ভেবে দেখবেন – – – – – – – – -: বিতান গুপ্ত ।।

– ————ভেবে দেখবেন –
– – – – – – – -: বিতান গুপ্ত ।।

দুর্গা পূজা নিয়ে আপামর বাঙালীর উৎসাহ উদ্দীপনার ঘাটতি নেই। এই পূজা এখন এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। প্রতিমা দর্শনই মূল লক্ষ্য হওয়ায় প্রতিমার নির্মান শিল্পীদের নাম মন্ডপগুলোয় শোভা পায় এবং অনেকসময়ই খবরের শিরোনামেও তাঁরা আসেন। কিন্তু এই বিশাল কর্মযজ্ঞে যে প্যান্ডাল ও আলোকসজ্জা নজর কাড়ে তার কারিগর বা শিল্পীদের এই উৎকর্ষতা , বিশেষ দক্ষতা আড়ালেই পড়ে থাকে। প্যান্ডালের রকমারি বাহার – প্রাচীন ঐতিহ্যশালী মন্দিরই হোক বা কোনো সৌধ – তা বিশেষ দক্ষতায় গড়ে তোলেন নির্মাণশিল্পীরা। এই নির্মানশিল্পীরা ছড়িয়ে রয়েছেন শহর থেকে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। তাঁদের দক্ষতা প্রশ্নাতীত। কোথাও তৈরী হয় ইলোরার গুহার নিদর্শন বা আদিবাসী সমাজ,আবার কোথাও ইংল্যান্ডের বাকিংহাম প্যালেস, কোথাও অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির,আবার কোথাও দিল্লীর লোটাস টেম্পল বা পন্ডিচেরীর অরোভিল। আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখি, বিস্মিত হই। এনাদের সকলের জন্যে সম্মান, পুরস্কারের ব্যবস্থা করার উদ্যোগ আয়োজক ক্লাব বা সংঘকেই নিতে হবে। থিমপূজার এই রমরমা এবং প্রতিযোগিতার পাশাপাশি থাকে ফ্ল্যাটবাড়ির পূজা বা বারোয়ারী পূজা।
বছরভর ভাবনা চিন্তা চলে আলোকসজ্জা নিয়ে। এই আলোকসজ্জার কথা আসলেই চন্দননগরের নাম উঠে আসে – জগৎজোড়া নাম। এই থিমপূজার যুগে আলোকসজ্জা যেন কথা বলে – আগেকার টুনি বাল্বের জায়গায় এখন LED বাল্বের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে পূজা প্যান্ডালগুলো। থিমের রকমারিতে তৈরী হয় প্রাগৈতিহাসিক ডাইনোসর, আমাজনের দহন, চন্দ্রযান,দ্বিশতবর্ষে বিদ্যাসাগর- বর্ণপরিচয়, ১৫০ বর্ষের জাতির জনক গান্ধীজী এমনই আরো কতো কী ! কিছু আলোকশীল্পীর নাম চন্দননগরে মুখে মুখে ঘোরে – ঁসতীনাথ দত্ত , তাঁর পরবর্তীতে শ্রীধর দাস এবং গত ২৫ বছর ধরে এই কাজে যুক্ত আলোকশিল্পী বাবু পাল। এই বাবু পালের ম্যাজিকাল লাইট পৌছে গেছেএমনকি বিগ বি এর অন্দরমহলেও। আবার এই রাজ্যেরই কোথাও আলোকসজ্জায় চোখে পড়ে ৪০ হাজার প্রদীপ বা সাবেকি লন্ঠন এবং বিশালাকারের ঝাড়বাতি।
দেবী দুর্গাকে কেন্দ্র করে আগেও যেমন নানান কাজে দক্ষ মানুষজন যুক্ত হতেন এযুগেও তাঁদের প্রয়োজনীয়তা কমেনি। উল্লেখ করা যেতে পারে ঢাকিদের কথা,ব্রাহ্মণ পুরোহিতেরা,শোলা ও ডাকের সাজের কুশলীরা,ডেকোরেটররা রয়েছেন, আর সর্বোপরী যাঁদের কথা না বললেই নয় তাঁরা হলেন দক্ষ মৃত শিল্পীরা। থিমপূজার সাথে সাথে রুচিশীল শিল্পকলার সমারোহ ঘটেছে। প্রয়োজন হয় সুদক্ষ সৃষ্টিশীল শিল্পীদের, যাঁদের মননশীল ভাবনায় থাকে আধুনিকতার ছোঁয়া।
আদি দুর্গা মূর্তির সজ্জা হলো – ডাকের সাজ। কথিত আছে – ব্রিটিশ শাসিত ভারতে জার্মানি থেকে আমদানি করা হতো রাংতা। এই বস্তুটার হাত ধরে এল ডাকের সাজের কনসেপ্ট। প্রতিমার এই সজ্জা ডাক ব্যবস্থার মাধ্যমেই আসতো। নাম হল তাই ডাকের সাজ। কৃষ্ণনগরের চকেরপাড়া, নাজিরাপাড়া, আনন্দময়ীতলা জুড়ে ডাকের সাজ তৈরি হয়। বাগদিপাড়ায় হয় শোলার সাজ। চকের পাড়ার ডাকের সাজ শিল্পী আশিস বাগচি তাঁর সাজ নিয়ে ইংল্যান্ডের কার্নিভালেও যোগ দিয়েছেন। এছাড়াও বাগদিপাড়ার শোলার সাজ শিল্পী মনোজ বাগের নাম সু প্রসিদ্ধ। ঘূর্ণির রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পী সুবীর পাল জানাচ্ছেন যে পরিবর্তনের সরকার আসার পর সবুজ রঙের চাহিদা কিছুটা বেড়েছে। এর ফলে অন্যান্য রঙে প্রতিমাকে সুন্দর করে সাজিয়ে তুলতে না পারায় একটা একঘেয়েমি আসছে।
ভারতের কলকাতা শহরেই ৬০ বছর ধরে হয়ে আসছে একটি দুর্গাপূজার আয়োজন, যেটির মূল উদ্যোগটাই নেন মুসলমানরা – কলকাতা বন্দরের কাছাকাছি মুসলমান-প্রধান খিদিরপুরের মুন্সিগঞ্জ এলাকায়। পূজার সময়ে হিন্দুদের মতোই মুসলমান, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন – সকলেই মেতে ওঠেন উৎসবে। অনেক জায়গায় পূজার উদ্যোগেও জড়িয়ে থাকেন নানা ধর্মের মানুষ, যেমনটি মুন্সিগঞ্জের এই আয়োজন।
অনেক পূজার পরিচালনা ও তা সুসম্পন্ন করার দায়িত্বে থাকেন শুধুমাত্র মহিলারা। যেমন হয় বিলাতের অসলো অঞ্চলের দুর্গাপূজা। এই পূজা সুদীর্ঘ অতীত থেকে মহিলাদের দ্বারা সংগঠিত ও পরিচালিত হয়ে আসছে। তবে সাহায্যকারী হিসেবে পুরুষেরাও কাজ ভাগ করে নেন।
কলকাতা সহ সারা রাজ্য জুড়ে গ্রাম, শহর, প্রত্যন্ত এলাকায়,ভারতবর্ষের বিভিন্ন শহরে,বিদেশে যেখানেই বাঙালীরা রয়েছেন সেখানেই দুর্গাপূজার আয়োজন হয়। দুর্গাপূজায় নজরে পড়ে বাঙালী সমাজের অর্থনৈতিক বিষয়ও। আঠারো শতকের শেষ দিকে বনেদি বাঙালী পরিবার গুলো : বেনিয়া, জমিদার, দেওয়ান এবং ব্যাবসায়ীরা বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করে দুর্গাপূজা করতেন না জেদের বৈভব প্রদর্শনের জন্যে। বিশ শতকের শুরুতেই শহুরে দুর্গাপূজার চরিত্র পাল্টে গেল। দেবী দুর্গা হয়ে উঠেছিল ভারতীয় জাতীয়তাবোধের প্রতিমূর্তি। দেবীর দেহাংশ ছড়িয়ে পড়েছিল ভারতবর্ষের নানান স্থানে। এ থেকেই স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে দেবী হলেন মাতৃভূমি স্বরূপা।
কাজেই এই পূজা , এই উৎসবে সামিল হতে না পাড়লে যেন এক শূন্যতা আসে। কালের প্রবাহে এই বিষয়টাই মনকে নাড়া দেয়।
এই শূন্যতাকে আসতে দেননা পূজার উদ্যোক্তারা – পূজার থিম নির্বাচন , প্রতিমা, প্যান্ডাল,লাইটের অর্ডার দেওয়া, চাঁদা আদায়ের মতন কঠিন কাজ – সবই করে থাকেন পূজার উদ্যোক্তারা। একটা বারোয়ারি পূজাই হোক বা ফ্ল্যাট বাড়ির পূজা বা বড়ো কোনো নামজাদা ক্লাবের বিশাল পূজাই হোক , সব পূজার খুটিনাটি সব বিষয় সুষ্ঠুভাবে যাঁরা করে থাকেন তাঁরা হলেন উদ্যোক্তা – এনারা কিন্তু আড়ালেই থেকে যান। হয়তো স্থানীয়ভাবে মানুষজন তাঁদেরকে চেনেন।
কিন্তু নিরলস পরিশ্রম করে, নিজেদের কর্মব্যস্ত জীবনের মাঝেও আমাদের সাধারন মানুষদের, ছোট ছেলে মেয়েদের মুখে এই চার/পাঁচটি দিন হাসি ফোটাতে যাঁরা আমাদের দুয়ারে আসেন চাঁদা আদায়ের রসিদ নিয়ে, তাঁদের সাথে আমরা কী সৌজন্য , ভদ্রতা দেখাই ? সামর্থ্য অনুযায়ী চাঁদা দিতেও কুন্ঠা বোধ করি। আমরা ভুলে যাই বা হয়তো ইচ্ছা করেই ভুলে যাই যে এই উদ্যোক্তারা পাড়ায় পাড়ায় না থাকলে আমাদের বাঙালীদের সর্বোচ্চ এই উৎসবে আমাদের এবং আমাদের ছেলে মেয়েদের আনন্দে সামিল হওয়া সম্ভব হতো কী ? ভেবে দেখবেন ।
পরিশেষে একটা বিষয় না বললেই নয়। সেকালে ব্যয়বহুল পূজা করতেন বনেদী পরিবারের লোকজনেরা, জমিদারেরা। আসল উদ্দেশ্য ছিলো প্রভাব প্রতিপত্তি বিস্তার করা। ব্রিটিশ শাসকদের বিশেষ মর্যাদা দিয়ে আপ্যায়ন করে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা আদায় করাই ছিলো উদ্দেশ্য। আর এখন পূজার উদ্যোক্তারা রাজনৈতিক নেতা মন্ত্রীদের পূজায় সামিল করে নিজেদের জাহির করার প্রচেষ্টা চালায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *