শানবিন — ধ্রুবতারা …

শানবিন
ধ্রুবতারা …
‘শানবিন’ শব্দটা শুনেছেন কখনো ? চীনের বইয়ের সংগ্রহশালাকে বলা হয় ‘শানবিন’ I তা সে আজ থেকে কয়েকশ বছর আগে ওরাই প্রথম বই সংগ্রহ করা শুরু করে I যদিও ইউরোপীয় মহাদেশেও বই সংগ্রহের বিষয়টি বহু কাল আগে থেকেই চলে আসছে তবে প্রথাগতভাবে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় বই সংগ্রহ করে রাখার প্রথা চীন থেকেই শুরু I ওরা এর নাম দিয়েছিল ‘শানবিন’ ইউরোপের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় যে সক্রেটিসের অনুগামীরা (সক্রেটিস কিন্তু নিজে থেকে নিজের দর্শন নিয়ে কোনো বই লিখে যাননি ) তার দর্শন লিখে সেগুলো গ্রন্থের আকারে সংরক্ষিত করেছে I কিন্তু সেগুলি দীর্ঘদিন ধরে ব্যক্তিগতভাবেই সংরক্ষিত ছিল I কোনো গ্রন্থাগার সেসময়ে ছিলনা I এর পর ক্রমাগতঃ গুটেনবার্গের হাত ধরে ছাপাখানা আসার পরে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে আনুষ্ঠানিক ভাবে বইমেলা শুরু হয় পনেরো শতকে I( জার্মানের লিপাজাগ শহরের নাম শুনলেও বিভ্রান্ত হবেন না কারণ লিপাজাগে আড়ম্বর বেশি হওয়ার কারণেই ফ্রাঙ্কফুর্ট এর ইতিহাস ধামাচাপা পড়ে গিয়েছে ! আর ইতিহাস ঘাঁটলে দেখবেন জার্মানির এই বইমেলার হাত ধরেই বিশ্বে বইমেলার আয়োজন শুরু হয় I যদিও বাংলা বইমেলার ইতিহাসে বাংলাদেশের অবদান অনেক বেশি I ১৯৬৫ সালে শিশু গ্রন্থমেলার হাত ধরে বইমেলার সূচনা হয় বাংলাদেশে এবং বলাবাহুল্য বর্তমানে পৃথিবীর সব থেকে দীর্ঘদিন ব্যাপী বইমেলা একমাত্র বাংলাদেশেই হয়ে থাকে I
পশ্চিমবঙ্গও বইমেলার দিক থেকে পিছিয়ে নেই I ১৯৭৬ সালে কোলকাতায় প্রথম বইমেলা অনুষ্ঠিত
হয় I পরবর্তিতে রাজনৈতিক মেরুকরণে বইমেলা ব্যাপক আকার ধারণ করে ১৯৮০ সাল থেকে I কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবেই বাংলাদেশে বইমেলার সূচনা লগ্ন থেকে বইমেলা কোনভাবেই রাজনৈতিক মেরুকরণের দোলাচলে সেভাবে প্রভাবিত হয়নি I প্রমাণ সাপেক্ষে ১৯৯৪ সালে ‘পশ্চিমবঙ্গ গ্রন্থমেলা’ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পশ্চাদের কারণটিও উল্লেখ করে দিলাম I কিন্তু বাংলাদেশে একই ভাবে বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে I বাংলাদেশকে এই ক্ষেত্রে এগিয়ে রাখতেই হয় কারণ যে প্রাসাদের ভীত একটি সৎ এবং নিষ্ঠাবান ব্যক্তির হাত ধরে হয় সেই প্রাসাদ একদিন ইতিহাস লিখে ফেলে I ‘Wonderful World of Books’ এই বইটি পড়তে পড়তেই বাংলাদেশের জাতীয় গ্রন্থাগারের পরিচালক কথাসাহিত্যিক সর্দার জয়েনউদদীনের মাথায় আসে বই মেলার আয়োজনের চিন্তা I ব্যাস তিনি লাইব্রেরিতেই ১৯৬৫ সালে আয়োজন করে ফেললেন ‘শিশু গ্রন্থমেলা’ I ক্রমে সেই ‘শিশু গ্রন্থমেলা’ আজ ‘একুশের বইমেলা’ I কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে বইমেলা ঘিরে অনেক জল গড়িয়েছে I পাওয়ার , নেম এন্ড ফেম এইসব ব্যাপারগুলো কোথাও না কোথাও কাজ করেছে I এসেছে ক্ষমতায় থাকা সরকারের আনুকুল্য লাভের ব্যাপার স্যাপার I গিল্ডের অভ্যুথান এবং রাজনৈতিক নেতা নেত্রীদের বড় বড় হোর্ডিং এর পাশাপাশি বইমেলার আকার বিস্তৃতি লাভ করেছে এবং হারিয়েছে গভীরতা I নইলে কোলকাতা বইমেলার পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গ গ্রন্থমেলা কিন্তু বই প্রকাশক সুনীল বসুর হাত ধরে বেশ সুন্দর চলছিল I কিন্তু সেটি সম্পূর্ণ গ্রন্থাগার কেন্দ্রিক ইত্যাদি ইত্যাদি বলে টলে সেই গ্রন্থমেলা কে মায়ের ভোগে পাঠিয়ে দেওয়া হলো I
কিন্তু বইমেলার ইতিহাস যাই হোক না কেন , এ তো একপ্রকার তীর্থস্থান I এই তীর্থস্থানে যারা যারা নিজেদের কাজ নিয়ে নিজেদের পরিচিতি রেখেছেন তাদের প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা I প্রতি বছরেই বহু নবীন কবি সাহিত্যিকের আবির্ভাব ঘটছে I কিছু প্রশ্নের আবির্ভাবও হচ্ছে I কে কার বই পড়ছে ! নির্মান হচ্ছে একের পর এক সৃষ্টি I তাই যারা যারা নিজেদের লেখাকে হরপের আকারে প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছেন বা সেইসব ভাগ্যবান ভাগ্যবতী লেখক লেখিকা যারা প্রকৃত অর্থে কবি সাহিত্যিকদের ক্লাবে সামিল হবার সুযোগ পেয়েছেন তাঁদের প্রত্যেকের প্রতি আমার শ্রদ্ধা I আপনাদের কাজ পাঠকমহলে সমাদৃত হোক এই শুভেচ্ছা রইলো I একটা বই প্রকাশ হয়ে যাওয়া মানে আপনি কোথাও না কোথাও অমরত্ব পেয়ে গেলেন I বংশ পরম্পরায় আপনি নিজের এক আলাদা পরিচিতি রেখে যেতে সক্ষম হলেন I কিন্তু তার পাশাপাশি আপনাদের প্রত্যেকের একটা নৈতিক কর্তব্য রয়েছে বৈকি ! আপনারা নিজেরাও একদিন যেমন নবীন ছিলেন তেমনই আজ যারা নবীন তাদের বই কিনুন , উত্সাহিত করুন তাদের I রবীন্দ্র , নজরুল , সুনীল , জীবনানন্দ , তসলীমা , শ্রীজাত , আরণ্যক বসুর মত প্রথম সারির লেখকদের তো পড়েছেনই এবার একটু অন্য চিন্তাধারা নিয়ে বইমেলায় ঢুকুন I একেবারে পেছনের সারির প্রকাশকের স্টলে ঘুরে ঘুরে দেখুন , কবির নাম না পড়েই বই হাতে উঠিয়ে নিন I বইমেলায় প্রবেশের আগেই নিজের পছন্দ নির্বাচন করুন ! আপনি কী কী বিষয়ের বই নিতে রাজী সেই সিদ্ধান্ত নিয়েই মেলায় ঢুকুন I আজকাল ফেসবুক বই কেনা বেচার ব্যাপারটাকে কিছুটা হলেও প্রভাবিত করে এটা অনস্বীকার্য কিন্তু তা সত্ত্বেও ঘুরে ফিরে বই উঠিয়ে দেখুন I শুধু কবিতা উপন্যাস গল্পের বইই নয় বিভিন্ন গবেষণামূলক বইও উঠিয়ে দেখুন I এই যেমন আপনি আজ ‘শানবিন’ সম্পর্কে জানলেন তেমনই হয়তো দেখবেন কোনো এক বইয়ে বেনারসের সম্পুর্নানন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার সম্পর্কে কেউ লিখে রেখেছেন I
এবার কথা হচ্ছে আমার মত ভাট মার্কা যেসব লোকজন চারপাতা পড়তে না পড়তেই ঘুমিয়ে যান তারা কী করবেন ? আরে গুরু আপনারাও যান বইমেলা I বই কিনুন , আর গ্যারেন্টি দিয়ে বলতে পারি আপনারাই বেনামী লেখক লেখিকার বই কিনে ঘরে ফেরেন I কারণ আপনার কাছে রবীন্দ্রনাথ যা হাবুল দাসও তাই I যা হোক একটা বই কিনে হাতে ঝুলিয়ে ঘুরে ফিরে ফুচকা খান , সেল্ফি টেল্ফি তুলুন , ফেসবুকে পোস্ট করুন , আমি তো বসেই আছি কমেন্ট দেবার জন্য সেই নিয়ে চিন্তা নেই , কিন্তু বই কিনুন I আপনি না পড়লেও হতে পারে আপনার ঘরের সন্তান পড়ল , মা পড়লেন , বাবা পড়লেন I কারো না কারো কাজে লাগবেই I
ইতিহাস যাই হোক না কেন , আপনারা যারা কবি সাহিত্যিক , যাদের নামের পাশে ISBN নম্বর জুড়ে গেছে , যারা অটোগ্রাফ দেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন , এই জীবনে তারা নিঃসন্দেহে সৃষ্টিশীলতার বিস্তীর্ণ উদ্দ্যানে জয়লাভ করেছেন I আপনার মাথায় যে শিরস্ত্রাণ তার মর্যাদা রক্ষা করতে শুধু কবি সাহিত্যিকের পরিচিতিটুকুই যথেষ্ট নয় I সাজগোজের বাহারের বাইরে হয়ে উঠুন পাঠক পাঠিকা , হয়ে উঠুন বইপ্রেমী I কারণ আমার মত উদাসীন পাঠক পাঠিকার সংখ্যা কিন্তু ক্রমাগতঃ বেড়েই চলেছে , যারা একদিক থেকে ধ্বংসাত্মক রূপরেখার কারিগর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে I আমরা এসব কিছুই করব না , আমরা হলাম ফেসবুক প্রেমী , হেঁ হেঁ হেঁ ! তাই আপনারা যারা লেখক লেখিকা তারা শুধু নিজের বই সম্পর্কেই সচেতন না থেকে অন্যের বই কিনুন এবং পড়ুন I এবার আপনি যদি আমার মত লোকের ক্লাবে নিজের নাম লেখাতেই চান তবে আসুন ঢপের চপ বানিয়ে রাশিয়া আর ইউক্রেন নিয়ে আলোচনা করি , হাতে করে করে বম্ব ফাটাই I কিম্বা আসুন আলোচনা করি শ্যাপলা রান্নায় কী কী লাগে I
লাইফাম সিপহাই …মনিপুর …২৮/০২/২০২১

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *