নিপ্পনের দেশে (৬) #শ্বেতা ব্যানার্জী

নিপ্পনের দেশে (৬)

#শ্বেতা ব্যানার্জী

মন পাটাতনে পা রেখে ইচ্ছে দৌড় আমার —

যখন ভ্রমণ কাহিনী লেখা শুরু করেছিলাম তখন ভাবিনি, আমি এইভাবে আপনাদের শুভেচ্ছা নিয়ে আপনাদেরই ঘোরাতে পারবো—
খুব ভালো লাগা কিছু সময় মনের ঘরে বন্দী না রেখে ঘষে মেজে তা’কে বাইরে নিয়ে এলাম।
প্রথমদিকে এত লাজুক ছিল, মুখ দেখিয়ে আবার ঘরে দোর দিত–
কিন্তু আপনাদের শুভেচ্ছাদূত তার ঘরে চিঠি রেখে এলো…
ভাবলাম , আনাড়ির ইতিকথাতেও ইতিহাস বোধহয় হয়!!

প্রাচ্যে এসেও দেখি প্রকৃতির পাশ্চাত্য অনুকরণ …
ওমা,তুই ও!! সে বলে না’গো আমি এইরকম,

মিঠেকড়া রোদে, বর্ষার জলেতে, তুষার পাতেতে
ঠাণ্ডা স্রোতে বেহুঁশি খেয়াল নিয়ে জাপানের কোলেতে—

বেশ, বেশ এইবার জিড়িয়ে নে, না গো, সে -জো আছে। এই যে তুষার ঝরালাম, এবার শুকিয়ে দিতে হবেনা —
তোমরা যে সেজেগুজে বসে আছো।
হ্যাঁ, আজও তুষারপাত, আমাদের বেরুনোর কথা ছিল, তবুও মন ভালো ছিল হালকা তুলোর নাচানাচি আর লাফালাফি দেখে।
যেন ওরা বলছে ধরতে পারেনা… আর একদল দৌড়াচ্ছে ধরার জন্য,সবটাই খুব বালখিল্য আচরণ মনে হচ্ছিল, আমি মুঠোতে তুষার গুড়ো ধরে বললাম, এই যে ধরেছি, ওমা হাতের মুঠোয় মধ্যে কান্না, আমি মুঠি খুলতেই লাফিয়ে আবার পেঁজা তুলো হয়ে লাফালাফি …।
আমি হেসে আর বাঁচিনা–

আজ আমরা চলেছি #টোকিও স্কাই ট্রি# এটা জাপানের # সুমিডায় অবস্থিত।
#আসাকুসা স্টেশনে নেমে যেতে হয় সুমিডায়।
তবে অনেকটা হাঁটাপথ, এখানে যানবাহনের
খুব অসুবিধা, প্রকৃতি কে সুখ দিতে এরা ধোঁয়া দূষণ থেকে দূরে থাকে, যদিও দু ‘একটা মোটরযান আছে তার ভাড়া আকাশ ছোঁয়া।

এত হাঁটা পথ, তবু কষ্টরা পথ আগলে দাঁড়ায় না।
প্রকৃতির নয়নাভিরাম সৌন্দর্য উপভোগ করতে ক্লান্তির মুখে হাসি ফোটে—
সে বলে এগিয়ে চল…।
এখানে প্রত্যেকটা রাস্তার বাঁকে আমাদের এখানকার সিভিক ভলেন্টিয়ার দের মতন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে, ওদের জাতীয় পোষাকে, প্রত্যেকটা
পথ চলতি মানুষ কে এরা মাথা নিচু করে অভিবাদন জানাচ্ছে,সাথে এক ভুবনজয়ী হাসি।
পথ চলতে চলতে কখন আমরা পৌঁছে গেছি# স্কাই ট্রি বুঝতেই পারিনি।

#স্কাই ট্রি সম্প্রচার ও পর্যবেক্ষণ টাওয়ার, ৬৩৪ মিটার উচ্চতা, ২০১১সালে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্ব্বোচ্চ স্বয়ং সম্পূর্ণ টাওয়ার হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
৬৩৪ মিটার উচ্চতার একটি মাত্র টাওয়ার যেখান থেকে পরিচালিত হচ্ছে টোকিও শহরের মোবাইল ও টেলিভিশন ট্রান্সমিশন। ২০১২ তে এই টাওয়ার পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়।
টাওয়ারের উপর থেকে টোকিও শহর স্পষ্ট দেখা যায়, উঁচু টাওয়ারের উপরে উঠে পৃথিবী দেখে মনে হ’লো মেঘের বাড়িতে আপ্যায়িত অতিথি আমরা। যেন দরজা খুলে দাঁড়িয়ে ছিল আমাদের স্বাগত জানাতে —–
“স্বপন দূয়ার খুলে এসো.…অরুণ আলোকে এসো মুগ্ধ হয়ে চোখে ”
সত্যিই স্বপ্ন দূয়ারে দাঁড়িয়ে দু’ দণ্ড মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম…. যে মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়েছিল শিরায় উপশিরায়—
আকাশের মনে কত কারসাজি তা চাক্ষুষ করলাম,
জীবনের উত্তরণ না ঘটলেও, উত্তোলনে করে যখন
এক একটা তলায় পৌঁছিয়ে যাচ্ছি
নিজেকে গুপি বাঘা মনে হচ্ছিল, কোন যাদু জুতোর ছোঁয়ায় আমি আজ#’আকাশ ধরি মুঠোয় ভরি#
এখানে প্রত্যেকদিন প্রায় ২০০০পর্যটক আসেন।।
শুধু টোকিও শহরের সৌন্দর্য উপর থেকে উপভোগ করবে বলে।
তবে দিনের অনেকটা সময় স্কুল পড়ুয়াদের জন্য বরাদ্দ থাকে, তারা শিক্ষকদের সাথে এসে প্রকৃতি ও কারিগরী বিদ্যার পাঠ নেয় এখানে।
সূর্যাস্তের দু’ ঘন্টা আগে এখানে পৌঁছাতে হয়।
এখান থেকে সূর্যাস্ত খুব সুন্দর ভাবে দেখা যায়।।
প্রচুর ভিড়ের মাঝে ডিঙি মেরে কতটা দেখলাম জানিনা, শুধু উপলব্ধি করলাম আগামীর আরও উজ্জ্বল দিনের আলো ফিরিয়ে আনার অঙ্গীকার রেখে সে বলে গেলো আসি….।
এখানে এক জায়গায় দেখলাম আইস স্কেটিং করছে অনেক, অনেকে বহুরূপী সাজছে। শীতের আমেজ নিয়ে চেনা সুর দেশে কি বিদেশে।

ফেরার পথে ইন্ডিয়ান হোটেলে আমরা খেলাম ভাত, শ্যামন মাছ, স্যালাড, আর য়োগাট,
আমাদের সামনে দেখলাম কয়েকজন জাপানি
খাচ্ছেন –স্টিকি ভাত, সামুদ্রিক কোন মাছ, নানাবিধ উপকরণে তৈরি স্যালাড, ও সস্।
আর একজন কে দেখলাম সুশি খেতে, সুশি জাপানের অতি বিখ্যাত এক খাবার। যার পৃথিবী জোড়া নাম।
আমার ছেলে বললো ওভাবে দেখোনা, আমি আড়ে
আড়ে আড়ষ্ট হয়ে দেখছি চপস্টিকের নাচ।
ছেলে বললো দেখার কী আছে আমি আর তোমার বৌমা চপস্টিক দিয়েই তো খাবো, তখন দেখো—
আহা কী অনবদ্য টুইস্ট চপস্টিকের..
যেন বলছে,” আয়ো টুইস্ট করে জিন্দেগী মে হাম”
ওদের চপস্টিকের টুইস্ট আমাদের চামচের
ক্যাটল বাজানো দিয়ে দুপুরের আহার পর্ব সেরে
উঠলাম,
ছেলে বললো “মা” সুশি বানানো দেখবে?
হ্যাংলা “মা” বললো এরা দেখাবে!!
বললো চলো দেখাবো, একটা ফুড কোর্টে নিয়ে
গেল যেখানে সুশি বানাচ্ছে—
সুশির জন্য ব্যবহার করা হয় কাঁচামাছ। এই মাছ
ধরা ও মারার পদ্ধতি আলাদা, (বিনা চাপে মাছ মারা হয়) মাছের মাথায় একটা শিক গেঁথে দিয়ে
শিরদাঁড়া দিয়ে ঢোকানো হয় একটি সরু তার।
এও একরকম সার্জারী।
ব্রেন ডেথ করে মাছ মারা হলে গুণমান বজায় থাকে, এরপর বরফ জলে রেখে এর ড্রেসিং করা হয়।
এ গল্প ছেলের মুখে শুনেছিলাম…
সুশি করার পদ্ধতি দেখলাম — সুশি ম্যাটে নোরি শিট(পাতা জাতীয় একটা জিনিস) রেখে তাতে স্টিকি ভাত, আর সরু করে কেটে রাখা টুনা বা শ্যামন মাছ দিয়ে কিক্কোমন ওদের দেশের হার্বস,
সোয়াসস পিকিলড আদা দিয়ে সেটা রোল করে মুড়ে দেওয়া হয়।
তারপর ম্যাট খুলে পিস পিস করে কেটে কাঁচাই
খাওয়া হয় জাপানের একমেবাদ্বিতীয়ম খাবার#সুশি

আমাকে বৌমা বাড়িতেই খাইয়েছিল টুনা মাছ,
শ্যামন, শ্যামন অতি অপূর্ব খেতে –.
অসাধারণ মাছ, মাছের ভিতরটা পুরো পিঙ্ক,
কোয়ায়- কোয়ায় ছাড়িয়ে আসে, কাঁটা অল্প অনেকটা ভেটকিমাছের মতন কিন্তু আস্বাদ!
রসনায় রসময়ী।
ওখান থেকে আমার চললাম টোকিও টাওয়ার দেখতে..
জাপানের শিবা-কোন জেলার অন্তর্গত টোকিও শহরে অবস্থিত পর্যবেক্ষণ টাওয়ার, আইফেল টাওয়ারের মতন গ্লাস টাওয়ার, সাদা ও কমলা রঙ করা যাতে বিমানের নিরাপত্তা আইন বজায় থাকে।
দূর থেকে প্রাচ্যের আইফেল টাওয়ার দেখলাম।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছিল চারদিকে আলোর বরণমালা সাথে টোকিও টাওয়ার নিজে যেন ঝাড় প্রদীপ হয়ে
সন্ধ্যা আরতি তে মগ্ন—
আমরা ভাবি আমরা কেন জাপান থেকে পিছিয়ে!!
আসলে ওরা শ্রমবিমুখ নয়, প্রয়োজন বোধে দেশের জন্য অতিরিক্ত শ্রমদান করবে বিনা পারিশ্রমিকে, এটা তাদের কাছে এক সাধনা।
যা আমরা ভাবতেও পারিনা।
আজ তাই এক যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ,পরমাণু বোমার আঘাত সহ্য করেও ঘুরে দাঁড়িয়েছে–
রাজভক্তি, দেশভক্তি, আর নীতিধর্ম, এই তিন
ধর্ম পালন করে।
বিদেশি শক্তির কাছে কোনদিন বশ্যতা স্বীকার করেনি–
কথিত আছে, ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মোঙ্গল সম্রাট “কুবলাই” যখন জাপান দখল নিতে আসেন,তখন জাপানিরাই নিজেরা নিজেদের আত্মাহুতি দিয়ে এক
এক ঝড় সৃষ্টি করেছিলেন…
এক ঝাঁক ছোট ছোট বিমান নিয়ে পাইলটরা সোজা উড়ে গিয়ে শত্রুঘাঁটি জ্বালিয়ে দিত,আর নিজেরাও
ধ্বংস হ’তো।
এই ঝড় কে জাপানিরা সম্মান জানিয়ে নাম দিয়েছিলেন #দৈবঝড়, জাপানি ভাষায় #কামিকাঝি( kami kazi)।
এতটাই দেশভক্তি, তারা চাইতো সম্রাটকে যেন কোনভাবেই অপমানিত করা না হয়।

#রুসো’র একটি উদ্ধৃতি আছে ” মানুষ জন্মায় স্বাধীন হয়ে , কিন্তু সর্বত্র সে শৃঙখলিত”
সত্যিই মানুষ নিজেই নিজের কাছে পরাধীন।
নাহলে এত হানাহানি, এত দেশভাগ, এত যুদ্ধ!!
তাহলে কোন মুখে সে ভালোবাসার কথা উগরায়!!

অনেক অনাবশ্যক প্রশ্ন মাথায় নিয়ে বাসার পথে পা বাড়ালাম…

ক্রমশ —-

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *