আমি নারী — সোনালী চ্যাটার্জি
আমি নারী
সোনালী চ্যাটার্জি
সর্বাঙ্গে বেল্টের বাড়ির দাগ । জায়গাগুলো লাল হয়ে ফুলে উঠেছে ।যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছিল পুলক । সরমা ছেলেকে জড়িয়ে ধরে মনে মনে গজগজ করছিল জানোয়ার জানোয়ার একটা ছেলেটাকে মেরে ফেলে তবে শান্তি পাবে । পাশের ঘরে তখন প্রবীর রায়ের গর্জন সপ্তমে উঠেছে । ওআমার ছেলে নয় ।আমার ছেলে এরকম হতেই পারেনা । এ অন্য কারো পাপ তুমি আমার ঘাড়ে চাপিয়েছ ।হয় ও ভালোয় ভালোয় এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে তা না হলে আমি মা ওছেলে দুজনকেই ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বার করে দেব ।
স্কুলের খেলার মাঠে চুপচাপ বসেছিল পুলক । কাউকে কিছু না বলে নিঃশব্দে বাড়ি থেকে চলে এসেছে তা না হলে ওর সঙ্গে সঙ্গে মায়ের ওপরেও অকথ্য অত্যাচার শুরু হত । কিন্তু ও কি করবে হাজার চেষ্টা করেও বাবার মনের মত হতে পারে না । পুলকের যে দিদির জামা পরতে চুল বাঁধতে লিপস্টিক কাজল পরতে ভীষণ ভাল লাগে । বাবা বলে ছেলেদের সঙ্গে মিশতে ওদের সঙ্গে খেলতে কিন্তু ছেলেগুলো তো ওকে খেলায় নেয় না। উপরন্তু নানারকম মজা করে ওকে নিয়ে । একবার তো জোর করে ওর প্যানট ও খুলে দিয়েছিল । সেই থেকে ও ছেলেগুলোকে খুব ভয় পায় ।পুলক কি করে ওদের সঙ্গে খেলবে তার চেয়ে একা বসে পুতুলকে সাজাতে ওর খুব ভাল লাগে । একমাত্র মা ই ওকে কিছুটা বোঝে । কিন্তু মা কিই বা করতে পারে মায়ের তো নিজস্ব কোন রোজগার নেই , থাকার জায়গায় ও নেই ।
কি রে সন্ধ্যে হয়ে গেল এখনো একা একা মাঠে বসে কি করছিস ? প্রশ্নটা শুনে পুলক ঘুরে তাকায় সামনে দাঁড়িয়ে সুদীপ স্যার ওদের বাংলার শিক্ষক । পুলকের দিকে ভাল করে তাকিয়ে শিউরে ওঠেন সুদীপ ; কে তোকে এমনভাবে মেরেছে ?
মাথা নীচু করে বসে থাকে পুলক । এই ছেলেটাকে সুদীপ কিছুটা বোঝেন । চেহারায় ছেলে হলেও ভেতরে এক কোমল নারী হৃদয় । বলেন চল তোকে বাড়ি দিয়ে আসি ।
সভয়ে আর্তনাদ করে ওঠে পুলক না না আমি যাব না । বাবা আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে গেলে আবার মারবে।
ঠিক আছে আমি তো নিয়ে যাচ্ছি কেউ মারবে না ।তুই চল । অনিচ্ছুক পুলককে একরকম প্রায় জোর করে টানতে টানতে ই ওদের বাড়ির দরজায় গিয়ে দাঁড়ান সুদীপ
টুং টাং শব্দে পিয়ানো বেলটা বেজে উঠতেই দরজা খোলেন প্রবীর । সুদীপের হাতের মুঠোয় ধরা পুলকের হাত । রাগে ফেটে পড়েন প্রবীর ; আপনি এই জঞ্জাল টাকে আবার এখানে এনেছেন কেন ? দূর করুন এই আপদটাকে আমার চোখের সামনে থেকে ।
আপনি শান্ত হন প্রবীরবাবু ও আপনার ছেলে ।এভাবে ওকে আপনি তাড়িয়ে দিতে পারেন না । ওর কি দোষ বলুন বিধাতা ওকে এভাবেই গড়েছে ।
গর্জে ওঠেন প্রবীর , ও আমার ছেলে নয় । ওকে আমি অস্বীকার করি ও সমাজের কলঙ্ক এ বাড়িতে ওর কোন জায়গা নেই ।
শান্ত কন্ঠে সুদীপ বলেন আপনি যে কথাগুলো বলছেন ভেবে বলছেন তো ? দেখুন ছেলেটার এখন ক্লাস টেন । তাছাড়া ও তো লেখা পড়াতেও বেশভাল ।ওর ভবিষ্যত্ এভাবে নষ্ট করে দেবেন না ।
ব্যঙ্গের হাসি হাসেন প্রবীর বলেন হিজড়ের আবার ভবিষ্যত্ । দুদিনবাদে তালি বাজিয়ে গাইতে নাচতে নামবে । ওদের দলে নাম___
থামুন অনেক বলেছেন বলে গর্জে ওঠেন সুদীপ আর একটাও কথা না।আমি বলছি এরপর থেকে পুলকও আপনার সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ রাখবে না ।আপনি ওকে অস্বীকার করতে চাইছেন তো আজ থেকে ও _ ও আপনাকে অস্বীকার করবে ।
দৃঢ় মুষ্টিতে পুলকের হাত ধরে নিজের বাড়ির দিকে এগোন সুদীপ । নিঃসন্তান এই দম্পত্তি । দীপা দেখ কাকে নিয়ে এসেছি । আজ থেকে ও এখানেই থাকবে আমাদের সন্তানের পরিচয়ে । ওএকটু অন্যরকম তুমি পারবে না দীপা ওকে সন্তান স্নেহে বুকে টেনে নিতে ।
পরম আদরে পুলকের গায়ে হাত বোলায় দীপা । বলে চল ওষুধ লাগাতে হবে ।
দেখতে দেখতে কেটে গেছে আঠারোটি বছর । আজ অডিটোরিয়াম কানায় কানায় ভর্তি । প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও অধ্যাপিকা পৌলমী সেন আজ সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার পাচ্ছেন । তার গুণমুগ্ধ ভক্ত পাঠক তার ছাত্র ছাত্রীরা দর্শকাসন পূর্ণ করে ফেলেছে । প্রবীর রায়ের কাছে ও একটা গেস্ট কার্ড গেছে। উনি ভেবে পাচ্ছেন না এরকম একজন বিখ্যাত সাহিত্যিক তাকে কেন আমন্ত্রণ জানালেন । যাইহোক স্ত্রী সরমার পীড়াপীড়িতে তিনি আজ সস্ত্রীক এখানে এসেছেন ।
সভাপতির ভাষণ শেষ হতেই সবার আমন্ত্রণে ডায়াসে উঠে এসেছেন পৌলমী সেন । হালকা বাসন্তী রঙের তাঁতের শাড়ি এলো খোপা চোখে রিমলেশ চশমা কানে মুক্তোর টপ । এক অপূর্ব আভিজাত্য পূর্ণ চেহারা ।
হাততালিতে ফেটে পড়ছে সভাগৃহ । প্রবীর রায় সরমাকে বলেন দেখেছ কি বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা । এবার সভাপতি পৌলমী সেনকে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করেন ।
সভাপতির হাত থেকে মাইক্রোফোন টা নিজের হাতে নেয় পৌলমী । বলে আমি পৌলমী সেন । আমি নারী হাঁ আমি সর্বতোভাবে এক নারী তবে রূপান্তরকামী । জন্মেছিলাম এক পুরুষ চেহারা নিয়ে কিন্তু প্রকৃতিগতভাবে মানসিক ভাবে ছিলাম এক নারী । এর যে কি যন্ত্রণা তা আমার মত মানুষ ছাড়া কেউই বুঝবে না । প্রতি মুহূর্তে সমাজের কুৎসিত উপহাসে বিদ্রুপে রক্তাক্ত হয়েছি আমি । সেদিন যে আমার সমস্ত ক্ষতে স্নেহের প্রলেপ দিতেন যার হাত ধরে আমি উঠে দাঁড়াতে পেরেছি আমার এই রূপান্তর আমার এই প্রতিষ্ঠা তিনি আর কেউ নন আমার বাবা । পৌলমী আর কি বলছিলেন তার কোনো কিছুই আর প্রবীর রায়ের কানে ঢুকছিল না সন্তান গর্বে তখন তার বুক ফুলে উঠেছে । তার সন্তান যে তাকে একঘর লোকের সামনে এইভাবে গর্বিত করবে এ তিনি ভাবতেও পারেন নি । সরমাকে বলেন দেখেছ সরমা পুলক আজ পৌলমী । সেদিন আমি ওর প্রতি এতোটা নিষ্ঠুর না হলেও পারতাম বল । সরমা বলেন তুমি চুপ কর ও কি বলছে শুনতে দাও ।
ডায়াসে তখন পৌলমী সেন বলছেন আমি আজকের এই সম্মান আমার সেই বাবার হাত থেকেই নিতে চাই যদি সবার সম্মতি থাকে তো। তুমুল হর্ষ ধ্বনির মধ্যে পৌলমী ডাকে বাবা তুমি উঠে এস।
শশব্যস্তে উঠে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করেন প্রবীর রায়
পৌলমীর শান্ত স্বর ভেসে আসে। আমি আপনাকে ডাকি নি মি. প্রবীর রয় । আমি আমার বাবা সুদীপ সেন কে ডেকেছি। বাবা তুমি এস ।
প্রৌঢ় সুদীপ সেন ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরেন দুজনের চোখেই জল । এখন আর কোনো হাততালির শব্দ শোনা যাচ্ছে না । পৌলমী সেনের জীবন কাহিনী শুনে দর্শকদের মন ও তো আজ ভারাক্রান্ত চোখে টলটলে অশ্রুবিন্দু ।