তীর্থের পথে পথে – কাছে পিঠে মা হংসেশ্বরীর মন্দির — কোয়েলী ঘোষ

তীর্থের পথে পথে – কাছে পিঠে
মা হংসেশ্বরীর মন্দির

কোয়েলী ঘোষ

এই বাংলার পথে প্রান্তরে ছড়ানো আছে সুপ্রাচীন টেরাকোটার মন্দির , ঘুমিয়ে আছে রাজবাড়ির ইতিহাস ।
তারই খোঁজে আমরা খুব সকালে বেরিয়ে পড়েছি কাটোয়াগামী ট্রেনে হংসেশ্বরী মন্দিরের পথে ।
বাঁশবেড়িয়া স্টেশনে এসে একটা টোটো ধরে চলে এসেছি এক প্রাচীন রাজবাড়ীর ফটকের সামনে । এই ফটক পেরিয়ে পায়ে হাঁটা পথ চলে গিয়েছে রাজবাড়ীর দিকে ।


খুব শান্ত নির্জন পরিবেশ । চারিদিকে সবুজে ঘেরা । এক শুভ্র মন্দিরের চূড়া , দূরে গঙ্গা দেখা যাচ্ছে ।
মন্দিরের গঠন শৈলী , স্থাপত্য অভিনব ।

উপনিষদে হংস শব্দের অর্থ সূর্য , জ্ঞান । হংস + ঈশ্বরী – হংসেশবরী অর্থাৎ যিনি আলোক স্বরূপা , যিনি জ্ঞান স্বরূপা তিনি দেবী হংসেশবরী ।

পায়ে পায়ে এগিয়ে যাই মন্দিরের দিকে । মন্দিরের মতই অভিনব মায়ের মূর্তি । অপূর্ব জ্যোতিময় শান্ত মায়ের রূপ ।
” মধুর আমার মায়ের হাসি চাঁদের মুখে ঝরে ”
মুখখানি দেখলে মনে হয় করুণা যেন ঝরে পড়ছে ।
মা দক্ষিণাকালী ত্রিনয়নী , চতুর্ভুজা । বামহস্তে খড়্গ ,নিচে নরমুন্ড । ডান হস্তে বরাভয় , নিচে সিদ্ধিদায়িনী । বেদীতে সহস্র দল পদ্ম , ওপরে অষ্ট দল পদ্মের বেদী । বেদীর ওপর খোদিত পঞ্চ ত্রিকোণ যন্ত্রের ওপর শায়িত আছেন শিব । তাঁর হৃদয় থেকে প্রস্ফুটিত এক পদ্মের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন মা । বাম পা ভাঁজ করা , ডান পাটি মহাকালের বুকের ওপর কিছুটা ঝোলানো ।

জবা পুষ্প দলে অঞ্জলি আর পুজো সম্পন্ন হল । ফল আর মিষ্টি প্রসাদ পেলাম । এবার ঘুরে ঘুরে মন্দিরটি দেখতে আরম্ভ করলাম ।
মন্দিরের উচ্চতা সত্তর ফুট । চূড়াগুলো পদ্মময় , অধ্যাত্ম সুষমা মন্ডিত । মন্দিরের চারপাশে দ্বাদশ চূড়া । তার মধ্যে দ্বাদশ কৃষ্ণ বর্ণের শিবলিঙ্গ বিরাজমান । মন্দিরের গঠন শৈলীতে তন্ত্রদর্শন লুকানো আছে । একটি তল আর একটি তলের চেয়ে ছোট , এইভাবে ছোট হতে হতে স্থিত হয়েছে একটি ছোট প্রকোষ্ঠে , একমেবাদ্বিতীয়ম এই তত্বে ।
অনন্ত বাসুদেব মন্দির

পাশের মন্দিরটির দিকে এগিয়ে যাই । এটি সুবিখ্যাত অনন্ত বাসুদেব মন্দির ।
রাজা রামেশ্বর রায় এই অপরূপ টেরাকোটার মন্দির নির্মাণ করেন । মন্দিরের দালানে বসে দেখি কত পৌরাণিক কাহিনী , দেব দেবী , রামায়ণ মহাভারত , যুদ্ধ বিগ্রহ , যান বাহন , পূজা পার্বণ ইত্যাদি খোদিত আছে । মন্দিরের ভিতরে যে কালো কষ্ঠি পাথরের মূর্তি প্রতিষ্ঠিত ছিল , ১৯৬১ সালে তা চুরি হয়ে যায় । বর্তমান বিগ্রহ নতুন ।
চারিদিক সুন্দর ফুল আর বাহারী পাতায় সাজানো । মন্দিরের চাতালে বসে আছি । চারিদিকে আলো ছায়া খেলে যায় । অলকদা শুরু করলেন চণ্ডীপাঠ , । প্রদীপ বাবু , বিনয়দা সব গান গাইলেন একে একে । মায়ের গানের ভক্তি মূর্ছনায় প্লাবিত হল প্রাঙ্গণ ।

রাজবাড়ীর ইতিহাস
মন্দিরের সাথেই আছে পাঁচিল ঘেরা রাজবাড়ি । ছড়িয়ে আছে রাজবাড়ীর ইতিহাস । সেই পথ ধরে চলে যাই অনেক পিছনে ।
ভাগীরথীর তীরে এই অঞ্চল ছিল জঙ্গল ভরা , বাঁশ বনে পূর্ণ । সেইখান থেকে নাম হল বাঁশবেড়িয়া ।

সম্মান আর গৌরোবজ্জ্বল পটিভূমিতে দাঁড়িয়ে ছিল এই রাজবাড়ি । এই বংশের আদিপুরুষ ছিলেন মহারাজ দেবদত্ত । এই বংশের রাজা বর্ধমান জেলার পাটুলিতে রাজধানী স্থাপন করেন । রাজা রামেশ্বর এখানে এসে রাজবাড়ি নির্মাণ করে বসবাস শুরু করেন । তিনি দুর্গা পুজো , কালী পুজো প্রচলন করেন এবং অনন্ত বাসুদেবের মন্দির প্রতিষ্ঠা করে বিষ্ণু দেবকে স্থাপন করলেন ।

নবাব আলিবর্দী খাঁ এই রাজবংশের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন । অসহায় বিধবা মহারানী সত্য সুন্দরী দেবী তার পুত্র নৃসিংহকে নিয়ে বঞ্চনার বেদনা বুকে নিয়ে মানুষ করতে লাগলেন ।
নৃসিংহদেব শৈশব থেকেই মাতৃভাবে তন্ময় থাকতেন , আপন ভাবে বিভোর ।
দীর্ঘ কাল পর ব্রিটিশ আমলে তাঁর সম্পত্তির কিছু তিনি ফেরৎ পেলেন ।
দুবার বিবাহ দেওয়া সত্বেও তিনি তন্ত্র সাধনার জন্য কাশীযাত্রা করলেন । রানী শঙ্করী রাজবাড়ির দেখাশোনার কাজে রয়ে গেলেন ।
সেখানে একদিকে সাধনা অন্যদিকে পাণ্ডিত্য অর্জন করে নৃসিংহদেব ” উদ্দিশতন্ত্র ” পুস্তক রচনা করলেন ।
এরপর জগজ্জননী সন্তানকে দর্শন দিলেন হংসে শ্বরী রূপে । মায়ের আদেশে তিনি মন্দির পাথর বোঝাই করা নৌকা নিয়ে রওনা দিলেন বাড়ির উদ্দেশ্যে । ১৮০১ থেকে ১৮১৪ সাল অবধি মন্দির , প্রতিমা নির্মাণ হল । এরপর মহাসাধক নৃসিংহদেব লীন হলেন । তাঁর নির্দেশে সমস্ত দায়িত্ব মাথায় তুলে নিলেন রানী শঙ্করী ।
এক বিশাল নিমগাছ দিয়ে তৈরি হল মাতৃপ্রতিমা। মহাসমারোহে প্রতিষ্ঠিত হলেন সিদ্ধিরুপিনী জগজ্জননী মা । কালী পুজোর রাতে ব্যবহৃত হয় একটি রুপোর মুখোশ । সেদিন মা সেজে ওঠেন করালবদনা লোল জিহ্বা ভয়ংকরী রূপে ।
বারংবার প্রণাম তোমায় ।

কোন রূপে মা ডাকবো তোরে
হৃদকমলে দাঁড়া মা একবার ,
দেখি তোরে নয়নভরে ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *