রবীন্দ্র আলোকে সভ্যতার সংকটকাল —- গৌতমী ভট্টাচার্য

রবীন্দ্র আলোকে সভ্যতার সংকটকাল
প্রবন্ধ
গৌতমী ভট্টাচার্য
********************************

“জয় জয় জয় হে মানব-অভ্যুদয়
মন্দ্রি উঠিল মহাকাশে”
জলজ উদ্ভিদ থেকে যে প্রাণের উদ্ভব, সেই প্রাণের
নানা শাখাপ্রশাখার ধারাবাহিক বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে মানবজীবনের অভ্যুদয় ঘটেছে।আদিম প্রস্তরযুগের অরণ্যচারী মানুষ যেদিন আগুনের আবিস্কার করেছিল সেদিন থেকেই শুরু হয়ে গেছিল সভ্যতার নববিপ্লব।

রবীন্দ্রনাথ তপোবন প্রবন্ধে বলেছেন,–“সভ্যতার মূল প্রসবণ শহরে নয় গ্রামে—–অরণ্যের নির্জনতা
মানুষের বুদ্ধিকে অভিভূত করেনি,বরঞ্চ তাকে একটা শক্তি দান করেছিল,সেই অরণ্য বাস নিঃসৃত সভ্যতার ধারা সমস্ত ভারতবর্ষকে অভিষিক্ত করে দিয়েছে এবং আজ পর্যন্ত তার প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায় নি।”
অরণ্যসাধনা থেকেই ভারতীয় সভ্যতার শক্তি গড়ে উঠেছিল।ওনার মতে এই শক্তির ধ্যানের মাধ্যমে
নিখিল বিশ্বের আত্মার সঙ্গে যোগ স্থাপন হয়েছিল।

রবীন্দ্রনাথ অরণ্য বা পল্লীজীবনের মধ্যে অন্তরাত্মার মুক্তির বানী শুনতে পেয়েছিলেন।তাই তিনি প্রকৃতির পরিবেশে বিশ্বভারতী স্হাপন করে সমগ্র বিশ্বকে মহান মানব বন্ধনের ঐক্যর মধ্যে যুক্ত করতে চেয়েছিলেন।তার সমগ্র জীবনচর্যায় বারবার প্রকৃতি অরণ্য পল্লীসমাজ ফিরে এসেছে।
শিলাইদহে পদ্মাবক্ষে সাহিত্যসাধনা কিংবা চৈতালী কাব্যর “সভ্যতার প্রতি” কবিতায় “দাও ফিরে এ অরণ্য,লও হে নগর,/———–চাই শক্তি আপনার,/পরাণে স্পর্শিতে চাই ছিঁড়িয়া বন্ধন/অনন্ত এ জগতের হৃদয় স্পন্দন।”

জীবনের প্রবাহ থেমে থাকে না,আর্থ সামাজিক প্রয়োজনে নগরমুখী হয়েছে।”ভারততীর্থ”কবিতায়
আর্য অনার্য,দ্রাবিড়,চীন,শক,হুন,পাঠান,মোগল,হিন্দু মুসলমান,খৃষ্টান এমনকি শুচিবায়ুগ্রস্ত ব্রাক্ষ্মণের সহবস্থানের কথা বলেছেন। ভারতীয় সভ্যতার এই মর্মবানীর প্রতিফলন দেখি “গোরা”
উপন্যাসে। উগ্র হিন্দুধর্মের প্রবক্তা পরিশেষে গোরা নিজেকে ইংরেজ সন্তান জেনে আনন্দময়ীর ভিতর ভারতবর্ষের অন্তরাত্মাকে খুঁজে পেয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ কালান্তরের হিন্দু মুসলমান প্রবন্ধে বলেছেন,”যে দেশে প্রধানত ধর্মের মিলেই মানুষকে মেলায় অন্য কোনো বাঁধনে বাঁধতে পারে না, সে দেশ হতভাগ্য”। মানুষ বলেই মানুষের যে মূল্য সহজ প্রীতির সঙ্গে স্বীকার করাই প্রকৃত ধর্মবুদ্ধি।যে দেশে ধর্মই সেই বুদ্ধিকে পীড়িত করে রাষ্ট্রীক স্বার্থবুদ্ধি কি সেই দেশকে বাঁচাতে পারে।”
“তিনি রাশিয়ার চিঠিতে লিখেছেন, “ভারতবর্ষের বুকের উপর যত কিছু দুঃখ আজ অভ্রভেদী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার মূল হচ্ছে অশিক্ষা। জাতিভেদ,ধর্মবিরোধ,কর্মজড়তা,আর্থিকদৌর্বল্য—-সমস্তই আঁকড়ে আছে শিক্ষার অভাবকে।” আমরা ভারতীয়সভ্যতার এই মূল ঐক্যকে আত্মস্থ করতে পারিনি বলেই রাষ্ট্রকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

রবীন্দ্রনাথ প্রাচীনসাহিত্যের মেঘদূত প্রবন্ধে ইঙ্গিত দিয়েছেন মানুষেরা এক একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো,মনুষ্যত্বের নিবিড় ঐক্য ছিল কিন্তু কালের নিষ্ঠুর ব্যবধানে সে বিচ্ছিন্ন হয়েছে।সভ্যতা যতই নগরমুখী হয়েছে মানুষ ততই স্বার্থপর হয়েছে,মনুষ্যত্বের অবমাননা করেছে।এই বৈশিষ্ঠ্য কিন্তু সভ্যতার সংকটের এক চূড়ান্ত দিক নির্দেশ করছে।

আজ বিশ্বজনজীবন বিপর্য্যস্ত—-সভ্যতার সংকটে ভারাক্রান্ত।সত্যদ্রষ্টা কবি শান্তিনিকেতনের “বিশ্বব্যাপী” প্রবন্ধে ইঙ্গিত দিয়েছেন আমরা প্রকৃতিকে অবজ্ঞা করে জগতকে ব্যবহারের সামগ্রীর যন্ত্র করে ফেলেছি। ফলে আমরা নিজেদের বঞ্চনা করেছি। শুধুমাত্র পেট ভরে, চিত্ত পরিতৃপ্ত হয় না।

কালান্তরে বিবেচনা ও অবিবেচনা প্রবন্ধে ক্রান্তদর্শী কবি লিখেছেন,” পৃথিবীর সমস্ত বড় বড় সভ্যতাই দুঃসাহসের সৃষ্টি। শক্তির দুঃসাহস,বুদ্ধির দুঃসাহস,আকাঙ্খার দুঃসাহস।” অন্ধকুসংস্কার,রোগব্যাধিকে অগ্রাহ্য করে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেই চলেছে অজানাকে পাবার জন্য।

আজকের অপরিকল্পিত আগ্রাসী যন্ত্রসভ্যতায় অভ্যস্ত জীবন সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।”মুক্তধারা”নাটকে দেখেছি চাষীর চাষকে অগ্রায্য করে ঝরনাকে লৌহযন্ত্রে বাঁধার অহঙ্কার। প্রকৃতি এই ঔদ্ধত্য কিন্তু সহ্য করে না। পৃথিবী ব্যাপী এই অশনি সংকেতের ইঙ্গিত পাই “কালের যাত্রা” নাটকে,”প্রলয়দদীপ্তির আংটি পড়েছে দিকচক্রবাল।”

তবুও মানুষ স্বপ্ন দেখে,অমানিশার পর নতুন সূর্যের। অরণ্যচারী মানুষ বিজ্ঞানের এষণায় আজ মহাকাশচারী। হয়তো আজকের মানবসভ্যতা বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে ইতিহাস হয়ে যাবে।হয়ত মহাকাশেই অভ্যুদয় হবে নতুন কোন সভ্যতার।তারই পূর্বাভাস দিচ্ছেন আজকের বিজ্ঞানীরা।।

********************************************

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *