চলো যাই অরণ্য নির্জনতায় বেতলার জঙ্গলে —- কোয়েলী ঘোষ

চলো যাই অরণ্য নির্জনতায়
বেতলার জঙ্গলে

কোয়েলী ঘোষ

গভীর ঘন সবুজ অরণ্য । সূর্য অস্ত গেছে শাল , মহুয়া পলাশের জঙ্গলে । রাত্রি নেমেছে ।
জিপ চলেছে অরণ্যের গভীরে । মাঝে লাল মাটির রাস্তা চলেছে , বাতাসে মহুয়ার গন্ধ ।
সামনে ড্রাইভার সাহেব আর তাঁর পাশে এক গাইড আর বাবা তিনজন বসে আছেন । পিছনে আপাদমস্তক শীত চাদরে মুড়ে গুটিসুটি হয়ে বসে আছি পাঁচ ভাইবোন আর মা । বেতলার এই জঙ্গল সফরে মুখ বন্ধ ,সবার চোখ উদগ্রীব হয়ে আছে ।
গাড়ি চলেছে খুব ধীর গতিতে । কোন আওয়াজ নেই । শুধু সামনে দুটো হেড আলোয় দেখতে পাচ্ছি দুধারে ঘন জঙ্গল ।
এ এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা । গাইড মাঝে মাঝে সার্চলাইট জ্বালিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে — দেখিয়ে সাব , শজারু , সম্বর । আলো চোখে পড়ার সাথে সাথে ওরা স্থির । এক ঝাঁক চিতল হরিণ লাফিয়ে রাস্তা পেরিয়ে যাচ্ছে ।


পাহাড়ি শিয়াল , বনবিড়াল , দুদিকে শিং বেঁকিয়ে বাইসন , দেখতে দেখতে এগিয়ে যাচ্ছি ।
হঠাৎ ডাল ভাঙার আওয়াজ । আলো নিভিয়ে গাড়ি দাঁড়িয়ে গেছে । এক পাল হাতি মড়মড় শব্দে গাছের ডাল ভাঙছে । গাড়ি আর এগোবে না । দুলকি চালে হাতির পাল চলে গেছে । গাড়ি আবার এগোচ্ছে । একটা জলাশয় । এখানে বাঘ জল খেতে আসে ।
কালো ভালুক , নীলগাই , ময়ূর আরো কত কিছু দেখা হল । ড্রাইভার সাহেব বললেন , আরো গভীরে চিতা বাঘও আছে । ওরা অবাধে ঘুরে বেড়ায় বেতলা জাতীয় উদ্যানে ।
জঙ্গল সফর শেষ হল । ফিরে এসেছি জঙ্গলের পাশের এক গেস্ট হাউসে ।
এই জঙ্গল সফর হাতির পিঠে চড়েও করা যায় ।

রাতে মস্ত বড় চাঁদ উঠেছে আকাশে । গাছের পাতায় পাতায় জোৎস্না ছোঁয়া । বারান্দায় বসে বসে দেখছি প্রকৃতির এই স্বর্গ রাজ্য ।
তারপর খাওয়া দাওয়া সেরে গেস্ট হাউসে শুয়ে পড়েছি কিন্তু ঘুম নেই । গভীর জঙ্গল থেকে কত জন্তুর গর্জন ভেসে আসছে ।
কিচিরমিচির পাখির ডাকে জঙ্গলের ঘুম ভেঙেছে ।এখানে এলে মনে পড়ে সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা পালামৌ ভ্রমণকাহিনীর সেই আদিবাসী কোল রমণীদের কথা । তিনি লিখেছিলেন —
”বন্যেরা বনে সুন্দর ,শিশুরা মাতৃক্রোড়ে ।”
মনে পড়ে সত্যজিৎ রায়ের চলচিত্র “অরণ্যের দিনরাত্রি ” । মনে পড়বে বুদ্ধদেব গুহর উপন্যাসের কথা । এই গহীন অরণ্য , বুনোফুল, কত চেনা অচেনা নাম না জানা পাখি ,নারী এই পটভূমিতে কেমন নিপুণতার সাথে তিনি মিশিয়ে দিয়েছেন ।

আশেপাশে দেখার জন্য আছে প্রাচীন এক দুর্গ , ইতিহাসের সাক্ষ্য নিয়ে প্রায় ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে ।
পদ্মফুলে ঢাকা কমলদহ লেক , যেখানে হাতিরা স্নান করতে আসে ।

দেখা হল সেই ক্ষীণকটি কোয়েল নদীটির সাথে । সকালের আলোয় ঝিলমিল করে ওঠে তার রূপ । বর্ষা এলেই এ নদী উচ্ছ্বসিত ।চারিদিকে ঘিরে আছে অরণ্য , পাহাড় । কোয়েল নদীটি চলেছে তাদের ছুঁয়ে ছুঁয়ে … কোয়েল আর আউরাঙ্গ। নদীর সঙ্গম আরো এক দ্রষ্টব্য স্থান ।
আমরা জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসছি । কিন্তু মনক্যামেরায় তুলে নিয়েছি ছোট ছোট চিত্র । এই লাতেহার জঙ্গল , হুলুক পাহাড় , হাতির পাল , লাফিয়ে চলা হরিণ আর এই জঙ্গলের মানুষের আতিথেয়তা আর আন্তরিকতা ।
ভালো থেকো শাল মহুলের জঙ্গল , ভালো থেকো আদিবাসী মানুষ স্বজন ।
————–

ডালটনগঞ্জ থেকে বা রাঁচি থেকে গাড়ি ভাড়া করে আসা যায় বেতলা জঙ্গল । হাওড়া থেকে রাঁচি যাবার অনেক ট্রেন আছে ।
দমদম থেকে রাঁচি বিমানে পৌঁছে যাওয়া যায় ।
জুলাই , আগস্ট , সেপ্টেম্বর তিন মাস অরণ্য বন্ধ থাকে । বাকি সবসময় খোলা ।
জঙ্গল সাফারি হয় সকাল আর বিকেল । প্রবেশের জন্য টিকিট লাগে ।
এখানে থাকার জন্য ঝাড়খণ্ড ট্যুরিজমের বাংলো আছে । ট্রি হাউস বা গাছ বাড়িও ভাড়া পাওয়া যায় তবে বুকিং আগে করে যেতে হবে ।

ছবি ঋণ -শঙ্খ সান্যাল ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *