জার্মানি: জাটিঙ্গার ফিনিক্স হয়ে ওড়া ©✍ সায়ন্তন ধর

জার্মানি: জাটিঙ্গার ফিনিক্স হয়ে ওড়া

©✍ সায়ন্তন ধর
(অষ্টম পর্ব)

…পরদিন ভোর ভোর বেরিয়ে পড়লাম মিউনিখের উদ্দেশ্যে। কিন্তু রাস্তা বন্ধ থাকায় বাস একটু ঘুর পথে যাবে। থুরিনজিয়া প্রদেশের মধ্যে দিয়ে যখন বাস যাচ্ছিল তখন বাসটাও গেল খারাপ হয়ে। জার্মানির মতো এমন উন্নত দেশে রাস্তা খারাপ, বাস খারাপ একই দিনে একটু অদ্ভুত শোনালেও আমার কিন্তু মন খারাপ হলো না। হয়তো এই থুরিনজিয়া প্রদেশকে আরও বেশী করে জানাবার জন্যই এ ভগবানের লীলা। আমি একে যতটা চিনি তা আমার উদ্ভিদবিদ্যা পড়ার সৌজন্যেই। আমরা বিটি কটন বা বিটি ব্রিঞ্জাল নামগুলি কমবেশি সবাই শুনেছি। আসলে নামক ব্যাক্টেরিয়ার একটি জিনের সাহায্যে তুলা বা বেগুন গাছকে বিভিন্ন পোকার আক্রমণ থেকে বাঁচানো হয়। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার এটি। আর্নস্ট বার্লিনার নামে একজন জার্মান বিজ্ঞানী থুরিনজিয়া প্রদেশে বসে এই অনুজীবটিকে পুনঃ আবিষ্কার করেন বলে এর প্রজাতির নাম এই প্রদেশের নামে করা হয়েছে। এইসেনাক শহরে আমাদের বাসটি খারাপ হয়ে গেছে। কাছাকাছি দ্রষ্টব্য স্থান বলতে হাইনিচ জাতীয় উদ্যান। বাসের যাত্রীরা কেউ কেউ ঐ শহরেই হোটেলে থাকবেন, কেউ বা কোন আত্মীয়ের বাড়িতে রাতটা কাটাবেন। আমি ঠিক করলাম একদিনে হাইনিচ ঘুরে কাল সকালেই চলে আসবো এখানে। বাস আবার আগামীকাল যাত্রা করবে মিউনিখের উদ্দেশ্যে। হাইনিচের প্রধান আকর্ষণ ক্যানোপি ওয়াকওয়ে তে গেলাম। সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও অন্যান্য পশুপাখি দের চলাচলে অসুবিধা সৃষ্টি না করে সমগ্র অরণ্যের আস্বাদন দেওয়ার এ এক আন্তরিক প্রচেষ্টা। ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই ওয়াকওয়ে দিয়ে মাটি থেকে ২৪ মিটার উচ্চতায় হেঁটে চলেছি। অন্য অরণ্য পথ গুলিতে হাতের সামনে বীরুৎ ও গুল্মজাতীয় উদ্ভিদগুলিকে পেতাম। এবারে ছুঁয়ে দেখছি বৃক্ষের পাতাগুলিকে। আর মনে পড়ে যাচ্ছে ছোটবেলায় রুডিয়ার্ড কিপলিং এর চেরি ট্রি গল্পটি। সেখানে ছোট ছেলেটি যেভাবে গাছের কচি পাতা গুলিকে ছুঁয়ে অনুভব করছিল আমিও তেমনই অনুভব করছিলাম। যে ফটো গুলো তুলছিলাম তার কোনটিকে মোবাইলের ওয়ালপেপারে স্থান দেব তা ঠিক করতে আমি হিমশিম খেতে লাগলাম। ১৯৯৭ সালে বীচ () গাছকে সংরক্ষণের জন্য এই বনভূমিকে সংরক্ষিত অরণ্য ঘোষণা করা হয়। বীচ সংখ্যাগরিষ্ঠ এই বনভূমিতে সংখ্যালঘুরা হল অ্যাশ (), ম্যাপল (), হর্ণবীম ( ), লিণ্ডেন () ও চেকার ( )। এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছলাম একটি ওয়াচ টাওয়ারে। এটি প্রায় ৪৪ মিটার উচ্চতা সম্পন্ন। এতটা উচ্চতা থেকে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ক্যানোপি দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। কোথাও কোথাও সবুজ গালিচার ওপর কমলা, হলুদ, লাল রঙের মোজাইক করা যেন। কোথাও কোথাও বাচ্চাদের জন্য রয়েছে স্পাইডার ওয়েব। কোথাও কোথাও নানা পশুপাখির কাঠামো। এভাবে প্রায় ১০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে যখন ক্লান্ত হলাম, নেমে এলাম নীচে। অপরাহ্ন বেলা ফুরোতে এখনও কিছুটা বাকি। একটা ছোট স্ট্রিমলেটের পাশে বসলাম। পা ডুবিয়ে দিলাম ঠাণ্ডা জলে। হঠাৎ পরিচিত ঠক ঠক ঠক আওয়াজ শুনে চোখ ঘুরিয়ে নিই ওক গাছগুলির দিকে। কিন্তু কোন কাঠঠোকরা তো দেখতে পেলাম না, তারপরেই চোখে পড়লো একটি কালো রঙের পাখি, মাথায় যেন লাল টুপি পরা। তার ছানাকে খাওয়াচ্ছে। বুঝলাম ঠিকই ধরেছি, এ হল কালো কাঠঠোকরা যার বিজ্ঞানসম্মত নাম . আমাদের দেশে এদের দেখা মেলেনা, এরা ইউরোপ ও রাশিয়া পাওয়া যায়। নদীর তীর ধরে সাদা ঘন্টার আকৃতিতে ফুটে রয়েছে সামার স্নোফ্লেক () প্রতিটি পাপড়ির অগ্রভাগটা এমন যে মনে হচ্ছে শিশিরবিন্দু জমে আছে যেন। লাল, গোলাপি, বেগুনি, সাদা ও হলুদ রঙের অ্যানিমন () ফুটে রয়েছে পুরো অঞ্চলে। অ্যানিমন কথাটার অর্থই ফুল, আর এ যেন ফুলের রাজ্য। ক্যানোপি ওয়াকওয়ে থেকে এদের দেখা যায় না। এরপর সন্ধ্যা হল, রাত হল, রাত কেটে ভোর হতেই এইসেনাকের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। দেখলাম বাস ঠিক হয়ে গেছে। অনেক ভালোলাগা নিয়ে ও মিউনিখ ঘোরার আনন্দে ভরপুর হয়ে রওনা দিলাম। বাভারিয়া প্রদেশের রাজধানী মিউনিখ। এই শহরটি ঐতিহাসিক, রাজনৈতিকভাবে ও ফুটবলের জন্য বিখ্যাত। মিউনিখ কেন্দ্রিক বুন্দেশলিগার ফুটবল দল বায়ার্ন মিউনিখ আমার অন্যতম ফেভারিট। এই দলকে আন্তর্জাতিক মর্যাদা এনে দেওয়ার পেছনে যার অবদান অনস্বীকার্য কিছুদিন আগে সেই মহান ফুটবলার জেরহার্ড মুলারকে আমরা হারিয়েছি। আলিয়াঞ্জ এরিনার সর্বত্র এখনও তাঁর অবদানের কথা লেখা রয়েছে। সন্ধ্যা হলে পরে গোটা স্টেডিয়াম সেজে উঠল লাল আলোয়। সে এক মায়াময় দৃশ্য। পরদিন মিউনিখ থেকে ১০০ কিলোমিটার দক্ষিনে আল্পস পর্বতমালার সম্প্রসারিত অংশ যা বাভারিয়ান আল্পস নামে পরিচিত, সেই উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। স্যাক্সন সুইজারল্যান্ড ছিল স্যান্ডস্টোনে গড়া আর বাভারিয়ান আল্পস লাইমস্টোনে গড়া। এখানকার সোলেনহফেনে এমনই একটি চুনাপাথরের গুহা থেকে সরীসৃপ ও পাখির মিসিং লিঙ্ক আর্কিওপটেরিক্সের ফসিল পাওয়া গিয়েছিল। এই বাভারিয়ান আল্পস পর্বতমালার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ জাগস্পিৎজে (২৯৬২ মিটার)। এটি সমগ্র জার্মানিরও উচ্চতম শৃঙ্গ। পায়ে হেঁটে তো এই শৃঙ্গে আরোহন করাই যায়, কিন্তু আমি তা করলাম না। চড়ে বসলাম ব়্যাক রেলে। এই ব়্যাক রেলওয়ে হল এক বিশেষ ধরনের রেলওয়ে যেখানে দুটি সমান্তরাল ট্র্যাকের মাঝে একটি খাঁজকাটা লাইন থাকে। ট্রেন গুলিতেও চেন সিস্টেম থাকে। যার সাহায্যে অবলীলায় খাঁড়া পর্বতেও উঠতে পারে ট্রেন। এখানেও তাই মাত্র ২৫৮৮ মিটারের যাত্রাপথে ২৬৫০ মিটার উচ্চতা উঠে পৌঁছে গেলাম দেশের সর্বোচ্চ অংশে। এখানে এসে দেখলাম অশিতিপর বৃদ্ধ-বৃদ্ধারাও ঘুরতে এসেছেন। সত্যিই এমন ব়্যাক রেলওয়ে যদি পশ্চিমবঙ্গে থাকতো তাহলে সান্দাকফু-ফালুটের সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে পারতো বয়স্করাও। অবশ্য নীলগিরি রেলওয়েতে এমন ট্র্যাক দেখা যায়। এতটা উচ্চতার কারণে এখানে ঠান্ডা প্রবল। ৪৭° উত্তর অক্ষাংশ হিসেবে এখানকার পার্মানেন্ট স্নোলাইন ২৭০০-৩২০০ মিটার। তাই এই শৃঙ্গের একদম উপরিভাগে গ্রীষ্মকালেও বরফের দেখা মিলল। বরফ নিয়ে একটু খেললাম, গড়াগড়ি করলাম। তারপর চড়ে বসলাম রোপওয়েতে। এখানে রোপওয়েকে সেইলবান বলে। প্রায় ১২০ জন যাত্রী নিয়ে ৩৮ কিমি/ঘন্টা গতিবেগে এগিয়ে চলল আমাদের সেইলবান। পাখির চোখের দৃষ্টিতে নীচের পর্বতরাজিকে দেখছি। সরলবর্গীয় গাছেদের থেকেও অনেক উঁচুতে তখন আমরা। সাত মিনিটে ৩২১৩ মিটার পথ পাড়ি দিয়ে এসে পৌঁছলাম এইবসি হ্রদে। এই রোপওয়ে বিশ্বের দীর্ঘতম। পর্বতের কোলে এই হ্রদের সৌন্দর্য্য বেশ উপভোগ্য, জাগস্পিৎজে শৃঙ্গের কম্পমান প্রতিবিম্ব সৃষ্টি হয়েছে এইবসির জলে। ঠান্ডা শিরশিরানি হাওয়া খেলে বেড়াচ্ছে এখানে। আকাশে উড়ছে বেশ কয়েকঝাঁক বড় পাখি। তাদের কোনটা Peregrine falcon, কোনটা European honey buzzard. একটানা ডেকে চলেছে Hazel grouse, দেখতে অনেকটা মুরগির মত, কিন্তু মুরগি নয়। অ্যাল্পেনরোজ ( ) এর গোলাপি ফুলে ভরা ডালে বসে জুলজুল করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে এক জোড়া Eurasian pygmy owl. কি যে দেখছে, আদৌ দেখতে পাচ্ছে কিনা কে জানে। তবু ওদের দেখে কেন যেন মায়া হয়। হ্রদের ধারে সাদা এডেলউইস ও নীল জেনশিয়ান, কর্ণফ্লাওয়ার ফুল গুলির মধু খেয়ে বেড়াচ্ছে কমলা কালো রঙের লেজার মার্বেল্ড ফ্রিটিলারি প্রজাপতিরা। হ্রদের চারপাশ অর্ধচন্দ্রাকারে ঘুরে এসে বোটিং এরিয়ায় এলাম। বিকেলটা কাটিয়ে দিলাম জলে ভেসে ভেসে। একটা সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায় যখন হ্রদের জলের বন্ধন কাটিয়ে উঠে আসছি ডাঙায়, গাছের কান্ডে হেলান দিয়ে দেখলাম কালো সারসের দল ল্যান্ডিং করছে হ্রদের স্বচ্ছ সবজে আভা জলে। সেই গোধূলির চুরি যাওয়া আলোয় ওদের গোলাপি পায়ের রিফ্লেকশন হচ্ছে অশান্ত জলতরঙ্গে। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নেমে এলো। আমিও ফিরে এলাম আমার অস্থায়ী আস্তানায়। রাতের মেনুতে ছিল হ্রদের মিষ্টি জলের মাছ ও ভাত। পাইক, ব্রাউন ট্রট, রেনবো ট্রট, টেঞ্চ, কার্প এমনই অনেক রকম মাছের নাম লেখা মেনুতে। রেনবো ট্রটের ছবি রয়েছে দেওয়ালে, কি সুন্দর দেখতে, খেতে ইচ্ছে হল না, তাই ব্রাউন ট্রট অর্ডার করলাম। এর সাথে ছিল পাতি লেবু। একদম যেন ঘরোয়া পরিবেশন।

(ক্রমশঃ)

©✍ সায়ন্তন ধর
৩০/০৮/২০২১

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *