#সাতকোশিয়া সাতমহলে — তুলি মুখার্জি চক্রবর্তী

#সাতকোশিয়া সাতমহলে
তুলি মুখার্জি চক্রবর্তী

শহর থেকে আরও অনেক দূরে…. সাতকোশিয়া এলাম ঘুরে…..

পূর্ব পরিকল্পনা মত রাতের পুরী এক্সপ্রেসে চেপে আঁধার থাকতেই পৌঁছে গেলাম ভুবনেশ্বর। খুব চেনা স্টেশন তবু কেমন অচেনা লাগছিল। গতবছর থেকে অতিমারী করোনা আর লকডাউনে সব যেন কেমন এলোমেলো। চলতে ফিরতে ঘুরতে খেতে কথা বলতে কাছে যতে….. একটা আতংক জাপটে আছে মনে হচ্ছে সবসময়। লকডাউন উঠতেই প্রকৃতির মুক্ত অঙ্গনে মন আর চোখ মেলে ধরতে পাঁচজনের একটা ছোট্ট দল এসেছি। ট্রেন থেকে নেমে অপেক্ষা আমাদের সারথী আর মোটরযানের। সেও কলকাতা থেকে ঠিক করে আসা। আলো ফোটার আগেই এসে গেল সে। লটববহর সমেত চড়ে বসলাম ঠান্ডা ঠান্ডা মোটরগাড়িতে। ঝাঁ চকচকে রাস্তা ধরে ছুটে চলেছে গাড়ি। পেছনে চলে যাচ্ছে শহর। সূর্য রক্তিম হবার আগেই পাহাড় জঙ্গলের বুক চেরা পথে গাড়ি। ঘুমে ঢলে পড়েছি আমরা দুজনে। বেডরোল বন্ধ তাই রাতের ঘুম ঠিক হয় নি আর মসৃণ রাস্তায় দুলনিহীন চলমান গাড়ি ঘুম পাড়ানি মাসি পিসি ….

ঘুম ভাঙল গাড়ি থেমে যেতে। রিসোর্টে ঢোকার প্রথম গেটে থামিতে হল ভিতরে ঢোকার অনুমতিপত্র এবং রিসোর্টে থাকা খাওয়া ঘোরার যে প্যাকেজ বুকিং তার পরচা দেখানোর জন্য। সব দেখে সন্তুষ্ট হবার পর পেলাম ছাড়া। সবুজ সবুজ আর সবুজের মধ্যে দিয়ে গাড়ি ছুটে চলল বাঁ দিকে ছোট ছোট পাহাড় আর ডানদিকে পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে মহানদীর সাথে লুকোচুরি খেলতে খেলতে। এই দেখি সে খুব কাছে, আবার উধাও। আবার দূর থেকে উঁকি দিচ্ছে এক গা রূপোর গহনা পড়ে। পাক্কা সাড়ে তিনঘন্টা ভুবনেশ্বর থেকে গাড়ির জার্নি করে অবশেষে পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে।


এখানে আবার গেট আবার চেকিং। সুন্দর ইকো ফ্রেন্ডলি অফিস ঘর। সেখানে বসেই সব কাজ সেরে এবার অপেক্ষা। বারোটার আগে ঢোকা যাবে না কটেজে। এখানে সময় এরম ই। আড়াই ঘণ্টা বসতে হবে। লটববহর নামিয়ে পাইলট চলে গেছে ভুবনেশ্বর। তিনদিন পর ভোরেই আসবে আমাদের নিতে। কলকাতার অভ্যাসে চায়ের খোঁজ করতেই সবাই হাসতে লাগল। এখানে কিচ্ছু পাওয়া যাবে না ওদের সময়ের বাইরে। রাস্তার পাশে চায়ের দোকান তো দূরের কথা মানুষের দেখা পাওয়া ভার। বসার জন্য যে ঘরটা দিয়েছিল ওটা বর্ষার ব্রেকফাস্ট লাঞ্চ ডিনার রুম। ধুলি ধুসরিত চেহারা দেখেই মালুম যে এখানে অনেক দিন কেউ ঢোকেনি। আমাদের সবচেয়ে ছোট সদস্যার অনলাইন পরীক্ষার সময় হয়ে গেছে। সে একদিকে বসে চুপচাপ পরীক্ষা দিতে লাগল আর আমরা বাইরেটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। যতক্ষণ কটেজ না পাওয়া যায় ফ্রেশ হবার উপায় নেই।

অনেকটা জায়গা নিয়ে এই রিসোর্ট। বছর পাঁচেক আগে চালু হয়েছে। নির্জন নিরিবিলি, গাছেদের ফিসফাস। তার মাঝেই তৈরি করা হয়েছে ক্যানোপি। বেশ লম্বা আর অনেক সিঁড়ি ভেঙে ওঠা। ঘুরে নিলাম এক চক্কর। একপাশে কাঠের দোলনা। তাতেও দুলে নিলাম খানিক। পাশেই গোয়ালঘরের মতো গোবর লেপা বিরাট একটা ঘর। উপরে খড়ের ছাউনি। তার মধ্যে গরু নয় থরে থরে সাজানো অজস্র আধুনিক সাইকেল। যেটা খুশি নিয়ে যতদূর ইচ্ছে ঘুরতে পারে এখানের বোর্ডাররা। আলাদা অনুমতির দরকার নেই।
কর্মচারী সবাই খুব কম বয়সী ছেলে। এদিক ওদিক দৌঁড়াদৌঁড়ি করছে। কিছু মহিলাও আছে। সবাই হাসিমুখে। স্থানীয় মানুষ। গ্রাম্য সরলতাটুকু জড়িয়ে আছে চেহারায়, ব্যবহারে।

বারোটা বাজে। ঘর তৈরি। একটা ছোট্ট পাহাড়ের উপর তিনটে কটেজ। একদম উপরের দুটো কটেজে আমাদের। নীচে থেকে দেখেই আঁতকে উঠি। একবার উঠলে আর নামতেই পারব?? তারপর জুমচাষের মতো ধাপ কাটা। সেও ঝুরো মাটি নুড়ি পাথরের। একবার পা ফস্কালে আর দেখতে হবে না….. এক পা উঠি আর ওপরে দেখি, এই করতে করতে উঠেই এলাম সেই বিলাসবহুল ঘরে। তবে দুটো বাঁধানো সিঁড়ি আছে। একটা সোজা আর একটা ঘুরে ঘুরে।

এখানে প্রয়োজনীয় সবকিছু অত্যাধুনিক। নদী পাহাড় জঙ্গল আর ঐ আদিবাসী মানুষের মাঝে যা ভীষণ ভাবে মিসম্যাচ বা বেখাপ্পা। কিন্তু শহরের মানুষের যাতে অসুবিধা না হয় সেদিকেই ওড়িশা সরকার নজর রেখেছেন খুব।
চলবে…..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *