বিষবৃক্ষের বীজ — সোনালী চ্যাটার্জি

বিষবৃক্ষের বীজ
সোনালী চ্যাটার্জি
বৃদ্ধাবাসের জানালার গরাদ ধরে নীল আকাশের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন চন্দ্রিমা দেবী ।শরতের নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ।সামনের বাগানের স্থল পদ্মের গাছটা থোকা থোকা ফুলের ভারে নুয়ে পড়েছে ।এবার অনেক ফুল ফুটেছে গাছটায় । রাস্তার ওপারে প্যান্ডেলে ঢাকের আওয়াজ মায়ের আগমন বার্তা ঘোষণা করছে ।চারিদিকের পরিবেশের মধ্যে একটা শুচিশুভ্র ভাব । কি যেন এক প্রশান্তি বিরাজ করছে ।
কীরে এখনো জানালায় দাঁড়িয়ে আছিস যে ? রমলাদির ডাকে ঘুরে দাঁড়ান চন্দ্রিমা । সত্তর বছরের এই বৃদ্ধা হাসি গান গল্পে এই বৃদ্ধাবাসের শূন্যতাকে অনেকটাই ভরাট করে রাখেন ।তাকে বাদ দিয়ে এই বৃদ্ধা বাস কল্পনাই করা যায় না ।সারাজীবন বিয়ে করেন নি ।একটি মেয়ে দের কলেজের অধ্যাপিকা ছিলেন অবসর নেবার পর এই বৃদ্ধাবাসে চলে আসেন ।এই আবাসের প্রতি টি মেম্বারের প্রতি তার সজাগ দৃষ্টি অকৃপণ ভালোবাসা ।
রমলাদি আবার বলেন অতো কি ভাবছিস রে ?কাল ফোনটা আসার পর থেকেই তোকে কেমন যেন লাগছে । কার ফোন ছিল ছেলেদের ?ম্লান হাসেন চন্দ্রিমা দেবী
হ্যাঁ ছোটো ছেলের ফোন জার্মানি থেকে ফোন করেছে ,আমায় নিতে আসছে
তোকে নিতে? এই পাঁচ ছয় বছরের মধ্যে দু একটা ফোন ছাড়া তো ছেলেদের সঙ্গে তোর কোনো যোগাযোগই নেই হঠাৎ একেবারে নিয়ে যেতে আসছে যে ?
ছোট বৌমার বাচ্চা হবে ।বড়ো বৌমার সময় বড়ো ছেলে এসে আমেরিকা নিয়ে গেছিল একবছর আয়াগিরি করে তবে ছুটি পেয়েছি লাম এবার ছোটোর পালা ।
দপ্ করে নিমেষে জ্বলে ওঠেন রমলাদি ।তুই যাবি না ছিঃছিঃ মায়ের যখন অতোবড়ো অসুখ করল তখন তাকে সেবা করা তো দূরে থাক কেউ ঠিকমতো ফোন করে ও খোঁজখবর নেয় নি ।এখন নিজেদের প্রয়োজনে দাঁত বার করে নিতে আসছে যে । তুই শক্ত হ চন্দ্রিমা একদম যাবি না । এরাসব একটা বিষবৃক্ষ দুধকলা দিয়ে পোষা কালসাপ ।
রমলাদি চলে যাবার পরও নিশ্চুপ হয়ে জানালায় দাঁড়িয়ে ই থাকেন চন্দ্রিমা । বিষবৃক্ষ কালসাপ কথাদুটো যেন মনের মধ্যে তোলপাড় করতে থাকে । বড়ো আদরে বড়ো যত্ন করে ই তো মানুষ করেছিলেন ওদের ।সবসময় নজর রেখেছিলেন ওদের যেন কোনো অসুবিধায় পড়তে নাহয় ।ওদের মানুষ করতে গিয়ে কারো সঙ্গে কোনো ব্যাপারে আপোস করেন নি । কিন্তু সত্যি ই কি মানুষ হয়েছে তার ছেলে দুটো? নিজের কাছেই উত্তর খোঁজেন চন্দ্রিমা । আপোস কথাটা আবার যেন ছোবল মারে মনেরভেতর ।কালো মেঘের মতো সেই স্মৃতি গুলো মনের মধ্যে আবার ঘন হয়ে আসছে ।তবে….তবে কি ?নিজের প্রশ্নে নিজেই ক্ষতবিক্ষত হয়ে ওঠেন চন্দ্রিমা ।আজ যেন বড়ো বেশি করে সুব্রতর কথা মনে পড়ছে ।সুব্রত সেন ,তার স্বামী ।সারাটা জীবন স্কুল মাস্টারি করে আর ছাত্র পড়িয়েই কাটিয়ে গেলেন ।নিরীহ শান্ত মানুষটি কখনো কারো সঙ্গে চেঁচিয়ে কথা পর্যন্ত বলতেন না । কিন্তুভেতরে ভেতরে যে অনমনীয় জেদী ব ছিলেন তার পরিচয় চন্দ্রিমা অনেকবারই পেয়েছিলেন ।মনে পড়ে বিয়ের মাস কয়েক পর হঠাৎ একদিন এসে বললেন আমি একটা বাড়ি ঠিক করে এসেছি চন্দ্রিমা সামনের মসে আমরা ওখানে চলে যাব । এবাড়ির সঙ্গে তার ঠিকমতো বনছিল না একথা সত্যি কিন্তু তাই বলে তার স্বামী কাউকে কিছু না বলে দুম করে এরকম একটা সিদ্ধান্ত নেবে এতোটাও তিনি ভাবতে পারেন নি ।
ভাবতে পারেন নি সুব্রতর বাবা মাও । কিন্তু তাদের হাজার আপত্তি কান্নাকাটি কিছুই তাকে টলাতে পারে নি । মাকে বুঝিয়ে বলেছিল সুব্রত মা এরকম রোজ রোজ অশান্তির থেকে এ অনেক ভাল । তাছাড়া আমি তো রোজ অফিস ফেরত তোমার কাছে আসবো , আর রবিবার দুপুরে তোমার কাছেই খাব ।
তা সে কথা তিনি রেখেওছিলেন । মা যতদিন বেঁচে ছিলেন একদিনের জন্য ও তার অন্যথা হয়নি । চন্দ্রিমা দেবীর রাগ অভিমান অনুরোধ কোনো কিছুই তাকে টলাতে পারে নি ।
তা জেদী তো চন্দ্রিমা দেবী ও কিছু কম ছিলেন না । প্রথম থেকেই তিনি ঠিক করে রেখেছিলেন ছেলেদের তিনি ইংলিশ মিডিয়ামে দেবেন দিয়েছিলেনও তাই ।ভগবানের কৃপায় দুই ছেলেই ছিল মেধাবী তাই তাদের উচ্চ শিক্ষিত করে তোলার জন্য তাদের ভবিষ্যত্ সুরক্ষিত করে তোলার জন্য চন্দ্রিমা দেবীর ছিল এক আপোসহীন সংগ্রাম ।
বেশ মনে পড়ে সেদিনের ঘটনা । সুব্রত স্কুল থেকে ফিরে এসে বলেছিলেন শুনছো আজ দাদা ফোন । করেছিল ।জিজ্ঞাসু দৃষ্টি তে চন্দ্রিমা দেবী ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছিলেন ।সুব্রত আবার বলেন দাদা বলছিল বাবলি উচ্চ মাধ্যমিকে স্টার পেয়েছে ।এখানে বেথুন কলেজে পড়ার সুযোগ ও পেয়েছে ।যদি আমাদের কাছে থেকে পড়তে পারে তাহলে খুব ভাল হয় ।
আঁতকে উঠেছিলেন চন্দ্রিমা ।অসম্ভব ,আমি এ দায়িত্ব নিতে পারবো না
।সামনে অরু আর বীরূর মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা ।এখন কারোর জন্য ই আমি আমার বা আমার ছেলেদের এতোটূকু সময় নষ্ট করতে পারবো না।
সুব্রত কয়েক মূহুর্ত স্থির চোখে তাকিয়ে রইলেন চন্দ্রিমার দিকে ।তারপর বললেন ঠিক আছে আমি না করে দেব । কথাগুলো নতুন করে মনে পড়তে নিজের ওপরেই বিরক্ত হলেন তিনি ।এটা এমন কোন ব্যাপার না। যা বারবার মনে করতে হবে নাকি সেই বাবলি এখন রাঁচী কলেজের অধ্যাপিকা তার স্বামী ও অধ্যাপক, তাই মনে পড়ছে ।
সুব্রতর সংগে তার তো প্রায়শই খটামটি লেগে যেত । সুব্রতর বাবা মাকে টাকা পাঠানো , অভাবী ছোটোবোনকে সাহায্য করা এগুলো । কোনোটাই সে ঠিকমতো মেনে নিতে পারতো না ।এমনকি চন্দ্রিমা দেবীর বাবা যখন অসুস্থ হলেন তখন দাদারা থাকা সত্তেও বাবার অসুখে কাড়ি কাড়ি টাকা ঢেলেছে সুব্রত । এসব নিয়ে কিছু বলতে গেলেই বলতেন , তুমি এবং তোমার ছেলেরা ছাড়া ও আরো কারো কারো প্রতি আমার কিছু দায়িত্ব আছে চন্দিমা ।
ফুঁসে উঠেছিলেন চন্দ্রিমা এইভাবে দানছত্র খুললে শেষপর্যন্ত কি কিছু থাকবে । মনে রেখ আমার দুই ছেলেকেই আমি বিদেশে পাঠাব ।অবশ্য ওরা স্কলারশিপ নিয়েই যাবে , তবু কিছু টাকা তো লাগবেই ।
এই ঘটনার কিছু দিন পর নিঃশব্দে তার যাবতীয় সঞ্চিত অর্থ চন্দিমার নামে ট্রান্সফার করে দিয়েছিলেন
সুব্রত ।এমনকি তার মাইনের বেশিরভাগ টাকাটাও সবটাই এনে তুলে দিতেন চন্দ্রিমার হাতে ।নিজের কাছে খুব অল্পই রাখতেন ।
অতীতের ঘটনাগুলো কেন যে আজ মনে এতো ভিড় করে আসছে বুঝে উঠতে পারছেন না চন্দিমা ।একটা চোরা স্রোত যেন মনের মধ্যে পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে । কেযেন মনের মধ্যে থেকে বলছে ভাল করে ভেবে দেখ চন্দ্রিমা তোর কি কোনো ভুল ছিল ? তোর কি কোনো ভুল ছিল ?
সুব্রতর মায়ের তখন খুব অসুখ ।এদিকে বীরুর তখন বাইরে যাবার তোড়জোড় চলছে , সেইসময় একদিন হঠাৎ অসময়ে সুব্রত স্কুল থেকে ফিরে এল ।শুনছো মায়ের খুব অসুখ , এক্ষুনি তৈরী হয়ে নাও ।দাদা ফোন করেছিল মার খুব বাড়াবাড়ি বেশ কিছু টাকা সঙ্গে করে নিও ।
একটু কুণ্ঠিত গলায় চন্দ্রিমা বলে দেখ এখন আমি যেতে পারবো না । সামনের মাসে বীরু আমেরিকা যাচ্ছে এখন কতো খরচ এইসময় আমি তোমায় কোথা থেকে টাকা দেব বল ?
মাথার শিরায় যেন আগুন ধরে গেছিল সুব্রতর । রাগত কন্ঠে কিছু বলতে গিয়েও হঠাৎ থেমে গিয়ে ভাঙা গলায় বলে তুমি ঠিক করছো না চন্দ্রিমা যদিও একথা ঠিক তোমাকে বলে কোনো লাভ নেই , তবুও বলছি এই যে সারা জীবন একচক্ষু হরিণের মতো চললে এতে কোনো ভাল ফল হয় না , হতে পারে না ।
বেরিয়ে গেছিল সুব্রত , একমাস পর যখন বাড়ি ফেরে তখন তার মাথা ন্যাড়া । হাতের আঙুলে দুটো সোনার আংটি ছিল সেগুলো নেই দেখে চন্দ্রিমা বুঝেছিল কোথা থেকে সে টাকার জোগাড় করেছে । কিন্তু এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন করতে তার সাহসে কুলোয়নি ।
গালের ওপর দুটো তপ্তরেখা গড়িয়ে পড়তেই সচেতন হয়ে ওঠে চন্দ্রিমা । আজ যেন মনে হচ্ছে বড়ো ভুল হয়ে গেছে ।শুধু নিজের সংসার ও সন্তানদের কথা চিন্তা করতে করতে বড়ো বেশি আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর হয়ে গেছিলেন যেন । না তার ছেলেদের কোনো দোষ নেই , তিনি যেমন করে তাদের মানুষ করতে চেয়েছিলেন তারা তো তাই হয়েছে ; নিজেরই অজান্তে স্বার্থপরতা ও আত্মকেন্দ্রিকতার বীজ তাদের মনে তিনিই তো বপন করে দিয়েছিলেন , আজ তাদের দোষ দিয়ে কী লাভ ?
ঘর থেকে বেরোতে গিয়ে আয়নার দিকে চোখ পরতে থমকে দাঁড়ায় চন্দ্রিমা ।আয়নার ও প্রান্তের মহিলা তাকে কি যেন একটা প্রশ্ন করছে না ? হ্যাঁ প্রশ্নই তো ছেলেদুটো যদি বিষবৃক্ষ হয় তবে তার বীজ কে ? বীজটা কে ?