স্মৃতির সরনী বেয়ে,,,,, কলমে-নিতু চৌধুরী

স্মৃতির সরনী বেয়ে,,,,,
কলমে-নিতু চৌধুরী

পৌষের এই দুপুর গুলো কেমন যেন মিঠে আলসেমি মাখানো রোদ্দুর জড়িয়ে থাকতে ভালো লাগে আজকাল। কম্বলে পা ঢেকে বালিশে আধশোয়া হয়ে সবেমাত্র তসলিমা নাসরিনের কবিতার বইয়ে চোখ রেখেছি ওমা, হঠাৎই দেখি কম্বল সরিয়ে উঁকি মারছে ঠাম্মার নকশাপাড় সাদা খোলের তাঁতের শাড়ির ওয়ার পরানো সেই লেপটা না!যেটাতে আমি আর ভাই জড়াজড়ি করে শুয়ে থাকতাম আর আমি মাঝে মাঝেই স্বভাব সিদ্ধ দুষ্টুমির বশে পা তুলে দিয়ে সেই লেপের ওপর ভাইকে বিরক্ত করতাম।আহাঃ কতোদিন পরে লেপটাকে ধরে ঠাম্মার গায়ের গন্ধ পেলাম। রোদ্দুরে ছাদে বসে কমলালেবু খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কানে আসছে মার কন্ঠস্বর, খোসাগুলো ফেলবি না কিন্ত, এক জায়গাতে জড়ো করে রাখ,পিশির মুখে মাখাবো।একটু দুরেই আদু ঠাম্মা বড়ির খাটে বড়ি বসাতে ব্যস্ত। আদু ঠাম্মা ফি বছর শীতে আমাদের বাড়ি আসে বড়ি বসাতে ,তাছাড়া সারাবছর আসে মুড়ি, চালভাজা এসব করতে।ঠাম্মাকে দেখলাম বড়ো বড়ো বয়ামে পাথরের থালাতে কুলের আচার, তেঁতুলের আচার রোদে দিচ্ছে, ব্যস স্বভাব সিদ্ধ দুষ্টুমিতে গিয়ে বসলাম বড়ির ওপর যাতে ফ্রকের পিছনে কাঁচা বড়ির ছাপের ডিজাইন সবাই কে দেখানো যায় ।আদু ঠাম্মার চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গেই আমার ম্যারাথন রেস শুরু হলো ঠাম্মার আচারের বয়াম উল্টে, পাথরের থালায় পা দিয়ে আচার চটকে কাকু পিশিদের উদ্দেশ্যে। ছাদ থেকে নামতে গিয়ে ছড়ে যাওয়া হাত পা দেখে মার শুরু “একটু বোরোলিন লাগাবো, সে উপায় আছে”,কানে এলো রেডিওতে গান হচ্ছে, কাটা ছেঁড়া শুষ্ক ত্বকে লাগিয়ে নিন বোরোলিন, শিল্পী শ্রাবন্তী মজুমদারের কন্ঠে।
এক বোরোলিন কাজ করে আমাদের একান্নবর্তী পরিবারের ময়েশচারাইজার,এন্টিসেপটিক ক্রীম শীতের ক্রিম সব রূপেই। পিশি তুহিনা না বসন্ত মালতী কি একটা যেন মাখছিলো তাই খানিকটা গালে লাগিয়ে দিলো , কি সুন্দর তার মিষ্টি গন্ধ। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে মাকে দেখলাম তুলসী তলাতে প্রদীপ জ্বালিয়ে রাতের রান্না সারতে রান্না ঘরে যেতে।রাতে সব ভাই বোনেরা( মানে তখন আমরা খুড়তুতো, জেঠতুতো এসব ডাক বুঝতাম না তাই) সব ভাইবোনেরা খেজুর গুড় দুধ দিয়ে চালের রুটি খেয়ে হাত পা ধুয়ে সোজা দাদুর কাছে, দাদু হাত পায়ে সরষের তেল মালিশ করে দিলেই লেপের মধ্যে গুটিসুটি হলাম সবাই।ঘুমানোর আগে এককাপ গরম দুধে হলুদ গুলে বাবার মহৌষধ গলাধঃকরণ করার থেকে কোন ছাড় নেই কেননা সারাদিন যতো দুষ্টুমির কাটা ছেড়ার ব্যথা না হলে কমবে কেমন করে।মা এসে একটু করে বোরোলিন লাগিয়ে দিয়ে গেলো সবার ঠোঁটে।
সকালে ঘুম ভাঙলো রহমত চাচার চিৎকারে,”এখনো সবাই ঘুম দিচ্ছো বাপ ধনেরা।খেজুরের রস এর পর নেশা ধরাবে যে গো”,ব্যস ওমনি খেজুরের রস হয়ে গেলো বেড টি।দাঁতে ক্যাভিটি?উহু ওসব তখন ছুঃ মন্তর। এবার ব্রেক ফাস্টের পালা।দাদুর বানানো পেয়ারা আর নিমের ডালের দাঁতন দিয়ে দাঁত মেজে সব ভাই বোন সার দিয়ে আসনে বসে গেলাম। মা সবার সামনে এনে রাখলেন বড়ো বড়ো চালের বাসি রুটি আর আখের গুড়ের চা।আহা,যেন অমৃত!অম্বল, গ্যাস সব শুদ্ধ একেবারেই হজম করতে না করতেই দেখি ঠাম্মা সরষের তেলের বাটি নিয়ে উঠোনে রেডি।সব গুলোকে সরষের তেলে দলাই মলাই করে অবশেষে ঠান্ডা জলে কাঁপতে কাঁপতে ঝপাঝপ স্নান। (গরম জল নৈব নৈব চ)।হঠাৎই কাজের মাসির গলা,”বৌদিরা পরশু কিন্ত আসবনি “।মার কেন প্রশ্নের উত্তরে বেশ রাগত স্বরে তার জবাব”তোমাদের সংক্রান্তি আছে আর আমাদের নেই নাকি গো?”।মার উত্তর “ওমা তাই তো, ভুলেই গেছি তো,ওইদিন তো সত্যিই কতো কাজ,সারাদিন তো পিঠে পুলি করতেই যাবে।ঠিক আছে পরের দিন একটু সকাল সকাল এসো বাপু,তোমার ভাগের টা এই ছেলে পুলেদের থেকে বেশি ক্ষণ বাঁচানো যাবে নাগো।আর হ্যা শোনো এবারে নবান্নতে কিন্ত ছুটি নিওনা।”হঠাৎই কার ঝাঁকুনিতে নড়ে চড়ে বসলাম “ঘুমোচছো নাকি””?
ছেলের ডাকে সম্বিৎ ফিরে এলো।বাস্তবের মাটিতে আছাড় খেলাম।
, যাই গিজার অন করে ছেলের হাত পা ধোঁয়ার গরম জল করতে হবে। ঠাম্মার কাপড় জড়ানো লেপ না ফ্যাশনেবল কম্বল থেকে বেরিয়ে অনুভব করলাম ঠোঁট টা শুকনো। বোরোলিন টিউব না পেয়ে অগত্যা লিপবাম লাগালাম যদিও বোরোলিনের একটা কৌটা ছিলো, খুঁজে পেলাম না।ঠোঁটে কি এখনও সেই খেজুরের রস বা গুড়ের চায়ের স্বাদ লেগে আছে,চেটে বোঝার চেষ্টা করলাম। ছেলের পিঠেপুলি পছন্দ নয় ,অগত্যা প্যানকেক বানাতে বসলাম। মনে মনে ভাবলাম ভাগ্যিস একটু দিবানিদ্রায় বিভোর হয়ে দিবাস্বপ্নে সেই ছোট্ট নিতু হয়ে আজ দেশের বাড়ি গেলাম, কতো আপন জন, কতো প্রিয় স্মৃতি ফেরৎ পেলাম। সেই শীতের টুকরো টুকরো সমৃতিই হয়ে থাক না সেই ছোট্ট নিতুর সঙ্গে আজকের এই চল্লিশোর্ধ নিতুর একান্তই আপন হয়ে কিছু মধুর ক্ষণ, কিছু আপন জন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *