¤¤ একটি প্রশস্ত বারান্দার গল্প ¤¤ কলমে : সাহানা

¤¤ একটি প্রশস্ত বারান্দার গল্প ¤¤

কলমে : সাহানা

নিচের তলা থেকে খনখনে গলাটা ভেসে এল।
-ও মা, মা গো!
তাড়াতাড়ি ব্যাগটা দাও না। ভোলা মাছওলা বাজারে ভালো মাছ এনেছে। শিগগিরই যেতে হবে গো। নইলে সব শেষ।
অসীমা রান্নাঘর থেকে আওয়াজ শুনতে পেলো। কিচেনটা এ বাড়ির পেছনের অংশে। দোতলার সিঁড়ি বেয়ে উঠে চওড়া ডাইনিং স্পেসের এক কোণে।
সাধারণত রাস্তার আওয়াজ পৌঁছয় না। তবে এই আওয়াজের তীক্ষ্মতা…..

কিচেন ন্যাপকিনে হাত মুছে চট্ করে বেরিয়ে আসে বারান্দায়। মাঝে বাবলির ঘরের দিকে একবার দেখে নেয়। নাহ্! দরজাটা বন্ধ। মেয়ের কানে যায়নি এই রক্ষা!!
খুব বিরক্ত বোধ করে।

প্রশস্ত বারান্দাটার এক কোণে বাজারের থলিটা বাঁধাই থাকে বারো মাস। বেশিরভাগ সময় বীণার মা নীচের থেকে চেঁচিয়ে ডাকে। সারা পাড়া জাগানো আওয়াজ। তখন ওই ব্যাগটি টুক্ করে ফেলে দেওয়া। তার আগে অবশ্য টাকা পয়সা আর লিস্ট ভরে দিতে হয়। হিসেব বুঝে জিনিস আসবে।

আজও তাই করল।
শুধু উঁকি মেরে হাতের ইশারায় বুঝিয়ে দিল কতটা পরিমাণ চাই।

সরে এসে বারান্দার এক কোণে যেখানে সোনালী রোদ সকাল থেকেই লুটোপুটি করে, সেইখানে দাঁড়ায়। এই কোণটি তার খুব প্রিয়। এখানেই সে রোদে দিয়েছে বালিশ, তোষক ইত্যাদি। একটু নেড়েচেড়ে দেয়। তারপর সামনে তাকায়।
তাকিয়ে থাকে। দৃষ্টি ফেরানো সম্ভব হয় না।
বাড়িটা তৈরি হয়েছিল বছর দশেক আগে। বেশ কিছুটা আগে পিছে জমি ছেড়ে মাঝখানে চৌকো মাপের বাড়ি। কম্পাউন্ড ঘিরে ছোটো বড় নানা গাছ। শখের ঝাউ, দেওদার। আর আছে মরশুমি ফুলের বেড।
বাড়ির সামনে দশফুটের মত পিচঢালা রাস্তা। তারপরেই সবুজ মাঠ। চাষের জমি আর দিগন্ত বিস্তৃত খেত। একবার তাকালে চোখ ফেরানো দায়!
বারান্দার আর এক কোণে কিছু মণিহারী ফুলের টব। বারোমাস পুজোর ফুলের অভাব নেই। বেল, জুঁই, জবা…..

একটানা অনেকক্ষণ নিজের চিন্তায় ডুবে ছিল। হঠাৎ আর একটা আওয়াজে মগ্নতা ভেঙে গেল। একইসঙ্গে দুটো আওয়াজ। একটা ভেতরের দরজায় আর আরেকটি নীচে।
অন্যমনস্ক থাকায় লক্ষ্য করেনি কখন বাবলি এসে দাঁড়িয়েছে! এখন শুনল, মেয়ে বলছে, ওমা, আজ ব্রেকফাস্টে কি বানালে গো? রোজকার ব্রেড ওমলেট ভালো লাগছে না। একটু লুচি করবে? আমি হেল্প করব।

বাবলি আরও কাছে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে!
-তুমি এই বারান্দায় দাঁড়িয়ে যখন সামনে তাকাও, তোমাকে একদম অন্যরকম লাগে। খুব অচেনা। জানো মা, তোমাকে ঠিক বাংলা সিনেমার অভিনেত্রীর মত লাগে। অপর্ণা সেন!!
হেসে ওঠে বাবলি।
ঝরঝরে হাসি।
তার সঙ্গে হেসে ফেলে অসীমাও।
মেয়ের গাল টিপে আদর করে।
-পাগলি একটা!

নিচের থেকে আওয়াজটা আরও জোরালো হয়।

-মা গো! থলেটা নিয়ে নাও।
পাশের বাড়ির কাজকর্ম সেরেই আসছি।

বীণার মা সদাব্যস্ত!!
তাদের জীবনে অহরহ বেঁচে থাকার লড়াই। সৌন্দর্য উপভোগের অবকাশ কম।

বাবলি আর অসীমা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে থলেটা টেনে নেয়।
-বেশ ভারী গো মা! কতটা আনালে?
-দু কিলো বলেছিলাম।
দেখি কি করেছে!

থলে খালি করে চুবিয়ে দেওয়া হয় বারান্দার কোণে রাখা ডেটলের জলের বালতিতে। অতিমারীর প্রকোপ এড়াতে এই ব্যবস্থা।
তারপর দুজনেই ব্যস্ত হয়ে পা বাড়ায় কিচেনের দিকে।
একজন মাছ কাটবে।
একজন লুচি ভাজবে।

বারান্দাটা পড়ে থাকে। বাড়ির বাইরে বাড়ির হৃদয়ের একটা অংশ জুড়ে। রোদ-আলো-বাতাস খেলা করে যে যার খুশিমতো। উন্মুক্ত এক আঁচল পেতে বারান্দাটা সবাইকে গ্রহণ করে। কাউকে ফেরায় না!
টবের গাছ, বাজারের থলে, লুটোপুটি রোদ, চাঁদের আলো, থৈ থৈ জোৎস্না, বালিশ, তোষক, লেপের ওয়ার, গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় চা খাওয়ার আসর, শীতের দুপুরে চা-এর পার্টি…….সব, সবকিছু সে মাথা পেতে নেয়!

উদার হৃদয় এক সত্যিকারের খাঁটি মানুষের মত!!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *