তীর্থের পথে পথে —– মহাপ্রভু বাড়ি বা গৌরিদাস বাড়ি কালনা —- কোয়েলী ঘোষ

তীর্থের পথে পথে
মহাপ্রভু বাড়ি বা গৌরিদাস বাড়ি কালনা

কোয়েলী ঘোষ

রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে টোটো এসে দাঁড়াল মহাপ্রভু বাড়ি । মনে প্রশ্ন জাগে – কে এই গৌরিদাস ? শ্রীচৈতন্যদেব কেন এখানে তাঁর সাথে দেখা করতে এসেছিলেন ?
চৈতন্য চরিতামৃত , ব্রজবিলাস , গৌরগণোদ্দেশ দীপিকা ইত্যাদি পুরাণ গ্রন্থে গৌর দাসের উল্লেখ পাওয়া যায় ।

“সুবলো য: প্রিয় শ্রেষ্ঠ স গৌরিদাস পণ্ডিত গোস্বামী ”

যিনি ছিলেন ব্রজে শ্রীকৃষ্ণ সখা সুবল তিনিই গৌর লীলায় গৌরিদাস পণ্ডিত গোস্বামী ।

১৪৮৫ খৃষ্টাব্দে নদীয়া জেলার শালিগ্রমে জন্ম নিয়েছিলেন গৌরিদাস । অনেক তীর্থ ভ্রমণের পর এলেন অম্বিকা কালনায় । গঙ্গার তীরে তিনি এক বিশাল তেঁতুল গাছের তলায় বসেছিলেন ।
ওপারে শান্তিপুরে মহাপ্রভুর মন উচাটন । এক ছোট ডিঙি নৌকা বেয়ে তিনি চলে এলেন তেঁতুলতলায় । প্রদীপের ম্লান আলোয় এক জ্যোতিমূর্তি দেখে তিনি প্রণাম করতে যেতেই বুকে জড়িয়ে ধরলেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু । আবেগে বিহ্বল গৌরিদাসকে গঙ্গা তীরে নিয়ে গিয়ে দেখলেন তার পূর্ব পরিচয় । গঙ্গার জলে ভেসে উঠল সখা সুবলের ছবি , শ্রীকৃষ্ণের সাথে শৈশব লীলা । প্রায় মূর্ছিত সখাকে মহাপ্রভু আবার বাস্তবে ফিরিয়ে আনলেন ।
তাঁর হাতে নিজের হাতের বৈঠাখানি তুলে দিয়ে বললেন – এ বৈঠা ভবনদী পারের বৈঠা । জীবকে যুগ যন্ত্রণা থেকে উদ্ধারের নাম মন্ত্রস্বরূপ বৈঠা মানুষকে পার করবে ।
গুরুদাস আবেগে , আনন্দে আত্মহারা হয়ে চৈতন্য মহাপ্রভুকে নিয়ে এলেন নিজগৃহে । মহাপ্রভু নিজের লেখা গীতাভাষ্য পুঁথি খানি তুলে দিলেন গৌরদাসের হাতে ।
এখানেই মহাপ্রভুর ইচ্ছায় প্রথম তাঁর আর নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর দারু মূর্তি স্থাপন হল ।শুরু হল এক গুহ্য লীলা ।


কিছুকাল পর মহাপ্রভু এবার বিদায় চাইলেন কিন্তু গৌরদাস কিছুতেই বিদায় দিতে চান না । তখন তিনি দেখলেন সিংহাসনের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন মহাপ্রভু আর নিত্যানন্দ মহাপ্রভু , আর এক মহাপ্রভু ও নিত্যানন্দ চলে যাচ্ছেন ।
এই দারুমূর্তি এত জীবন্ত ছিল যে গৌরদাসের ভয় ছিল যে কোন ভক্ত হৃদয়ে ধারণ করে নিলে তিনি চলে যাবেন । মন্দিরের দরজাগুলো সেইজন্য দর্শনের সাথে সাথে খোলা আর বন্ধ করে দেওয়া হয় ।
এই মহাপ্রভুর ঝলক দর্শন বা ঝাঁকি দর্শন ।
গৌর নিতাই এর সৌম্য শান্ত সুন্দর মূর্তি দর্শন করলাম । মনে পড়ে গেল কবি বল্লভের পদ —

” জনম অবধি হাম রুপ নেহারলু
নয়ন না তিরপিত ভেল ”
বার বার কত জন্ম ধরে এই রূপ দেখছি তবু চোখ তৃপ্ত হয় না ।
বার বার দর্শন আর প্রণামের পর এখানেই মহাপ্রভুর ভোগ প্রসাদ পেলাম । আমরা মাটিতে বসে সেই অমৃত ভোগ‌ তৃপ্তি সহকারে খেয়েছিলাম ।চুড়ো করে সাজানো ভাত ,ভাজা ,নানা ব্যঞ্জনে থালা সাজিয়ে পরিবেশিত হল । সেই কাঠের উনুনে আর গঙ্গাজলে প্রতিদিন ভোগ রান্না হয় ।
তারপর পায়ে হাঁটা পথ ধরে গেলাম সেই আমলি তলা যেখানে মহাপ্রভু বিশ্রাম নিয়েছিলেন । সেই প্রাচীন পাঁচশ বছরের পুরনো তেঁতুল গাছের তলায় মহাপ্রভুর পদচিহ্ন আর গৌরি দাসের আসন আজও আছে । চারিদিকের দেওয়ালে মহাপ্রভুর লীলা আঁকা আছে ।


আভূমি প্রণাম জানিয়ে এবার আমরা চলেছি নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর শ্বশুর বাড়িতে ।
এখানে সূর্যদাস পণ্ডিতের কন্যা জাহ্নবার সঙ্গে বিবাহ হয়েছিলেন মহাপ্রভুর প্রিয় পার্ষদ নিত্যানন্দ অবধূতের ।সেই বাড়ি ,বাড়ির ভিতরে মন্দির , আর একটি চত্বর ঘিরে আছে পাঁচশো বছরের বিশাল কুলগাছ ।

এবার গন্তব্যস্থল হল ভবা পাগলার মন্দির । ভবা পাগলা ছিলেন মাতৃ সাধক । তাঁর লেখা অজস্র গান , সুর তিনিই দিয়েছেন । মনে পড়ল সেই বিখ্যাত গান – ”গানই সর্বশ্রেষ্ঠ সাধনা ” ।

ভেতরে দেখলাম মায়ের কালো রঙের ছোট্ট কালী মূর্তি , যেন বালিকা বেশে আনন্দময়ী মা হাস্য মুখে এসে দাঁড়িয়েছেন । পরবর্তীকালে ভবার ভবানী নামে বিখ্যাত হয়েছেন এই মা । এত অপরূপ জীবন্ত বলে মনে হয়েছে যে চোখ ফেরে না ,মাথার পিছনে সূর্যের মত আলোর ছটা ।
একপাশে ভবা পাগলের পাথরের মূর্তি ,একপাশে রাধা কৃষ্ণের বিগ্রহ আর দেওয়ালে দেওয়ালে তাঁর বাণী ,গান লেখা আছে । অনতিদূরে এখানে তাঁর সমাধি দর্শন করলাম ।
এখানেও ভোগের ব্যবস্থা আছে ।

মাকে প্রণাম জানিয়ে এবার চলেছি সাধক কমলাকান্তের বাড়ি । একদিন ছিল মাটির ভিটে কিন্তু এখন আর ভিটে নেই । ভেতরে দর্শন করলাম সাধক কমলাকান্তের পূজিত মা কালীর এক জ্যোতির্ময় বিগ্রহ মূর্তি ।
সাধক রামপ্রসাদের পর শাক্ত পদাবলীর আর এক উল্লেখযোগ্য কবি কমলাকান্ত ।
তাঁর লেখা অজস্র গানের মধ্যে ”সদানন্দময়ী কালী মহাকালের মনমোহিনী ” কিংবা ” মজল আমার মনভ্রমরা শ্যামাপদ নীলকমলে ” — বহুল প্রচলিত । মাকে ভক্তিপূর্ণ প্রণাম জানিয়ে এবার ঘরে ফেরার পালা ।

সারা পথ যিনি ধৈর্য সহকারে আমাদের এই তীর্থ দর্শন করিয়েছিলেন তিনি কালনার অধিবাসী আশিষবাবু । তিনি এবার তাঁর বাড়িতে চা খেয়ে জাবার অনুরোধ করলেন । চা বিস্কুট খাবার পর তাঁর বাড়ির লাগোয়া ঠাকুর ঘরটি দেখলাম । সেখানে গোবিন্দ লক্ষ্মীর এক মূর্তি দেখিয়ে তিনি এক লীলা কাহিনী বললেন । তাঁর পূর্ব পুরুষ ছিলেন বাংলাদেশের নোয়াখালীতে ।
একদিন গোবিন্দজি রাতে আশিসবাবুর পিতামহকে স্বপ্নে দেখা দিলেন –এখানে মাটিতে আমি কষ্টে আছি । আমাকে তুলে নিয়ে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত করো ।
পরদিন সকালেই তিনি গিয়ে দেখলেন সেখানে মাটি ফাটা , ওপরটা চিকচিক করছে । মাটি খুঁড়ে এই অষ্টধাতুর মূর্তি পাওয়া গেল । সেই মূর্তি নিয়ে এসে প্রতিষ্ঠা করা হয় । মধুর সেই লক্ষ্মী গোবিন্দ মূর্তি এই বাড়িতে নিত্য পূজিত হয় ।
এবার ফিরে যাবার পালা । এতক্ষণ পুরো কালনা দেখানোর জন্য ,ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতা জানিয়ে পায়ে হেঁটে চলেছি স্টেশনের দিকে ।
তখন সন্ধ্যে নেমেছে । আলোয় সেজে উঠেছে পথ । এখানে তাঁত জামদানি ঢাকাই শাড়ি বিখ্যাত । পথে যেতে চোখে পড়বে ।

মনের মধ্যে সঞ্চিত হয়ে থাকল এই মধুর স্মৃতি …এই ভক্তিরসে প্লাবিত কালনা শহর ,এই মন্দির ,টেরাকোটার অসামান্য সৃষ্টি ,প্রাচীন ইতিহাস ।
সত্যি কালনা এক গর্বের শহর , ভালবাসার শহর ।

তথ্যসূত্র -অম্বিকা কালনার ধর্মীয় ও পুরাতাত্বিক ইতিহাস
শ্রী বিজয় কৃষ্ণ গোস্বামী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *