রিপোর্টিং ।। শম্পা দেবনাথ ।।

* রবিবারের গল্প *
রিপোর্টিং
।। শম্পা দেবনাথ ।।
ক্যামেরাম্যান আলোক সবকিছু ঠিক আছে কিনা দেখে নিচ্ছে আর বিড়বিড় করছে। বোঝা যাচ্ছে ভীষন বিরক্ত। কাল খুব ভোরে আমাকে আর আলোককে ফিল্ডে যেতে হবে। বস বলেছে ” জয়জিৎ বেটা , যতটা পার নীচে নেমে যাবে , অসহায় মানুষের মুখ কভার করবে। তাদের কষ্টের কথা বলতে বলবে। এমন ভাবে লোকাল মানুষদের ইন্টারভিউ নেবে যাতে দর্শকদের চোখ দিয়ে যেন জল বেরিয়ে আসে। জোরে , চেঁচিয়ে, হাঁপিয়ে , গলা কাঁপিয়ে, জলে ডুবে তোমার মতামত জানাতে থাকবে। গরম গরম পরিবেশন যাকে বলে। কুকুর , বেড়াল, গরু কাউকেই ছাড়বে না। পারলে তাদেরও জিজ্ঞাসা করবে, এই পরিস্থিতিতে তাদের কেমন লাগছে। ওরা কথা বলতে না পারুক, ঘেউঘেউ, হাম্বা হাম্বা তো করবেই। এখানেই তো এক স্মার্ট সাংবাদিকদের ক্যারিশ্মা। নিজের অন্তরের আবেগ থেকে অসহায় প্রাণীদের ভাষা বুঝে চ্যানেলকে রিপোর্ট করবে। তুমিই পারবে । আমাদের চ্যানেলের ইজ্জত তোমার হাতে। যাও জওয়ান , এগিয়ে যাও। কাল খুব ভোরেই বেরিয়ে পড়। ” বসের হাতের থাবড়ায় প্রায় ছিটকে বেরিয়ে পড়লাম।
জলটা ক্রমশঃ বাড়ছে। কি হবে কে জানে! নিজের ওপর ভীষন রাগ হচ্ছে। কী দরকার ছিল প্রমোশনের। বেশ তো তাঁত বুনে খাচ্ছিলাম। অত কাজ দেখানোর দরকার ছিল কী ? এখন যত বেদম বেমক্বা জায়গা হলেই বস পিঠ চাপড়িয়ে বলছে, ” যাও বেটা, কভার কর। ” এমন চলতে চলতে একদিন নিজে প্লাস্টিকে কভার হয়ে ধাপার মাঠে চলে যাব।
ওদিকে সবেধন একমাত্র বৌ প্রিয়া যে কিনা বেশ নাক উঁচিয়ে বলত, ” আমার স্বামী জার্নালিস্ট ” , সে এখন দিনরাত কথা শোনায়। ” বৌকে কোথাও ঘুরতে নিয়ে যেতে পার না , নিজে বন-জঙ্গল এমনকি লোকের বাড়ি- ঘরে ঢুকে বসে যাচ্ছ। কত ভালো ভালো প্রোপজাল ছিল। হায় হায়, কি কুক্ষণে যে… ”
কী করে বোঝাই , থাক্। এখন যশ বা ইয়াসের তান্ডব দেখি বরং।
নদী বেশ ফুলে ফেঁপে উঠেছে। সীমানা অতিক্রম করে এগিয়ে গেছে অনেকটা। কালো আকাশ গর্জনে বর্ষণে চারিধার ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে। তুমুল বৃষ্টিতে সামনের মানুষকেও আবছা লাগছে। একটা টর্চ ধরে আমি এগিয়ে যাচ্ছি। পিছনে ক্যামেরাম্যান অলোক। বুক সমান জলে দাঁড়িয়ে আমি ক্যামেরার দিকে ঘুরে গেলাম। গায়ের উইন্ডচিটারটা বেলুনের মত ফুলে উঠেছে। প্রবল হাওয়া। আমি গলা কাঁপিয়ে , শরীরের সমস্ত শক্তি একত্র করে রিপোর্টিং করে যাচ্ছি।
” দেখুন দর্শকবৃন্দ , নদীর জল কোন স্তরে উঠে গেছে। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি , তার কয়েক হাত দূরে বাজার , দোকান , ছিল। সব ডুবে গেছে। কাছেই একটা তালগাছ ছিল। এখন সেটাও দেখা যাচ্ছে না। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন , একপায়ে দাঁড়িয়ে/ সব গাছ ছাড়িয়ে/ উঁকি মারে আকাশে .. কিন্তু এই মুহূর্তে সে দাঁড়াতে পারে নি। মাটিতে শুয়ে পড়েছে। আমরা অনেক গভীরে চলে এসেছি ইয়াসের তান্ডবলীলা দেখানোর জন্য। আমরাই একমাত্র চ্যানেল যারা প্রাণ তুচ্ছ করে গলা জলে দাঁড়িয়ে আপনাদের প্রতিটি সেকেন্ডের খবর জানিয়ে যাচ্ছি। প্রবল ঝড় আমাকে উড়িয়ে নেবে মনে হচ্ছে। কিন্তু আপনাদের কাছে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ । একমাত্র, হ্যাঁ শুধু একমাত্র আমাদের কাছেই আপনারা এই মুহূর্তের টাটকা গরম গরম খবর পাবেন । দেখুন …” অলোক কিছু বলছে হাত নেড়ে , কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম না।
হঠাৎ একটা প্রবল ঢেউ এল। টাল সামলাতে পারলাম না। বুঝে উঠতে না উঠতেই তলিয়ে যেতে থাকলাম।
কোনো কিছু ধরার মত নেই। চারিপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। তবে কি আজই আমার শেষ দিন। কাল খবরের কাগজে শহীদ জয়জিৎ এর ছবি বেরোবে। প্রিয়া আমার ভালো ছবিটা যেন দেয়। কত লোক দেখবে। এত জলের তোড়ে সাঁতার কেটে লাভ নেই দেখে শরীর ভাসিয়ে দিলাম। চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। প্রিয়ার সুন্দর মুখটা বন্ধ চোখেই ফুটে উঠল।
বোধহয় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। কারা যেন কথা বলছে। চোখ খুলতেই দেখি , সামনে উত্তাল জলরাশি ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়ছে। নীল সমুদ্র। আমি কী ভাসতে ভাসতে মলদ্বীপে চলে এলাম ? ইস্, বৌটাকে নিয়ে এলে কত ভালো হতো। সারা গায়ে বালুকণা মেখে আমি চিৎপাত হয়ে শুয়ে। উঠে বসে একটু ঠাহর হতেই দেখি, দুহাত দূরত্বেই এক মৎসকন্যা, একটা ডলফিন ও একটা তিমি নিজেদের মধ্যে কিছু আলোচনা করছে। বেশ উত্তেজিত তিনজন। আমাকে উঠে বসতে দেখেই সব কাছে চলে এল।
আমি অবাক বিস্ময়ে ওদের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তিমি , ডলফিন পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু মৎসকন্যা ! সোনালী রঙের অপরূপা মৎসকন্যা তার আকাশনীল রঙের ঠোঁট। মুখটা অনেকটা প্রিয়ার মত, পেলব, মায়াজড়ানো। বলল, ” সাংবাদিক জয়জিৎ, তুমি এর বিচার কর।”
” কী হয়েছে। তোমার নাম কী ? তোমরা এখানে কেন ? আমিই বা এখানে কী করে এলাম।” কোনমতে বললাম।
” আমি মায়া। এরা দুজনেই আমাকে বিয়ে করতে চায়। এদের ঝগড়ায় জলের প্রাণীরা ভীষন বিরক্ত। তুমি ভেসে ভেসে আসছিলে। মানুষরা শুনেছি প্রাণীজগতের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমান জীব। তাই তোমাকে তুলে এখানে নিয়ে এলাম। এবার তুমিই বল , আমার কি করা উচিৎ। ”
হে ভগবান, এদেরও শান্তি নেই ! বেশ ইন্টারেস্টিং লাগছে। বাঙালি তো এমনিতেই ঝামেলাপ্রবণ জাতি। নিজের থেকে পরের বিচার করতে বেশী ভালবাসে। আমি মুহুর্তেই বিচারকের ভূমিকা পালনে নেমে পড়লাম।
” তা প্রিয়া সরি মায়া , তুমি কাকে বেশী পছন্দ কর।”
” আমি এদের দুজনকেই পছন্দ করি। কারণ এরা আমার বন্ধু। ”
আমি ডলফিন ও তিমিকে জিজ্ঞাসা করলাম , ” তোমরা নিজেদের সপক্ষে যুক্তি দাও। পাত্র হিসেবে তোমরা কে কতটা উপযুক্ত ? ”
তিমি বলল, ” আমি শক্তিশালী। জলের নীচে নানা আক্রমণ থেকে মায়াকে আমি রক্ষা করতে পারব। তাছাড়া শিকার ধরতে আমি পটু। মায়ার খাদ্যের জোগান দিতে আমি অনেক বেশী সক্ষম। ”
আমি ডলফিনের দিকে তাকালাম। সে দুটো ছোট হাত নাড়িয়ে বলল, ” আমি মায়াকে অনেক সুখে রাখতে পারব। আমি জলজ প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী রোমান্টিক। গান গাই , নাচি , নরম প্রকৃতির। মানুষরাও আমার বুদ্ধির তারিফ করে। মায়া আমার সাথে বেশী আনন্দে থাকবে। ”
আমার প্রিয়ার কথা মনে পড়ে গেল। আহা রে, বেচারীর কত ভালো ভালো বিয়ের পাত্র এসেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত … যাক্, মোহময়ী মায়াকে জিজ্ঞাসা করলাম , ” তুমি কী চাও ? সিকিউরিটি না রোমান্টিসিজম ? ”
মায়া তার গোলাপী লেজ এপাশ ওপাশ নাড়িয়ে বলল, ” বিয়ের ব্যাপারে আমি এখনো মনস্থির করিনি। কারণ আমাদের সমাজে বিয়ে প্রথা এখনো চালু হয় নি। তুমি মৎসকন্যা শুনেছ, কিন্তু কখনো মৎসবঁধু শুনেছ ? আমি নিয়ম ভাঙ্গতে যাব কেন ?”
আমি পুরুষ জাতির হয়ে একটু মিনমিন করে বললাম, ” নিয়ম তো ভাঙ্গার জন্যই মায়া। তা তুমিই না হয় নতুন প্রথা চালু করলে। ”
” দেখ সাংবাদিক , আমরা মুক্ত থাকতেই পছন্দ করি। শুধু শুধু এসব বন্ধনে জড়াব কেন ? আজ এ শক্তি দেখাচ্ছে কাল আমার ওপর জুলুম খাটাবে। আজ ও গান শোনাচ্ছে , কাল ঘ্যানঘ্যান করবে। প্রথম প্রথম সবই স্বপ্নীল মনে হয়। পরে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে যায়। তুমি নিজে তো বিবাহিত। বৌকে কতটা সময় দাও । মাছের ঝোলে ঝাল বেশী হলে কথা শোনাও না ? আগে তুমিও নিশ্চয়ই অনেক মিষ্টি মিষ্টি প্রমিস করেছিলে ? ” মায়া বেশ উত্তেজিত।
আমি এক নারীবাদী কন্ঠের প্রতিবাদে বেসামাল হয়ে পড়লাম। মায়ার মুখটা প্রিয়ার মুখের সাথে মিলে যাচ্ছে। মায়া গোলাপী লেজটা সুমুদ্রের জলে ঝাপটা মারল। কিছুটা জল এসে আমার চোখে মুখে ছিটকে লাগল।
” কী হল কী ? কি বিড়বিড় করছ ? অনেকক্ষণ ধরে তো আ্যলার্ম বাজছে। ”
প্রিয়া ঘুম ভাঙ্গাতে মুখে জলের ছিটে দিয়েছে। খুব সকালে উঠতে গেলে আমাকে এভাবেই ডাকতে হয়।
××××××××××××××××