আমার কিশোরী বেলায় সরস্বতী অর্চনা কলমে — দীপিকা ভট্টাচার্য সান্যাল

আমার কিশোরী বেলায় সরস্বতী অর্চনা

কলমে — দীপিকা ভট্টাচার্য সান্যাল

আগামী কাল সরস্বতী পূজা। খুব মন খারাপ করে এই দিনে। ছোটোবেলায় এই দিন আমাদের বাড়িতে পূজো হতো বই দিয়ে। বইয়ের উপরে মা সরস্বতীর একটা সুন্দর মুখশ্রী সম্পন্ন ছবি রাখা হতো। আগের দিন রাত্রে একটি বড় জলচৌকি ধুয়ে শুকিয়ে তার ওপর অনেক রাত অবধি বসে বসে সুন্দর করে আল্পনা দিতাম। যাতে সকালে শুকিয়ে যায়। তারপর পেস্তা বাদাম আখরোট সব ভিজিয়ে রাখতাম। নইলে সকালে এগুলো ছাড়ানো যেতোনা। বাকি ফল, কিসমিস ভালো করে ধুয়ে রাখতাম। যাতে সকালে গঙ্গায় স্নান করে (গঙ্গা ছিল খুব কাছে) এসে খুব তাড়াতাড়ি জোগাড় সেরে নেওয়া যায়। সে ছিল এক অত্যন্ত আনন্দের উৎসব। তখন তো মোবাইল আবিস্কার হয়নি বা সবার হাতে ও ছিল না। আর ছিল না ফেসবুকে ছবি পোস্টের প্রতিযোগিতা। তাই সে আল্পনা কিছু আত্মীয় এবং মা সরস্বতী ছাড়া কারো দৃষ্টি গোচর হতো না। আল্পনা দেওয়া হতো জলচৌকির উপরে আর নাট মন্দির অনেকটা জুড়ে। সেই আল্পনা দেওয়া জলচৌকির ওপরে আমাদের সব ভাই বোনের বই খাতা রাখা হতো পর পর সাজিয়ে। বেশ উঁচু করে সেই বই সাজিয়ে রাখা হতো মা সরস্বতীর উচ্চতায়। আর তার ওপর একটি বড় গাঁদা ফুলের মালা দেওয়া হতো পুরো বই সরস্বতী ঘিরে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত। বাজার করা ফুল আনা আমার দাদাদের দায়িত্ব ছিল। মালা গাঁথতাম, ঠাকুর সাজাতাম আমরা বোনেরা মিলে। মায়ের কাছে শুনেছি আমাদের বাড়িতে মূর্তি পূজা বারণ। আমার এক কাকা বারণ না মেনেই ছোটো বেলা সরস্বতী মূর্তি এনে পূজা করেন। দুর্ভাগ্য তার পরেই তাঁর অকাল মৃত্যু হয়। তাই এই ব্যবস্থা।
যিনি পূজো করতেন তিনি ছিলেন সংস্কৃত কলেজের প্রফেসর ৺রামপদ ভট্টাচার্য মহাশই। আমরা রামপদ কাকা বলতাম। তিনি ছিলেন আমাদের কূল পুরোহিত। আমাদের বিয়ে, পৈতে সব তাঁর হাত দিয়েই হয়েছে। নিখুঁত উচ্চারণে এবং সমস্ত নিয়ম মেনে খুব নিষ্ঠা ভরে পূজো করতেন নানান উপাচার সাজিয়ে। তাঁর সেই পূজো করা দেখার পর আর কারো পূজো যেনো মনে ধরে না। পলাশ ফুল, বাকশ ফুল, আকন্দ ফুল, গাঁদা ফুল বেলপাতা, তুলসী, দূর্বা , আমের মুকুল বেছে চন্দন বেটে আমরা মায়ের সঙ্গে হাত লাগিয়ে জোগাড় দিতাম। নৈবেদ্য গুলো মা সাজাতেন। কারণ সেখানেও একটা নিখুঁত নৈপুণ্যের ছোঁয়া থাকত মায়ের হাতের। আর বাড়িতে নারায়ণ এবং অন্য অনেক দেব দেবী মুর্তি আছেন বলে মা নিজে হাতে সব করতেন। তাছাড়া আমার ঠাকুমার বাপের বাড়ির নারায়ণ আনতেন রামপদ কাকা। ঐ নারায়ণ ও বাড়িতে পূজো নিয়ে আমাদের বাড়ি আসতেন। রূপোর সিংহাসনে রূপোর ছাতা মাথায় সে মুর্তি দেখে আপনি মাথা নত হয়। একটা রোমাঞ্চ অনুভব হয়। এই নিয়ম ঠাকুমার আমল থেকে হয়ে আসছে বলে মা সেটাই মেনে চলতেন। অনেক রকম ভোগ মা একাই রান্না করতেন। কারণ আমাদের দীক্ষা হয়নি তাই ভোগ রান্না করতে পারতাম না। আমাদের বাড়িতে সেদিন পূজোর পর জোড়া ইলিশ বরণ করা হতো।
পূজোর অঞ্জলি দেওয়ার পর প্রসাদ বিলি করে তারপর আমরা সেই প্রসাদ ফল মূল মিষ্টি লুচি পায়েস, নৈবেদ্য খেয়েই পেট ভরাতাম। দাদারা ভাইয়েরা জ্যাঠা কাকাদের বাড়িতে যেতো প্রসাদ খেতে। জ্যাঠতুতো দাদারা ভাইয়েরাও আমাদের বাড়িতে আসত প্রসাদ খেতে। তাই কারো আর সেদিন ভাতে রুচি থাকত না । সন্ধ্যাবেলা আবার কাকা এসে পূজো করে আরতি করতেন । সেদিন আমাদের ছুটি। কারণ বই খাতা তো তখন মা সরস্বতী। তাই তাকে সরানো যাবেনা। পরদিন রামপদ কাকা সকালে এসে আবার একবার পূজো করে দেবেন। আমরা মা সরস্বতীর পায়ে এবং ওনার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে আশীর্বাদ নিতাম মা এবং সব ভাই বোনেরা মিলে। তারপর তিনটে বেলপাতায় শ্রী শ্রী সরস্বত্বৈ নমঃ তিনবার করে লিখে সেই বেল পাতার ওপর খাগের কলম একবার এবং যবের শিশ্ একবার রেখে কাকার নির্দেশ অনুযায়ী রেখে কলমে মাথা ঠেকিয়ে মায়ের কাছে প্রার্থনা করতাম। এরপর মাথা তুলে দেখতাম কার কলম কতক্ষণ কপালে আটকে থাকে। যার যত বেশি থাকত তার তত ভালো পরাশুনা হবে বলে কাকা বলতেন। আমরা তাই কপালে জোড় খাটিয়ে কলমে মাথা চেপে রেখে প্রণাম জানিয়ে প্রার্থনা করতাম সেই বিশ্বাসে। যাতে মাথা সোজা করে রেখে উঠে বসে থাকলেও কলম তাড়াতাড়ি খসে না পড়ে। এরপর যে যার বই নিয়ে তার ফাঁকে ফাঁকে প্রসাদী ফুল রাখতাম।
পরদিন ছিল শীতল ষষ্ঠী। ঐদিন আমাদের বাড়িতে অরন্ধন। মানে উনুন জ্বলবে না। তাই আগের দিনের অনেক রকম রান্না করে মা সরস্বতীর ভোগ দেওয়া হতো এবং কিছু ভোগ পরের দিনের মা ষষ্ঠী র ভোগের জন্য রাখা হতো। ঐ ভাতে জল দিয়ে রাখা হতো। পরদিন ষষ্ঠী পূজো করতেন রামপদ কাকা এসে। তারপর সেই প্রসাদ মানে পান্তাভাত, গোটা সেদ্ধ, সজনে ফুল- পালঙশাকের শিষ্ আলু,বেগুন দিয়ে একটা চচ্চড়ি মতো হতো। আর কুলের অম্বল সব আমরা ঠান্ডা খেতাম। ফ্রীজে না রেখেও কিন্তু সে খাবার নষ্ট হতোনা।
গোটা সেদ্ধ হতো কালো কলাই , ছটা ছোটো অক্ষত বেগুন, ছটা ছোটো অক্ষত রাঙা আলু, ছটা জোড়া অক্ষত কড়াইশুঁটি, ছটা জোড়া অক্ষত সিম , ছটা ছোটো আলু, ছটা বোঁটা শুদ্ধু টোপা কুল আর কাঁচা লঙ্কা দিয়ে সিদ্ধ হতো। এতে একটু কাঁচা সর্সের তেল আর সন্ধব লবণ দিয়ে রাখা হতো। এই গোটা সিদ্ধ অত্যন্ত উপাদেয় হতো খেতে। এর সঙ্গে পালং শাকের শিশ্ আর অল্প সজনেফুল আলু বেগুন ইত্যাদি সবজি দিয়েএকটা সব্জি বানানো হতো আর কচুর শাক, কুলের অম্বল হতো। ভীষণ উপাদেয় এই রান্নাটা। এই গোটা সেদ্ধ খাওয়ার একটা কারণ আছে। সেটা হল এই রান্নাটা আসলে পক্স বা হামের প্রতিষেধক। আজ এ সব নিয়ম আমিও মানি তবে আর মাকে বাবাকে ভাই বোনেদের পাইনা, তাদের সঙ্গে বসে খাওয়াও হয়না। বড় মেয়ে জামাই, নাতনী ও দূরে থাকে। তাদের ও পাইনা । তাই মন খুব খারাপ লাগে। না ঐদিন স্কুলে যাওয়া হতোনা। বাড়িতেই সবাই মিলে সারাদিন উৎসবের আনন্দ। একবার তো আমার নদা মানে জ্যাঠতুতো দাদা এসেছেন দুর্গাপুর থেকে অফিস ছুটি নিয়ে কয়েকদিনের জন্য। সরস্বতী পূজোর দিন, ভোর বেলা হয়ে গেছে ওঠ বলে আমাদের ঘুম ভাঙিয়ে দিয়ে গঙ্গায় স্নান করতে নিয়ে গেলেন । গঙ্গার ধারে বড় জ্যাঠার বাড়ি দরজায় কড়া নেরে বড় বৌদিকে ডাকা হচ্ছে স্নান করতে যাবার জন্য। বড় জ্যাঠা দরজা খুলেই প্রচণ্ড রেগে গিয়ে নদাকে খুব বকলেন। ইয়ার্কি মারছিস ? রাত দুটোয় গঙ্গায় চান করতে বেরিয়েছিস । তোর আক্কেল নেই? সবাই ভয়ে মুখ চাওয়া চাওয়ি করছি। বোঝা গেল ঘড়ির দিকে না তাকিয়েই নদা আমাদের তুলে দিয়েছেন আমরাও হুজুগে তাঁকে বাধ্য ভাই বোনেরা অনুসরণ করেছি। কী আর করা যাবে বড় বৌদিকে ছাড়ায় আমরা মাঘ মাসের শীতে রাত দুটোয় স্নান করে ঘরে ফিরে এলাম। ভাবলাম ভাগ্যিস নিস্তবধতাকে সঙ্গী করতে পেরেছিলাম সবাই। তাই বাবার ঘুম ভাঙেনি। মায়ের বারণ নদা অতটা গুরত্ব দেন নি মা খুব ভালোবাসত বলে ভয় পেতনা। এখন ভাবলে খুব কষ্ট হয় এই আনন্দ আজকের ছেলে মেয়েরা খুঁজে পায়না যৌথ পরিবার নেই বলে। আর আমার বিয়াল্লিশটি ভাই বোনের আজ অনেকেই আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেছেন না ফেরার দেশে। না সরস্বতী পূজোর দিন ভ্যালেনটাইন্স ডে আমাদের জীবনে অনুপস্থিত ছিল। তবু ছিল যৌথ জীবনের অনেক আনন্দ। সবাই খুব ভালো থাকুন আনন্দে থাকুন এই কামনা করি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *