জার্মানি: জাটিঙ্গার ফিনিক্স হয়ে ওড়া © সায়ন্তন ধর
জার্মানি: জাটিঙ্গার ফিনিক্স হয়ে ওড়া 🇩🇪
(ষষ্ঠ পর্ব)
…কিছু কিছু কায়াকে প্যাডেল রয়েছে আবার কোনটায় রয়েছে মোটর ইঞ্জিন। বড় বড় কায়াক গুলি সুদৃশ্য টেবিল চেয়ার দিয়ে সাজানো। টেবিল-চেয়ার কখনো লাল নীল রঙে রঙিন আবার কখনো বা বার্নিশের আভিজাত্য রয়েছে তাতে। কোনটিতেই ছাউনি চোখে পড়ল না। কি দরকার যেখানে অল্ডার গাছগুলি সরলবর্গীয় ভাবে উপরে উঠে তাদের ক্যানোপি বিস্তার করেছে জলপথের ওপর। এখানে শুধুই ছায়ার সাম্রাজ্য সূর্য সামান্য অনুপ্রবেশ টুকুও করতে পারে না। শীতে প্রবল ঠান্ডায় প্রবাহপথ গুলি জমে বরফে পরিণত হয়। জালিকাকার শিরাবিন্যাসের ন্যায় কমবেশি ২০০টি প্রবাহ পথের মোট দৈর্ঘ্য ১৫০০ কিলোমিটার। কায়াকটি ভাড়া নেওয়ার সময়ে স্প্রীওয়াল্ডের একটি সম্পূর্ণ ম্যাপ দিয়ে দিয়েছিল। সেটার সাহায্যে গত দু’দিন ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছি এর আনাচ-কানাচ। ম্যাপ কোথাও ব্যর্থ হলে বা পথ হারালে Komoot অ্যাপের সাহায্যে ইন্টারনেট ব্যাতিরেকেও সহজে পথ খুঁজে নিচ্ছিলাম। এই অপূর্ব সুন্দর জলাভূমির পার্শ্ব সৌন্দর্য ছাড়াও অন্যান্য দর্শনীয় বস্তুগুলির অবস্থানও বলে দিচ্ছিল এই অ্যাপ। সুন্দর সুন্দর চার্চ, প্রাসাদ ও মিউজিয়াম দেখেছি। দেখেছি জলের মধ্যে তাদের প্রতিচ্ছবিও। বার্লিনের জনঅরণ্য থেকে অবসর সময় কাটাতে স্থানীয়রাও আসে এই জলঅরণ্যে। এ যেন জার্মানির ভেনিস। আমার কাছে তো স্প্রীওয়াল্ড ভেনিসের চেয়েও সুন্দর। জলে ভাসতে ভাসতে মনে পড়ে গেল মায়ের কিছু লেখা –
🇩🇪 “চল ভাসি নির্জনে পাল তুলে
মন খুশি সাম্পানে দিক ভুলে।
মন দোলে ঐ আকাশ হাসছে নীল
ঢেউ তোলে ঐ বাতাস উড়ছে চিল।
রোদ সোনা জলছবি নিচ্ছে বাঁক
ঢেউ গোনা মুলতুবী আজকে থাক।
ঘূর্ণিস্রোত টালমাটাল খড়কুটো
জলবীরুৎ জড়ালো হাতদুটো।
স্বপ্নদ্বীপ কোন কালে ভাসছিলো
ঊষার টীপ ঐ ভালে জ্বলছিলো।
দুধ সাদা বক ওড়ে শ্রী অ্যালি
দূর কোথা ওক সারি স্প্রী ভ্যালি।
মনবীনা ঝঙ্কারে বারে বারে
দেখছোনা মন কাড়ে সম্ভারে।
মধুময় জোছনা নয়নে
লেগে রয় আনমনা স্বপনে।” 🇩🇪
সন্ধ্যা হয়ে আসে, কত পথ পেরিয়ে এলাম এভাবে। প্রবাহ পথের পাশে টাইলস বসানো সুদৃশ্য অ্যালিগুলি থেকে রাতের জলছবিও মায়াময়। ফিরে এলাম লিপে গ্রামে। আজ রাতের মেনুতে রয়েছে রুটি, সসেজ ও পৃথিবীর বিখ্যাত স্প্রী এর নিজস্ব আচার। অপূর্ব স্বাদ নিতে নিতে আচারের রেসিপি জিজ্ঞেস করলেও ওরা তা বলতে চায়নি। লুবেনে থাকতে “House for man and nature” নামক মাল্টিমিডিয়া এক্সিবিশনে জেনেছিলাম স্প্রীওয়াল্ডের ভূমিরূপ ও বাস্তুতন্ত্র সম্পর্কে। স্কেল্পজিগে থাকাকালীন তেমনি “On the move underwater” দেখার মাধ্যমে জলের নিচের ফ্লোরা ও ফনা সম্পর্কে জানতে পেরেছিলাম। বৃহৎ ক্যাটফিশ থেকে ক্ষুদ্র জলমাছি সবকিছুই দেখেছিলাম অসীম আগ্রহে। পরদিন আর প্রবাহ পথে সময় না কাটিয়ে রূপকথার মতো বনাঞ্চলে হাইকিং করে চলেছি বার্গ শহরের পথে। বনাঞ্চলের তীরভূমি গুলিতে দেখা মিলল একটি ভোদর পরিবারের। ওরা ভীষণ লাজুক। রোজমেরী গাছের ঝিরিপাতার আড়াল থেকে দেখছিলো আমাকে। হাইকিং রুটের ধারে বালি মাটি এতটাই অনুর্বর যে সেখানে অসংখ্য পতঙ্গভূক সূর্যশিশিরের দেখা মিলল। বড় গাছ গুলি বেশীরভাগই অল্ডার ও ওক, এর সাথে সাথে কিছু ক্রানবেরী ও অরোকেরিয়া চোখে পড়লো। জলাভূমির ধার ঘেসে রয়েছে কটনগ্রাসের ঝোপ। অনিন্দ্যসুন্দর ও ঐতিহ্যবাহী কটেজ প্রাসাদোপম দু-একটি বাড়ি চোখে পড়লো পথে। এই নেচার অ্যাডভেঞ্চার ট্রেইলের শেষ প্রান্তে বার্গ শহরে কৃষিভূমির দেখা মিলল। এখানকার মানুষ কৃষিকাজ ও মৎস্য শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করেন। বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটালাম ভেষজ ও মশলার বাগানে। বার্গের এক্সিবিশনে দেখানো হলো “Viewpoints & views”, যাতে প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত কৃষিভূমি ও কৃষিকাজের ধারা বর্ণিত হয়েছে। স্প্রীওয়াল্ড থেকে এবার বিদায় নেওয়ার পালা। এই বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ প্রকৃতি সংরক্ষণ, প্রাকৃতিক পর্যটন, আঞ্চলিক বিকাশ ও পরিবেশ সংক্রান্ত শিক্ষা এই চারটি বিষয় এর ওপর গড়ে উঠেছে। বার্গ থেকে কোটবাস শহর হয়ে আরো দক্ষিনে যাওয়ার পথে অ্যাজেলিয়া ও রডোডেন্ড্রন পার্কে ব্যাসল্ট শিলায় নির্মিত Rakotzbrücke ব্রীজের স্কাল্পচার মুগ্ধ করল আমাকে। সংশ্লিষ্ট হ্রদের জলে বেশ কিছু রক স্কাল্পচারও দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে তৈরি শিলা নির্মিত এই ব্রিজে একটি আর্চ রয়েছে যা হ্রদের জলে প্রতিবিম্বিত হলে একটি পূর্ণ বৃত্ত রচনা করে। এই ব্যাসাল্ট পাথরগুলি যেখান থেকে আনা হয়েছিল আমার গন্তব্য এখন সেটাই। হয় শত শত গোলকধাঁধা সদৃশ্য গর্জে হারিয়ে যাওয়া বা এলব্ নদীর স্যান্ডস্টোন পর্বতের মধ্যবর্তী বিশাল উপত্যকাকে দুচোখ ভরে দেখা। স্যাক্সন সুইজারল্যান্ড জার্মানির সুন্দরতম ন্যাশনাল পার্ক যা আমি ঘুরেছি। গোপন রহস্যগুলি খুঁজে বের করেছি। বিশাল বিশাল রককলামগুলিতে উঠেছি। ঘন সবুজ অরণ্যের মধ্যে ঘন্টার পর ঘন্টা একা পথ হেঁটেছি। মনোরম এই হাইকিংরুট ধরে চলেছি অজানাকে জানতে অচেনাকে চিনতে। স্যাক্সন সুইজারল্যান্ড নামটি শুনে হঠাৎ মনে হতে পারে জার্মানি ছেড়ে সুইজারল্যান্ড গেলাম কেন। এর পেছনেও একটা গল্প আছে। শোনা যায় দুজন সুইস আর্টিস্ট অ্যাড্রিয়ান জিঙ্গ ও অ্যান্টন গ্রাফ ১৭৬৬ সালে ড্রেসডেন একাডেমি অফ আর্টে নিযুক্ত হন। তাদের ঘরের জানালা দিয়ে যে টিলা আকৃতির পাহাড়টি দেখতে পেতেন তার সাথে তাদের শৈশবে দেখা সুইস জুরা পর্বতের মিল রয়েছে। তাই প্রথমদিকে মেজেন হাইল্যান্ড নামে ডাকা হলেও পরবর্তীতে এটি পরিচিতি পায় স্যাক্সন সুইজারল্যান্ড নামে। এস বান ট্রেনের সুবিধা থাকলেও আমি ধরলাম এলব্ সাইকেল রুট। কারণ যত বেশি গতিবেগ সম্পন্ন যানে যাত্রা করা যায়, প্রকৃতিকে উপভোগ করা যায় ততটাই কম। প্রায় সমতল রাস্তায় পাঁচ ঘণ্টা সাইকেল চালিয়ে এসে পৌঁছলাম ব়্যথেন গ্রামে।
(ক্রমশঃ)
©✍🏼 সায়ন্তন ধর
২৮/০৮/২০২১ 🇩🇪