“সা মা জি ক চু ক্তি” —— মালা মুখোপাধ্যায়

## ” S o c i a l C o n t r a c t “

“সা মা জি ক চু ক্তি”

মালা মুখোপাধ্যায়

–হ্যালো,হ্যালো,হ্যাঁ, আমি বলছি, তোমার মিলি বলছি, কেমন আছো? কি? এতো আস্তে কেন? কি হয়েছে? কোনো ব্যাপারে আপসেট?
ও হো,একটু খুলে বলবে তো? প্রেসার মেপেছো? পাশের বাড়ির কাকুকে কি একটা ফোন করব? বলি, আমার কাছে থাকো, কিছুতেই থাকো না, আমি তোমার একমাত্র মেয়ে, আমি ছাড়া তোমার আর কে আছে শুনি? আমাকেই তো তোমাকে দেখতে হবে মা, উঃ,এমন কথা বলো না তো তুমি, সুমন খুব ভালো ছেলে মা, তোমাকে নিজের মায়ের মতো ভালোবাসে,তাও তুমি বলবে ,জামাইবাড়ি গিয়ে থাকা ঠিক হবে না, আচ্ছা আমি ছেলে হলে তো দিব্যি আসতে, তখন তো তোমার কিছুই মনে হত না? পাল্টাও ,পাল্টাও মা, নিজেকে এখনকার মতো তৈরি করো, তুমি কত লেখাপড়া জানা মানুষ, তোমার তো সমাজের প্রতি একটা দায় আছে, তুমিও যদি সেকেলে চিন্তা করো,আর পাঁচজনে কি শিখবে বলো? কি বললে? আমাকে অত ভাবতে হবে না? না ভাবলে চলে? আছি কত দূরে।হুট করে তো আর এই দিল্লী থেকে তোমার কাছে যেতে পারব না। এখানে এলে , আমার চোখের সামনে থাকলে আমি চিন্তামুক্ত হতাম।

হাসছ যে বড়! তোমার কাছে বোলপুর অনেক ভালো, আশপাশের এলাকায় একটু বাংলা বলে শান্তিতে আছো, আচ্ছা তা না হয় বুঝলাম, নিজের জায়গায় খুব শান্তিতে আছো। আজকাল ফেসবুকে কবিতা লিখছ, কবিতা লিখে প্রাইজ পাচ্ছো, খুব খুশির খবর,তা আজ কেন তুমি অত মনমরা? তোমার ছবিটা তো ফাটাফাটি, দারুণ পোস্ট করেছো, বাড়ির পিছনে টগর ফুলের ডাল ধরে সুন্দর পোজ দিয়ে ছবিটা তুলেছো। একদম নায়িকা নায়িকা,কত লাইক,কত কমেন্ট,সব দেখছিলাম, তুমি রেসপন্স করো, আমি তাই তো খবর নিচ্ছি তোমার ,কি হলো? কি বলছো? আমি মেয়ে, নিজের মেয়ে ,তাই বাড়িয়ে বলছি? মোটেই ভালো ওঠে নি ?

কী যে বলো!
তোমার এই ৬৬ বছর বয়সে নিজে নিজে ছবি তুলে যে ফেসবুকে পোস্ট করছো,সেটা কি কম কথা?
কি বলছো? ফেসবুক বন্ধু তোমার ৩০০০ আর লাইক মোটে ৩০? তারজন্য খারাপ লাগছে তোমার?
ফেসবুক একটা ভার্চুয়াল জগৎ, এই সব ব্যাপারে একদম মাথা ঘামাবে না।
কি? কি বলছো? তুমি সকলকে লাইক দাও, তাদের লেখা পড়ো,তারা তোমাকে ধন্যবাদ, ভালোবাসা টালোবাসা দেয়,অথচ তোমার লেখাতে, তোমার পোস্টে লাইক দেয় না?

কাম অন মম্, টেক ইট ইজি, তুমি আমার মা,ছোটোতে আমি মনখারাপ করলে তুমি কত বোঝাতে,মনে নেই? বন্ধুদের সঙ্গে ঝগড়া হলে,পড়া না করে বসে থাকলে, তুমি ,তুমিই তো আমার মন ভালো করে দিয়ে, হাসি তে ঘর ভরিয়ে তুলতে?

মনে আছে মা? বাবার সামান্য ফটোগ্রাফির ব্যবসা, দোকান থেকে ফিরে এসে মা মেয়ের হাসি দেখে কি বলতেন? আমার খুব মনে পড়ে মা —,বাবা একটু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা মানুষ তো,নরম নরম গলায় বলতেন,কি ব্যাপার ? মা মেয়ে তে আজ এতো হাসি?
খুব মন খারাপ করে বাবার জন্য। এখন তো আর দোকান থেকে ক্যাডবেরি কিনে কেউ বাবার মতো আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় না মা, বড্ডো অল্প বয়সে চলে গেলেন। হঠাৎ স্ট্রোকে। আমরা জানতেও পারলাম না। কি বিপদের মধ্যে যে আমরা মা মেয়েতে পড়ে গেলাম। তুমি কিন্তু হাল ছাড়ো নি,বাবার ব্যবসাটা ধরে নিলে, আমাকে পড়ালে, তুমি তো আমার সাহসী মা, এবার একটু হাসো মা। প্লিজ। কি বলছো? কিছু কথা বলতে চাও,মানে শেয়ার করতে চাও? হ্যাঁ , হ্যাঁ, বলো মা, আমি শুনছি, না না আমার সময় নষ্ট হচ্ছে না। সময় নষ্ট আবার কি? মায়ের সঙ্গে কথা বললে তোমার মেয়ের সময় নষ্ট হবে,এটা ভাবছ তুমি? তাহলে তো তোমার মেয়েকে তুমি ঠিক মতো মানুষ করতে পারো নি? আমার সংসার, আমার অফিস, আমার ছেলের স্কুল, আমার স্বামীর অফিস ,সব,এই সব কিছু থাকলেও তোমার জন্য আমার সময় সবসময় আছে।

তুমি কে বলো তো? তুমি হচ্ছো আমার মা। এখন আমিও মা। মা যে কী ! এখন খুব বুঝি।

সে যাই হোক ,আগে তোমার কথাটা শুনি,বলো বলো,হ্যাঁ,তার আগে বলো, প্রেসারের ওষুধটা ঠিক ঠিক খেয়েছো?
আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে, আমি একমাস পরেই যাবো, তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। ও হ্যাঁ, ভালো কথা,একটা আর্জেন্ট কথা, তুমি কোভিসিল্ড বা কোভ্যাক্সিন-১৯ এই সামনের সপ্তাহে গিয়ে নিয়ে আসবে, না না ভয় পাবে না, কিছু হবে না, আমার কাছে খবর আছে,মানে আমি খবর নিয়ে দেখেছি, অনলাইনে দেখেছি,কিছু কিছু জনের জ্বর আসছে,একটা ক্যালপল খেলেই হবে,আর অনেকের কিছুই হচ্ছে না, অহেতুক আতঙ্কে থাকবে না, আমি ফোন করে আমাদের ডাক্তার কাকুকে একবার তোমাকে দেখে আসতে বলব।

কি বলছো? বলতে হবে না? এখুনি টাকা লাগবে শুধু শুধু ? মা –, একদম চুপ, আমি তোমার মেয়ে মিলি, মা–, তুমি লেখাপড়া শিখিয়ে চাকরি করতে শিখিয়েছো,আর আমি টাকা দেবো না? আমার উপার্জনের টাকা তো তোমার টাকা, তুমি তো আর পরাধীন করে অন্যের ঘাড়ে ,আর পাঁচজনের মতো আমাকে ঝুলিয়ে দাও নি,কি বলছো? ঝুলিয়ে দেওয়া কথাটা খুব খারাপ? হা হা হা হা,মা —,যার নাম চালভাজা তার নাম মুড়ি,ঐ একই হলো।

কি? কি বলছো?একটু তফাৎ আছে? চালভাজা শক্ত,আর মুড়ি নরম? তাই কথাতে শালিনতা চায়, আচ্ছা আচ্ছা , এবার একটু নরম নরম ভালো ভাষাতেই ভালোবাসার কথা বলি, দেখো সেই আঠারো শতকে ফরাসি দার্শনিক রুশো বলে গেছেন,বলে গেছেন মানে সে অনেক অনেক গল্প আছে তোমাকে একদিন বলব,তিনিই তো সোস্যাল কন্ট্রাক্ট নিয়ে কত কি লিখেছেন,তার মধ্যে এটাও বলেছেন, এই যে সংসার নিয়ে,সব কিন্তু সোস্যাল কন্ট্রাক্টের মধ্যে পড়ে, সামাজিক চুক্তি, তুমি ভাবো মা —, সেই কত বছর আগে, উনি,সাম্য, মৈত্র,আর স্বাধীনতার কথা বলে গেছেন,ভাবলে এক একসময় চোখ দিয়ে জল চলে আসে,জন্মের সময় ওঁনার মা মারা যান,আর ওঁনার ১০ বছর বয়সে, মাত্র ১০ বছর বয়সে বাবা ফেলে দিয়ে পালিয়ে যায়,দেশটা ফরাসি মা —,কত কষ্ট করে লেখাপড়া শিখে কত বড় দার্শনিক তিনি, একবার কল্পনা করো মা — ,ফরাসি বিপ্লবের জনক জ্যাঁ জ্যাক রুশো( 1712-1778)
মাত্র ৬৬ বছর বেঁচে ছিলেন। অনেক অনেক বই লিখেছেন, আমি সময় করে তোমার জন্য কিছু বই নিয়ে যাবো, তুমি পড়বে।

এ্যাঁ ? কি বলছো, তোমার কথাটা বলার সুযোগ পাচ্ছো না? শুধু আমিই বলে যাচ্ছি, না না ঠিক আছে, এবার তুমি বলো, আমি বুঝতে পারছি, তোমার পেটটা গুড় গুড় করছে, আমাকে বলার জন্য, তোমার পেট ফুলে ফেঁপে উঠছে, আমাকে না বলে থাকতে পারছো না? তা তো হবেই,যার মেয়ে এমন বকবক করতে পারে,তার মা কি কিছু কম যায় নাকি? মনে আছে মা, তুমি বাড়িতে , সেই ছোটোতে আমার সঙ্গে কতকগুলো বাচ্চাকেও পড়াতে ,কি বকবক করতে, কত নামতা বার বার বলে বলে মুখস্থ করিয়েছো,একটু ভুল হলে,ছপাৎ করে ছড়ির মার হাতের তালুতে, এখন তোমার ঐ ছড়ির মার, খুব মিস করি জানো মা?

আবার আবার সেই ছোট্ট হয়ে যেতে ইচ্ছে করে, তোমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুম,কোনো ভয় নেই। তুমি না থাকলে , তোমাকে না পেলে মনে হতো,ভূতেরা সব দল বেঁধে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে,দেবে আমার গলা টিপে, আমি চোখ বুঁজে বিড়বিড় করে বলে যেতাম,রাম রাম রাম রাম রাম—-

এই দ্যাখো কোন কথা থেকে কোথায় চলে গেলাম, শোনো টিকা নিতে গেলে, শুধু আধার কার্ড আর তোমার ফোন নং এই দুটো লাগবে,মনে করে নিয়ে যাবে, আমি অবশ্য,হ্যাঁ,কি বলছো? এই ক’দিনে তার মাঝে আমি লক্ষবার ফোন করবো,তা ঠিক বলেছো,বাবা নেই, থাকার মধ্যে তো তুমি, তুমি চলে কি হবে মা–! আমি ভাবতে পারি না, আমি তোমাকে হারাতে চাই না, হ্যাঁ,হ্যাঁ,বলো বলো,কি বলবে বলছিলে? আর বলবে না বলছো,মুড চলে গেছে? প্লিজ , আমার সোনা মেয়ে,প্লিজ —-,

কি? তোমার যে সব বন্ধু কোনো কমেন্ট করে না, তাদের বাদ দিয়ে দেবে? কি? কেউ কেউ বলে,দেখি তো,বাট লাইক দি না, আবার কেউ কেউ দেখেই না,তাই আনফ্রেন্ড করে দিতে চাইছো?

দাঁড়াও একটু ভাবি, হুঁ—, শোনো, তুমি তো আর তাদের রিকোয়েস্ট পাঠাও নি,আর যদি পাঠিয়েই থাকো,তাতেও কিছু যায় আসে না। ফেসবুক একটা বড় প্লাটফর্ম। সোস্যাল মিডিয়া, সেখানে নিজের নিজের ওয়ালে নিজের মতো করে সবার পোস্ট করার অধিকার আছে। তুমিও পোস্ট করবে। তাতে তোমাকে কেউ লাইক দিল কি দিল না, এই নিয়ে ভাববে না, তোমার যাকে মনে হবে দেবে,এতো এই ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দিয়ে নিজের মন খারাপ করার কোনো মানে হয় না।

সবাই মানুষ। কেউ দেবতা নয়। কেউ সেলিব্রেটি নয়,তারা নিয়ে যাক,যাক তোমার লাইক, তুমি আশা করো না, তোমার স্বাধীনতাকে সম্মান দাও,ভালোলাগে না তাই দেয় না।
ও হো, তুমি যথেষ্ট ভালো লেখো, একজন ৬৬ বছরের বৃদ্ধা এই বয়সে এসে যে ফোনে স্বাধীন ভাবে নিজের মতো করে নিজের মতামত প্রকাশ করার একটা জায়গা পেয়েছেন,যিনি অসংস্কৃত, রুচিহীন বেশিরভাগ টিভি সিরিয়াল না দেখে,পাড়া প্রতিবেশীর সঙ্গে পরনিন্দা পরচর্চা না করে, ফোনে আত্মীয় স্বজনদের মধ্যেও এর নামে তার নামে কিছু নিন্দা বান্দা না করে, এই ফেসবুকে একটা দুটো কবিতা লেখা, একটা নিজের ছবি,একটা হয়তো নিজের লাগানো গাছের ছবি পোস্ট করেন,তাতে যদি কেউ একটা লাইক দিয়ে উৎসাহিত না করেন, করবেন না, কোনো রকম পাত্তা দেবে না।

কি বললে? তারা দিব্যি লাইকের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে, না দিলে , ইনবক্সে লিঙ্ক দিয়ে দেয় লাইক দেওয়ার জন্য ?
তাই? তুমি ইচ্ছে হলে লাইক দেবে, ইচ্ছে না হলে দেবে না,ভালোলাগলে দেবে,না ভালোলাগলে দেবে না। এই নিয়ে নিজের লেখা , নিজের হাতে তোলা ছবি পোস্ট দেওয়া বন্ধ করবে না। আমার কি মনে হয় জানো মা —?

রক্তের গ্রুপ যেমন চারভাগে ভাগ, মানুষের স্বভাব সেই রকম,কেউ O গ্রুপ,কেউ A B, A ,B ,
পজেটিভ নেগেটিভ বাদ দিয়েই বলছি,কেউ দিয়েই যায়,কেউ আবার নিয়েই যায়,দিতে জানে না।

মা– ,মন ভালো করে একটা সুন্দর ফুলের ছবি পোস্ট করো, শুভ সন্ধ্যা জানিয়ে। আমি এবার রাখব,আর হ্যাঁ,রাখার আগে এই কথাটা বলে নি,
মনে রেখো, এই করোনার সময় সোস্যাল কন্ট্যাক্ট বন্ধ হয়েছে, কিন্তু সোস্যাল মিডিয়া ফেসবুকে সোস্যাল কন্ট্রাক্ট বলে একটা লিখিত এবং কিছু অলিখিত কন্ট্রাক্ট আছে, যাকে সামাজিক চুক্তি বলা হয়,আর যারা মানুষ তাদের 💓 হৃদয়েও আছে। জেনে রেখো থাকবেই।

তাঁরা শুধু তোমার লাইক , কমেন্ট নেবেন না, তোমাকে রীতিমত উৎসাহিত করে লাইক কমেন্ট দেবেন।
তুমি শুধু তোমার ব্যক্তি স্বাধীনতাকে
সম্মান দেবে। ভালো থেকো মা—,
আমি তোমার মেয়ে মিলি বলছি, ভালো থেকো মা—-.

মালা মুখোপাধ্যায়

১৩.৪.২০২১.
৭-১৩ পি.এম.
@ স্বত্ব সংরক্ষিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *