কথা দিয়েছিলে —পর্ব পাঁচ — ছবি ব্যানার্জী
ধারাবাহিক উপন্যাস
–কথা দিয়েছিলে
পর্ব পাঁচ
ছবি ব্যানার্জী
কদিন পর এক রবিবার বিকেলে অর্জুন তিতলিদের বাড়ি গিয়ে দ্বৈপায়নকে বলল–কাকু বাড়িটা এত চুপচাপ কেন?কাম্মা আর তিতলিকে দেখছি না?দ্বৈপায়ন বলল–ওরা মা মেয়ে কদিন আগে ওর দাদু ঠাম্মার বাড়ি গেছে। কেন এর মধ্যে তোদের ফোনে কথা হয়নি? অর্জুন বলল– আমি আসলে খুব দরকার ছাড়া ফোন করিনা। খুব ভালো করেছে।দিনরাত হারমোনিয়াম নিয়ে প্যাঁ পোঁ করার থেকে গ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর দাদু ঠাম্মার আদর অনেক ভালো। আমাদের ও দেশের বাড়ি বীরভূমের এক গ্রামে।জানো কাকু বীরভূমের আঞ্চলিক ভাষা আর গ্রামের লোকের আন্তরিকতা আমার খুব ভালো লাগে। পার্ট টু পরীক্ষার পর আমিও যাব।-
দ্বৈপায়ন অর্ক আর অর্জুনকে প্রায় জন্ম থেকেই দেখছে।ওদের দুজনকেই সে খুব ভালোবাসে।কিন্তু অর্জুনকে একটু বেশি পছন্দ করে।ছেলেটার চেহারাটা ভারি মায়াময়।এত মেধাবী ছেলে অনায়াসে ডাক্তারি ইঞ্জিনিয়ারিংএ চান্স পেয়ে যেতে পারত।ইচ্ছে করেই জয়েন্টে বসেনি,শুধু বাবার চাপ পড়বে বলে।টিউশনি করে অনেকটাই নিজের পড়ার খরচ চালায়। এই কর্তব্য পরায়ণয়তা, বাবা মার প্রতি একনিষ্ঠতা দেখে কোথাও তার মনে হয় এই ছেলেটি যদি ভবিষ্যতে তিতলির জীবনসঙ্গী হত।
অর্জুন বলল–কাকু এবার আমি আসি।দ্বৈপায়ন বলল— এখনই উঠবি কি রে বোস।আমি আজ খিঁচুড়ি আর ডিমের ওমলেট বানাবো।একবারে খেয়ে যাবি।দেখবি তোর কাম্মার চেয়েও কেমন টেস্টি হয়। আগে দু কাপ চা করে আনি।চায়ের সংগে চানাচুর খাবি?পাঁপড় ভাজা খেতেও পারিস।অর্জুন বলল–তুমি চুপ করে বসো কাকু।আমি চা করে আনছি। পাঁপড়টা খিঁচুড়ির সংগেই জমে।এখন বরং চা আর চানাচুর খাওয়া যাক।
তিতলি উচ্চমাধ্যমিকে আটানব্বই শতাংশ নম্বর পেয়ে কৃতিত্বের সংগে উত্তীর্ণ হল। অর্ক খবরটা শুনেই চলে এসেছিল।এসেই তিতলিকে জড়িয়ে ধরে অভিনন্দন জানালো।দ্বৈপায়ন লক্ষ্য করল তিতলির মুখে লজ্জার আভা। অর্জুন তিতলিকে হ্যান্ডশেক করে বলল–আমি তোর সাফল্যে গর্বিত তিতলি।
তনু লক্ষ্য করল দ্বৈপায়নের হাসিখুশি মুখটা কেমন গম্ভীর হয়ে গেল।ঘরে এসে বলল–আচ্ছা তোমার এত রাগ করার কি হল বলতো?অর্ক তো সবার সামনেই তিতলিকে হাগ করেছে।দ্বৈপায়ন বলল–তনু আমি হাগ করাটা দৃষ্টিকটু হলেও ওদের আবাল্যের বন্ধুত্বের কথা ভেবে কিছু মনে করতাম না যদি না তিতলি লজ্জায় লাল হয়ে না যেত।আমি তিতলিকে কলকাতায় রেখে পড়াবার ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি।ও আগে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যাকে খুশি ভালোবাসুক আমি আপত্তি করব না। এখন লেখাপড়া করার বয়স।ভালোবাসার বয়স নয়।
দ্বৈপায়ন আগেই কলকাতার কয়েকটা কলেজের ফর্ম তুলে রেখেছিল।কলকাতায় ভর্তি হবার কথা শুনে প্রথমটাই তিতলি বেঁকে বসেছিল।তনু অবুঝের মতো কান্নাকাটি শুরু করেছিল।মা মেয়েকে অনেক মিষ্টি কথায় বুঝিয়ে দ্বৈপায়ন তিতলি ও তনুকে নিয়ে কলকাতায় শ্বশুর বাড়ি এল।তনুর বাবা মা মেয়ে জামাই আর নাতনিকে একসংগে দেখে খুব খুশি হল।
তনুর বাবা বলল–দিদিভাইকে তো দেখে মনে হচ্ছে গুটি কেটে ঝলমলে প্রজাপতি হয়ে উঠেছে।তিতলি রাগ দেখিয়ে বলল–ও আমি বুঝি আগে মথের মতো দেখতে ছিলাম?–না আগে যা দু তিনবার এসেছিলিস তখন মথের মতো না হলেও রোগা প্যাংলা ছিলি।গায়ের রঙটাও এমন গোলাপি ছিল না।যাই হোক এবার তো বহুদিন তোকে আমার সংগে ঘর করতে হবে।বুঝলি দিদিভাই আমার বুড়িটা এখন বড্ড খিটখিটে হয়ে গেছে।ভাবছি তোর বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত তোকে টেম্পোরারি বৌ করলে কেমন হয়?তিতলি কপট রাগ দেখিয়ে বলল–বুড়ো তোমার বৌ হতে আমার ভারি বয়েই গেছে।আমার বিয়ে হবে রাজপুত্রের সংগে।সেই রাজপুত্রের ছবিটা এখন তার মনের গোপন কুঠুরিতে যত্ন করে রাখা থাকবে।তিতলি বিশ্বাস করে একদিন ঠিক সময়ে রাজপুত্র একগুচ্ছ রক্ত রাঙা গোলাপ দিয়ে তাকে প্রপোজ করবে।
তিতলিকে ভর্তি করে তনু আর দ্বৈপায়ন ফিরে গেল।তারা যাওয়ার আগে বলে গেল –মন খারাপ করিস না মা।আমরা মাঝে মাঝেই এখানে আসব।দ্বৈপায়ন বলল–তোর মা যখন আসবে তখন পনেরো কুড়ি দিন থেকে যাবে।তিতলি জল ভরা চোখ নিয়ে বলল–আর তুমি?দ্বৈপায়নের বুকটা একসংগে বেদনা ও আনন্দে টনটন করে উঠল।
নিজের ঔরসজাত সন্তানের জন্য কি এর থেকেও বেশি কষ্ট যন্ত্রণা আনন্দ হয়?বলল–মা রে আমি কি তোকে বেশিদিন না দেখে থাকতে পারি?মন দিয়ে লেখাপড়াটা কর মা।
কেটে গেল আরো কয়েকটা বছর।অর্জুন কলকাতার কলেজে অঙ্কের অধ্যাপক হয়ে জয়েন করেছে।অর্ক ব্যঙ্গালোরে নামী কোম্পানিতে চাকরি করছে।অর্কর ফোনে জেনেছে তার বাবা ব্যাঙ্গালোরে ছেলের জন্য দোতলা বাড়ি কিনেছে।তিতলি নিজেও এম এ তে ফার্ষ্ট ক্লাস পেয়ে নেট কোয়ালিফাই করে চাকরির অপেক্ষায়।মধ্যের এই কবছর অর্ক আর অর্জুনের সংগে ফোনে তিতলির নিয়মিত যোগাযোগ ছিল।এম এ ফাইনাল ইয়ারে পড়ার সময় দুবার হঠাৎই অর্জুনের সংগে কাকতালীয় ভাবে তার দেখা হয়।দুদিনই রাস্তার চায়ের দোকানে ওরা চা খেতে খেতে গল্প করেছে।তিতলি সেই সময় বারবার কোনো একটা রবিবার দেখে অর্ককে নিয়ে তার দাদুর বাড়ি যেতে বলেছিল।পরবর্তীতে অর্ক একাই বেশ কয়েকবার তার সংগে দেখা করেছে।কিন্তু সেকথা কি অর্জুন জানত?অর্ক নিশ্চয়ই জানিয়েছে। এখন আর তিতলি গোপন করবে না।বাড়ি ফেরার আগে অর্জুনকে সবটা বলবে।তাদের একসময়ের প্রতিজ্ঞাই ছিল কোনো কথা কেউ কাউকে গোপন করবে না।
যেদিন অর্ক আর অর্জুন এক রবিবার প্রথম তার দাদুর বাড়িতে দেখা করতে গেল তখন তিতলির দিদু বলল–ও দিদিভাই বলি এই ছুপা রুস্তম দুটি কে?যাদের জন্য পঞ্চ ব্যঞ্জন রান্নার ফরমাশ করেছিস?তিতলি বলল–ওমা তুমি কাদের ছুপা রুস্তম বলছ গো?ওরা আমার ছোটোবেলার বন্ধু।এই যে অর্ককে দেখছ ও আই আই টি ইঞ্জিনিয়ার।আর অর্জুন অঙ্কে গোল্ড মেডেলিস্ট।সে এখন নামকরা একজন অধ্যাপক।
দাদু বলল–ও তা এদের মধ্যে কে তোর প্রাণের বন্ধু?মানে বিয়ের আগে আমি যেমন তোর দাদুর বন্ধু ছিলাম সেরকম নয় তো?অর্ক বলল—ও দিদু তো সেই বন্ধু কি করে তোমার প্রাণেশ্বর হল সেই গল্পটা শুনতে চাই।অর্জুন আর তিতলি ও বলল–বলো বলো দিদু।মনে হচ্ছে খুব রোমান্টিক গল্প হবে।
দিদু বলল–সে এক মস্ত গল্প ভাই। তবে গল্প ভাবিস না।এটা বলতে পারিস রোমাঞ্চকর ঘটনা। আমাদের সময়ে তো তোদের মতো বুক ফুলিয়ে প্রকাশ্যে ছেলেদের সংগে বন্ধুত্ব বা প্রেম করার উপায় ছিল না।ঐ যা চোখে চোখে কথা হত। একটু আধটু ইশারা।কিংবা কালে ভদ্রে বড়জোর একটু নরম হাতের ছোঁয়া।সেই রবি ঠাকুরের গানের মতো–একটুকু ছোঁয়া লাগে,একটুকু কথা শুনি/তাই নিয়ে মনে মনে রচি মম ফাল্গুনী।তোর দাদু রাস্তা থেকে ছাদে আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকত।কখনও সাইকেলের পরিচিত ঘন্টি বাজিয়ে বাড়ির পাশ দিয়ে চলে যেত আমাকে এক ঝলক দেখার জন্য।এইভাবেই অনেকদিন চলছিল।দুই বাড়ির চোখ এড়িয়ে এর বেশি করা যেতো না।তো তোদের দাদু একদিন প্রচণ্ড এক দুঃসাহসিক কাজ করল।অর্জুন বলল–কি করল?
দিদু বলল–তখন আমি সবে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছি।তোর দাদু ও বি এ পাশ করে এখানে সেখানে চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছে।সেদিন আমি চাতক পাখির মতো ছাদে পায়চারি করছি।হঠাৎ দেখি তোর দাদু একটা ঢিলের সংগে একটা প্রেমপত্র বেঁধে ছাদে ছুড়ল।আমি সেটা ছাদে পড়ল বলে ভেবে চোখ বুঁজে ফেলেছি।বুকে তখন যেন ঘনঘন ঢেঁকির ঘা পড়ছে।
—তারপর তারপর??
হঠাৎ নীচে থেকে মায়ের ডাক।তাকিয়ে দেখি ছাদে কিচ্ছু পড়ে নেই।ঢিলাটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পরবি তো পর একেবারে বাবার মাথায়। তোর দাদু ততক্ষণে পগার পার।বাবার মাথায় ততক্ষণে একটা মস্ত একটা আলু।বাবা তো রেগে অগ্নিশর্মা। মাথায় জল টল দিয়ে বাবাকে সুস্থ করা হল। তারপর বাবা চিঠিটা জোরে জোরে পড়তে শুরু করল।আমি প্রথম লাইনটা শুনেই ঘরের দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়েছি।
অর্ক বলল–এমন রোমান্টিক চিঠির সবটা শুনলে না?ঠিক আছে প্রথম লাইন টা বলো।
দাদু বলল–সেই রকম কিছু নয় রে।লিখেছিল–প্রিয়তমা,আমার মনের কথা গানে জানালাম।গানের প্রথম লাইন ছিল–আমার পরাণ ও যাহা চাই,তুমি তাই তুমি তাই গো।গোটা গানটায় নাকি লিখেছিল।তাপরপর কিন্তু জল খুব বেশিদুর গড়ায়নি।শুধু মা চুলের মুঠি ধরে দু চার ঘা দিয়ে বলেছিল–আজ থেকে তোর ছাদে ওঠা বন্ধ।তোর দাদুর ততদিনে রেলে চাকরির চিঠি এসে গিয়েছিল।পাল্টি ঘর ছিল,বিয়ে হয়ে গেল।
তিতলি বলল–অসাধারণ প্রেম গো।এতো আস্ত একটা উপন্যাস?আমার কখনো যদি তোমার মতো বন্ধু জোটে তাহলে সবার আগে তোমাকে বলব।
তিতলি স্মৃতি থেকে বর্তমানে ফিরে এল।মা বাবা ঘনঘন ফোন করছে বাড়ি যাওয়ার জন্য।এদিকে তিতলি যার ফোনের আশায়,সযত্নে লালিত স্বপ্ন পূরন করার প্রতীক্ষায়
চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করছে।তার ফোন নেই।তবে কি সে নিজে ভুল ছিল?ভাবতে ভাবতেই অর্কর ফোন।
তিতলি ফোনটা ধরতেই অর্ক বলল–কাল রবিবার আমি সকালের ফ্লাইটে আসছি। তোকে এবার মনের কথা জানানোর সময় হয়ে গেছে। তুই রেস্টুরেন্টের কেবিন বুক করে আমাকে হোয়াটস আপে জানা।গোটা দিনটা আমার জন্যে রাখবি তো?তিতলির গলা কেঁপে গেল।কোনোরকমে বলল–তুই আয় অর্ক।অর্জুনকে ডাকব?–অর্জুনের সংগে আমরা বিকেলে দেখা করে সব বলব।
অর্জুন একটা মেসে থেকে কলেজে পড়ায়।উইক এন্ডে দুর্গাপুরে যায়।এই কবছরে পরপর তার পিসিঠাম্মা ও তার ঠাম্মার মৃত্যু হয়েছে।তার দাদু এখন দেশের বাড়ি বিক্রি করে তাদের কোয়ার্টারে থাকে।বাড়ি বিক্রির টাকা দিয়ে অর্জুন দাদুর ইচ্ছামতো কলকাতায় একটা তিনরুমের ফ্ল্যাট বুক করেছে।বাবার রিটায়ারমেন্টের পর সবাই একসংগে কলকাতায় থাকার ইচ্ছা।
অর্জুন ও ব্যাকুল প্রতীক্ষায় তিতলির জন্য অপেক্ষা করে আছে।তার নিরুচ্চারিত ভালোবাসা কি তিতলি টের পায়?সেও কি অপেক্ষা করে আছে?তিতলির কাছে ফোনে জেনেছে সে কয়েকদিনের জন্যে দুর্গাপুরে যাবে।সে কি মনে মনে বলছে–আর কবে প্রপোজ করবি রে হাঁদারাম?আমি যে তোর ডাকের অপেক্ষায় দিন গুণছি।
চলবে–