাহী। আমি প্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়ামে প্রদর্শিত খ্যাতনামা ভাস্করদের ভাস্কর্য দেখে লজ্জা পেয়েছিলাম — বারবার অবোধ মনে প্রশ্ন জেগেছিল এভাবে ও কেউ শিল্পসৃষ্টি করতে পারে–এত অশ্লীল? পরক্ষণেই মনে হয়েছিল কেন নয়– একজন প্রকৃত শিল্পীর কাছে মানুষের নগ্ন শরীর শুধুমাত্র শরীরই। তার শরীরের প্রত্যেক ভাঁজে অপরূপ শৈল্পিক অনুভূতির ছোঁয়া দেখেছিলাম। যা গভীর অনুভবের বা মননে চর্চিত। ডাক্তারির ছাত্রছাত্রীদের শবব্যবচ্ছেদের সময় লক্ষ্য হয় পাখির চোখ, শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কে প্রত্যক্ষ করে পেশাদার মনোভাব নিয়ে, অশ্লীলতার মাপকাঠিতে নয়।

কলেজে অনার্স ক্লাসে একজন শিক্ষিকার কাছে একটি গল্প শুনেছিলাম –দেবরাজ ইন্দ্রের রাজসভায় উর্বশী নৃত্য করতে করতে তার শরীরের বসন উন্মুক্ত করে চলেছেন, তখন উপস্থিত সকল দেবতা স্বয়ং ব্রহ্মা থেকে নারায়ণ লজ্জায় সবাই চোখ বন্ধ করেছেন, একমাত্র দেবাদিদেব মহাদেব তাঁর অক্ষিদ্বয়কে উন্মুক্ত রেখে উর্বশীর সৌন্দর্য অনুভব করেছিলেন। শিল্পীর সাথে সাথে আমাদের ও অনুভব কে মননশীল হতে এবং দৃষ্টিভঙ্গিকে উন্মুক্ত করতে হবে।

শিল্পের অন্যতম ধারা কাব্য বা সাহিত্য,নাটক। সাহিত্যের শ্লীলতাহানির প্রসঙ্গে ডি. এইচ.লরেন্সের লেডি চ্যাটার্লি’স লাভার এ নরনারীর যৌন সম্পর্কের কথা বলা হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে অশ্লীল বলে মনে হলেও শ্লীলতার মাপকাঠিতে এটি বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।

আমাদের দেশের মহাকাব্য মহাভারতেও নিয়োগ প্রথা এবং এক নারীর পঞ্চপতির কথা বর্ণিত হয়েছে। যুগ যুগ ধরে মহাভারত শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকৃতি পেয়ে এসেছে। তৎকালীন সমসাময়িক সমাজের ইতিহাসের সত্যতা ভবিষ্যত দ্রষ্টা কবির লেখায় স্থান পেয়েছে।

প্রায় দেড় হাজার বছর আগে লেখা শূদ্রকের মৃচ্ছকটিক নাটকে সমসাময়িক সামাজিক সংকট এবং সম্ভ্রান্ত বণিক চারুদত্ত গণিকা বসন্তসেনার কাহিনী পাওয়া যায়। নাটকের ইতিহাসে এর আবেদন আজ ও স্বীকৃত। অশ্লীল হলে কিন্তু এই কালজয়ী নাটকের আবেদন থাকত না। বাৎস্যায়নের কামসূত্র সংস্কৃত সাহিত্যের অমর সৃষ্টি। এই সাহিত্য কিন্তু অশ্লীলতার দায়ে দুষ্ট নয়।

পরবর্তী কালে কালিদাস বা বিদ্যাপতির নায়িকার বর্ণনা আদিরসাত্মক মনে হলেও কাব্যের রস সৃষ্টিতে চরম উৎকর্ষ লাভ করেছে।

সমরেশ বসুর বিবর বা প্রজাপতি অশ্লীলতার দায়ে নিষিদ্ধ হলে ও এই উপন্যাস গুলো কিছু মাত্র অশ্লীল নয়।

বস্তুত শিল্পী তার শিল্পকলার মাধ্যমে সৌন্দর্য সৃষ্টি করেন যাকে আমরা কাব্য সাহিত্যে রস সৃষ্টি বলে থাকি। সাহিত্য সমাজের দর্পণ–সমাজের প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত হয় শিল্প সাহিত্যের মধ্যে। প্রকৃত শিল্পী সমাজের সত্যকেই নৈপুণ্যের সাথে তুলে ধরেন তার সাহিত্যে বা শিল্পকর্মে। একজন শিল্পীর ব্যক্তিসত্তার গভীর অনুভবের মননশীলতা তার সাহিত্য বা শিল্প কর্মে প্রকাশিত হয়। সাহিত্যিক সাহিত্যের প্রয়োজনে ( প্লট এবং চরিত্রের) সমকালীন সমাজে প্রচলিত ভাষার ব্যবহার করে উৎকর্ষের চরমে নিয়ে যেতে পারেন। যেমন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের “সেই সময় “। সেই সময়ের তৎকালীন সমাজের কথ্যভাষার ব্যবহার আপাত অশ্লীল মনে হলেও সেই সময়ের ব্যবহৃত বাবু সমাজের ভাষা ব্যবহার করে সামাজিক সত্যতাকে চিহ্নিত করেছেন। এই উপন্যাসটি কালোত্তীর্ণ।এই উৎকর্ষ সাধনে সাফল্য পেয়েছিলেন বলেই তা কিন্তু শ্লীল সাহিত্যের পর্যায়ে পরিগণিত হয়েছে। যদি তা না হতো তাহলে কিন্তু সেই শিল্প সাহিত্য কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যেত। আমার মতে শ্লীলতা অশ্লীলতার বিচার সংকীর্ণ দৃষ্টি পরিহার করে উন্মুক্ত মানসিকতা নিয়ে বিচার করা উচিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *